banner

শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 249 বার পঠিত

 

তওবা কী, কেন এবং কীভাবে?

তওবা সম্পর্কিত কোরআনের দুটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। প্রথম ঘটনা হলো, তাবুক যুদ্ধের সময় দশজন সাহাবি বিনা কারণে সে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। তাদের মধ্যে সাতজন সাহাবি কৃত অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হয়ে নিজেদের মসজিদের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রেখে অনুশোচনা প্রকাশ করেছিলেন। (সূরা তওবা : ১০২)।

তওবা মানবজীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তওবা মানুষের বিকশিত হওয়ার হাতিয়ার। দোষগুণ এ দুইয়ের সমন্বয়ে মানুষের জীবন পরিচালিত হয়। মানুষ দোষ করবে এটাই স্বাভাবিক প্রকৃতি। কিন্তু দোষ বা অন্যায় বা পাপ যেন অভ্যাসে পরিণত না হয়, সেটাই লক্ষণীয়। তওবা শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো, ফিরে আসা, ক্ষমা প্রার্থনা করা, অনুতপ্ত হওয়া, বিশুদ্ধ হওয়া ইত্যাদি।

ইসলামী পরিভাষায় কোনো অন্যায় বা অপরাধমূলক কাজ হয়ে যাওয়ার পর অনুতপ্ত হয়ে সেই কাজের জন্য মহান প্রভুর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং সেই অন্যায় কাজ ছেড়ে ভালো পথে ফিরে আসাকে তওবা বলে। ইসলামের নির্দেশ অনুযায়ী প্রত্যেক গুনাহ তথা অন্যায় থেকে তওবা করা ওয়াজিব। তওবার ব্যাপারে কোরআনের বহু আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি সম্পূর্ণ একটি সূরার নামকরণ করা হয়েছে। কেননা ওই সূরায় মুসলমানদের তওবার বর্ণনা রয়েছে। তাই তার নাম তওবা রাখা হয়েছে। (মাজহারি)।

তওবা সম্পর্কিত কোরআনের দুটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। প্রথম ঘটনা হলো, তাবুক যুদ্ধের সময় দশজন সাহাবি বিনা কারণে সে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। তাদের মধ্যে সাতজন সাহাবি কৃত অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হয়ে নিজেদের মসজিদের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রেখে অনুশোচনা প্রকাশ করেছিলেন। (সূরা তওবা : ১০২)। বাকি তিনজন যথাক্রমে কাব ইবনে মালিক, মারার ইবনে রাবিয়া ও হিলাল ইবনে উমাইয়া (রা.)। যারা প্রকাশ্যে এভাবে নিজেদের অপরাধ স্বীকার করেননি। রাসূল (সা.) তাদের সঙ্গে সালাম, দোয়া আদান-প্রদান বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। তাদের সমাজচ্যুত করে রাখেন ৫০ দিন। এভাবে একঘরে করে রাখেন। কিন্তু রাসূল (সা.) সিদ্ধান্ত স্থগিত করে রাখলেন, ক্ষমা করবেন কী করবেন না। তখন তাদের ব্যাপারে সূরা তওবার ১০৬নং আয়াত নাজিল করেন। (বোখারি ও মুসলিম)।

অন্য ঘটনাটি হলো, হজরত মুসা (আ.) যখন আল্লাহর সঙ্গে তুর পাহাড়ে দেখা করতে গেলেন, তখন ইসরাইলি সম্প্রদায়ের নেতা সামেরি যিনি আগে থেকেই অনেক পরিচিত ছিলেন, তিনি মুসা (আ.) এর অনুপস্থিতিতে তাদের লোকদের স্বর্ণ-গয়না জমা রাখলেন। আর আগে থেকে তার কাছে জিবারইল (আ.) বাহনের ক্ষুরার নিচের মাটি ছিল। স্বর্ণ-গয়না ও মাটি মিলিয়ে জাদুর মাধ্যমে একটি বাছুরের মূর্তি বানালেন এবং তাকে খোদা বলে সাব্যস্ত করলেন। আর বললেন, মুসা তোমাদের ধোঁকা দিয়েছেন, খোদা এখানে চলে এসেছেন। তখন মহান আল্লাহ তায়ালা হজরত মুসা (আ.) এর মাধ্যমে সতর্ক করলেন আর তওবা করতে বললেন। কিন্তু তওবার জন্য কঠোর শর্ত দিলেন যে, তাদের একজন অন্যজনকে হত্যা করতে থাকলেই তাদের তওবা কবুল হবে। আল্লাহর শর্তানুযায়ী তারা তা পালন করলেন। অতঃপর মুসা (আ.) আল্লাহর নির্দেশে তাদের ডেকে বললেন, প্রভু তোমাদের সবার তওবাই কবুল করেছেন। এ হত্যাযজ্ঞে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তারা শহীদ হয়েছেন। আর যারা বেঁচে রয়েছেন তারা ক্ষমাপ্রাপ্ত। এখানে প্রতীয়মান হয়, যেসব লোক মন্দ কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তা সে কাজ যত বড়ই পাপ হোক, কুফরিও যদি হয়, তবুও পরবর্তী সময়ে তওবা করে নিলে এবং ঈমান ঠিক করে ঈমানের দাবি অনুযায়ী নিজের আমল বা কর্ম সংশোধন করে নিলে আল্লাহ তাকে নিজ রহমতে ক্ষমা করে দেবেন। কাজেই কোনো পাপ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তা থেকে তওবা করে নেয়া একান্ত কর্তব্য। (তাফসিরে মারেফুল কোরআন)।

