ডা.ফাতিমা খান
প্রতিদিন রোগী দেখা শেষ করে বাসায় ফিরতাম রাত দশটায়। বাসায় এসে ঠান্ডা পানিতে গোসল সেরে আয়েশ করে ধোঁয়া ওঠা চা/কফি খাওয়া ছিল আমার সে সময় প্রতিদিনের অভ্যাস। হয়তো ভাবছেন, এত রাতে চা-কফি ? ঘুম আসবে তো ?
আসবে…ঘুম আসতে চাইলে আসবেই, আর না আসলে কিছু করার নাই, চা-কফির দোষ দিয়ে লাভ নেই, আমার ঘুম এমনিতেই খুব কম । সারারাত ‘নির্ঘুম প্রহরী’ হয়ে জেগে থাকার অভ্যাস আমার বহুদিনের।
বাসায় ঢোকা মাত্র প্রায়ই দিনই কারেন্ট চলে যেত। আমাদের এলাকার লোডশেডিং এর সময়-জ্ঞানটা ছিল অসাধারণ! প্রতিদিন একই সময় বিদায় নিত, আবার ঠিক সময়মতই চলে আসত। আমার বুয়া রিমির মা ঝটপট ‘বিকল্প বাতি’র ব্যবস্থা করতে করতে ভেংচি কেটে বলত, ”ভাবী আইছে না, অহনই কারেন্টের যাওন লাগব”।
আমি হাসতাম। রিমির মায়ের এই কথায় একটা অব্যক্ত মমতা ছিল। ব্যাপারটা আমার সয়ে গেলেও রিমির মার কষ্ট হত এই ক্লান্ত আমার জন্য। ঢাকা শহরে দিনশেষে সহি-সালামতে ঘরে ফিরতে পেরেছি এই তো অনেক … প্রতিদিন শুকরিয়া নামাজ পড়া উচিত। কারেন্ট চলে গেলে যাক, আমি আমার মত আমার চা/কফির কাপটা নিয়ে সোজা চলে যেতাম আমার ছোট্ট বারান্দাটায়।
হিজিবিজি দালানের ঢাকা শহরেও উপরতলার ফ্ল্যাটগুলোর খোলা জানালা বা বারান্দা দিয়ে চমৎকার ফুরফুরে বাতাস আসে। আর যদি হয় দক্ষিণমুখী বারান্দা, তাহলে ত আর কথাই নাই ! পূর্ণিমারাতে চাঁদের আলোর একটুখানি হলেও দালানের গা গড়িয়ে তৃষার্ত শহরে ছড়িয়ে পড়ে। বর্ষার দিনে ঝিরঝির বৃষ্টি সামান্য হলেও বারান্দাটা ভিজিয়ে দেয়। এই বারান্দায় বসেই আমি ভেজা মাটি, বৃষ্টি আর বাতাসের একটা মিশ্র সুবাস নিতাম।
সেদিন রাত বাজে প্রায় ১ টা । ল্যাম্পের আলোয় বই পড়ছিলাম। এসময় বাসার সবাই দিব্যি ঘুমে তলিয়ে থাকে। সবাই বলতে আমার ছেলে, রিমির মা (ঘরের কাজের জন্যই তাকে রাখা হয়েছিল কিন্তু তাকে সবাই আমার আত্নীয়া মনে করত) আর রুবি, আমার ছেলের খেলার সাথী।
রিমির মা কখন যে এসে আমার সামনে দাড়িয়েছে টের পাইনি। টেবিল ল্যাম্প এর কুসুম আলোতে তাকে কিছুটা উজ্জ্বল লাগছে, রিমির মার চেহারায় অদ্ভুত একটা মায়াবী আর দুখী দুখী ভাব আছে। আজ মনে হচ্ছে এখানে আরও একরাশ মেঘ এসে জড় হয়েছে !
– কিছু বলবে?
_মা ফুন করছিল ভাবী।
– কি বলল ? সব খবর ভাল ? তোমার রিমি কেমন আছে ?
_ভাবী, রিমির বাপ আইছে বাড়িত।
– তো ?
_রিমিরে নেবার চায়। মাও এর হাতে পায়ে ধরে মাফ চাইছে। আমাদের রাখি আর কুনুখানে যাইব না।
এরকম শপথ রিমির বাপ আগেও অনেকবার করেছে, আবার অনেকবার ভেঙ্গেছেও । রিমির জন্মের আগেই এই লোকটা তার বউ আর অনাগত সন্তানকে ফেলে চলে গিয়েছিল অন্য কারো সংসারের অর্ধাংশ পূর্ণ করতে। এরপর ফিরে এসেছিল ঠিক, কিন্তু কিছুদিন পর সেই আবার একি ঘটনা ঘটায়। প্রতিবার সে হাতে পায়ে ধরে মাফ চায়।
যে বারবার কথা রাখবে না তার কথা দেয়ার কোন অধিকার আছে কি ?
রিমির মা রাও যে কি! এত অন্যায় সহ্য করে কেন?
কিন্তু ওদেরই বা কি দোষ!