তওবা কোনো আনুষ্ঠানিকতার নাম নয়। তওবা মূলত অন্তরের ব্যাপার। অন্যায় বা পাপ কাজ থেকে বিরত থাকার আন্তরিক ইচ্ছাই হলো তওবা। কিন্তু তওবা কবুল হওয়ার জন্য কতগুলো শর্ত বিদ্যমান। যদি শরিয়তের দৃষ্টিতে অপরাধমূলক কাজ তথা গুনাহ আল্লাহ এবং বান্দার মধ্যে হয় ও তার সঙ্গে কোনো মানুষের হক জড়িত না থাকে, তবে তা থেকে তওবা করার তিনটি শর্ত রয়েছে। আর তা তওবা কবুলের শর্তও বটে। প্রথমত, তওবাকারীকে গুনাহ থেকে বিরত থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, সে তার কৃত গুনাহের জন্য অনুতপ্ত। তৃতীয়ত, তাকে পুনরায় গুনাহ না করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করতে হবে। আর যদি অন্য কোনো ব্যক্তির সঙ্গে গুনাহের কাজটি সংশ্লিষ্ট থাকে, ইসলামের নিয়ম অনুযায়ী তা থেকে তওবা করার ওপরের তিনটি শর্ত ছাড়া আরও একটি শর্ত আছে, যা বান্দার হকের সঙ্গে জড়িত। চতুর্থ শর্তটি হচ্ছে, তওবাকারীকে হকদার ব্যক্তির হক আদায় করতে হবে। শর্ত থাকে যে, প্রাপক জীবিত থাকলে তাকে তার ধনসম্পদ ফেরত দিতে হবে অথবা মাফ করিয়ে নিতে হবে। প্রাপক জীবিত না থাকলে তার ওয়ারিশদের ফেরত দেবে। কোনো ওয়ারিশ না থাকলে বায়তুল মালে জমা দেবে। যদি বায়তুল মালও না থাকে অথবা তার ব্যবস্থাপনা সঠিক না হয়, তবে প্রাপকের পক্ষ থেকে সদকা করে দেবে।

এছাড়া কোনো অন্যায় দোষারোপ এবং অন্য কোনো বিষয় থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি থেকে তার শাস্তি ভোগ করতে হবে অথবা তার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। গিবত বা পরনিন্দার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। সব তওবার জন্য অবশ্যই গুনাহ বর্জনীয়। শারীরিক দুর্বলতা ও অক্ষমতার কারণে গুনাহ বর্জন করলে তওবা কবুল হবে না। যাবতীয় গুনাহ থেকে বিরত থাকা ও তওবা করাই শরিয়তের কাম্য। কিন্তু কোনো বিশেষ গুনাহ থেকে তওবা করলেও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মতানুযায়ী সে গুনাহ মাফ হবে। তবে অন্যান্য গুনাহ বহাল থাকবে। এ সম্পর্কে কোরআন ও হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, যারা মন্দ কাজ করে, তারপর তওবা করে নেয় এবং ঈমান আনে, তবে নিশ্চয়ই তোমার প্রভু তওবার পর অবশ্য ক্ষমাকারী করুণাময়। (সূরা আল আরাফ : ১৫৩)।

অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, তিনি তার বান্দাদের তওবা কবুল করেন, পাপগুলো মার্জনা করেন এবং তোমরা যা কর, সে বিষয় তিনি অবগত রয়েছেন। (সূরা আশশুরা : ২৫)।

হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, হজরত আবু মুসা আবদুল্লাহ ইবনে কায়েস আশয়ারি (রা.) রাসূল (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, আল্লাহ পশ্চিম (আকাশ) দিক থেকে সূর্যোদয় (কেয়ামত) না হওয়া পর্যন্ত প্রতি রাতে তার ক্ষমার হাত সম্প্রসারিত করতে থাকেন। যাতে রাতে গুনাহগার তওবা করে। (মুসলিম)। উল্লিখিত আলোচনা পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় যে, তওবার গুরুত্ব অপরিসীম। তওবা করার জন্য আসলে নির্দিষ্ট কোনো দোয়া বা পন্থা নেই, যার দ্বারা তওবা করা যায়। তবে প্রসিদ্ধ আছে যে, ‘আসতাগফিরুল্লাহ রাব্বি মিন কুল্লি জানবিউ ওয়াতুবু ইলাইহি লা হাওলা ওয়ালা কুয়াতা ইল্লা বিল্লা হিল আলিয়িল আজিম’- এটা বলে মূলত তওবা করা হয়। এছাড়াও কয়েকটি দোয়া পড়া হয়। তবে মনে মনে বিশুদ্ধ নিয়ত করলেই তওবা কার্যত হয়ে যাবে। মোট কথা হলো, মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সৃষ্টি করেছেন কিছু নিয়মনীতি, বিধিবিধানের মাধ্যমে। আল্লাহ তায়ালা যেসব কাজ-কর্ম আমাদের জন্য বৈধ করে দিয়েছেন, এর বাইরে কিছু হয়ে গেলে তা থেকে তওবা করে নেয়াটাই উচিত। খালেছ নিয়তে বিশুদ্ধ তওবাই মানুষের মুক্তির একমাত্র পথ।

লিখেছেন : মুহাম্মদ আরিফুর রহমান জসিম
গ্রন্থনা ও সম্পাদনা : মাওলানা মিরাজ রহমান

Facebook Comments