আমাদের দেশের সমাজটাই তো এমন, যেকোন সাংসারিক বা সামাজিক ক্রন্দলের নন্দঘোষ হল বেশীরভাগ ক্ষেত্রে মেয়েরা। এদের কাজ হল মুখে ছিপি এঁটে, কানে তুলা দিয়ে, চোখে কালো কাপড় বেঁধে কোমড়ে বাঁধা দড়ি মোতাবেক চলতে থাকা। এই অদৃশ্য দড়ির পরিচালক বদলযোগ্য। দড়ি-চালক ভালো হলে তো ঠিক আছে, কিন্তু খারাপ হলে জীবনটা একেবারেই অসহনীয় করে দেয়।
আদর্শহীন মুর্খ সমাজব্যবস্থার এই একটা বিশাল সমস্যা। কিন্তু এগুলো কে বোঝাবে কাকে ?
– তুমি এখন ঘুমাও তো রিমির মা। কাল ভেবে দেখব।
কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। আমার ছোট্ট সংসারে রিমির মায়ের অবদান ছিল অনেক বেশী। টাকা-পয়সা দিলে যতই কাজের মানুষ পাওয়া যাক না কেন, অন্যের সংসারকে আপন করে সাজিয়ে গুছিয়ে সবটুকু ভালবাসা দিয়ে কাজ করবে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। রিমির মায়ের স্বভাব-চরিত্র আর অভ্যাসগুলো অন্য আর দশজন কাজের মানুষের মত ছিল না। তাছাড়া কোথাও না কোথাও ওদেরকে আমার একাকীত্বের সাথীও মনে হত। জীবনের অতিরিক্ত ব্যস্ততায় আমি মেশিনের মত হয়ে গিয়েছিলাম , মাঝে মাঝেই কোন অনুভূতি কাজ করত না । আমার স্বস্তিময় জগতটা তখন খুব ছোট..শুধু আমার ছোট্ট ঘরটুকু। সারাদিন রোগবিদ্যা, ছাত্র-ছাত্রী, রোগী আর চিকিৎসার পাট চুকিয়ে ছুটে আসতাম আমার ছোট্ট জগতে, যেখানে আমার সোনামণিটা আমার জন্য অপেক্ষা করত সারাদিন, ওর উচ্ছলতা, দূরন্তপনা আর মিষ্টি হাসির আমেজে ভরে থাকত আমার স্বর্গসম নীড়।
আমার অনুপস্থিতিতে রিমির মা-ই ওকে বুকের মাঝে আগলে রেখেছে। রিমির মা চলে গেলে আমার চেয়ে বেশী কষ্ট হবে ওর। ওর অবুঝ চোখ দুটো খুঁজে বেড়াবে অনেক দিনের চেনা কোলটাকে! কিন্তু শুধু নিজের কথা ভাবলে তো আর চলবে না, আমিই বা এত স্বার্থ্পর হই কেমন করে ??…কি করি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
বিদায় বেলায় রিমির মা অনেক কেঁদেছিল। সে কান্নায় কোন শব্দ ছিল না। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল ওখানে অসহায়ত্ব চিরস্থায়ীভাবে বাসা বেধেছে। অনিশ্চয়তার এক আর্তচিৎকার বেরিয়ে আসতে চাইছে ওর মুখ ফুটে। যে মানুষ বারবার ধোকা খেয়েছে সে জেনে বুঝে আরেকবার ধোকার জালে তখনই পা ফেলে যখন কোথাও না কোথাও তার বাধ্যবাধকতা থাকে।
রিমি ওর দূর্বলতা। ও বড় হয়েছে। তার ভবিষ্যত চিন্তা করে রিমির মা আবার ফিরে যাবে শ্বশুরবাড়ি। পরে কি হবে, আদৌ তার মেয়েটার পিতৃ-ঠিকানায় আশ্রয় দীর্ঘস্থায়ী হবে কিনা এগুলো ভাবার অবসর নাই। ওদের জীবনটা কূলহীন নদীতে ভাসিয়ে দেয়া নৌকাটার মত। ঝড়, ঝঞ্জা, বাতাস, জোয়ার-ভাটায় কখনও নাও টলমান তো আবার কখনো মৃদু গতিতে চলমান। রাত হলে দিনের অপেক্ষা…দিন এলে রাতের আয়োজন। অনেক কিছু না-পাওয়া জীবনেও ওদের সীমাহীন স্বপ্নই একমাত্র সম্বল।
যুক্তি বা বাস্তবতার পেশীবহুল হাতটা ওদের স্বপ্নের সাথে পাঞ্জা লড়ে হার মানে বারবার। বিত্তবান আর বিত্তহীনদের স্বপ্নের মাঝে একটা বিশাল তফাৎ হল বিত্তবানদের স্বপ্নগুলো ওদের ঘুম কেড়ে নেয়… আর বিত্তহীনরা স্বপ্নই দেখে ঘুমিয়ে যাওয়ার পর। রিমির মায়ের চোখে মুখে এরকম এক স্বপ্ন আমি দেখেছি অনেক বার। সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য সে অবিরাম ছুটে চলেছে…… ।
একদিন আফসোস করে বলেছিল, ” পোলা হইলে তো কথাই ছিল না ভাবী, মাইয়া।
লেখিকা কর্মরত: আল হিবা মেডিক্যাল গ্রুপ, জেদ্দা, সৌদি আরব।