বিশ্ব প্রবীণ দিবস চলে গেল। বাংলা ট্রিবিউনে ওল্ডহোমের উপর একটি ফিচার পড়ে মনটা ব্যাথায় ভরে উঠলো।
পাঁচ সন্তানের পাঁচজনই আমেরিকা,
কানাডা,অস্ট্রেলিয়াতে থাকেন টাকার অভাব নেই কিন্তু ঠাই হয়নি মায়ের। আশ্রয় নিয়েছেন ওল্ড হোমে। বাদ পড়েনি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের জ্ঞানী অধ্যাপক। সমাজের উচ্চশ্রেনীর অনেকের বাবা মা আজ আশ্রয় নিয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে। ক্রমাগত ভাবে বাড়ছে ওল্ডহোম।
আক্ষেপ করে এক মা বললেন “প্রকৃতি কাউকে ক্ষমা করবে না”। ওরাও নিশ্চই একদিন এখানেই আসবে। এটা শুনে মনে পড়লো নচিকেতার গাওয়া বৃদ্ধাশ্রম গানটির কথা।যেখানে মা অপেক্ষায় আছেন আরো কটাদিন বেঁচে থাকার যেন তার সন্তানও বৃদ্ধাশ্রমে ঠাই নিবেন সেই দৃশ্যটি তিনি দেখে যেতে পারেন।ওল্ডহোম বিষয়টি প্রতিটি সন্তানের জন্য কলংঙ্ক।
ছোটবেলায় আমরা যখন অসহায় ছিলাম তখন বাবা মাই ছিলেন আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। ঠিক তেমনি বাবা মায়ের বয়স হলে ছেলে মেয়েরাই তাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন হওয়ার কথা কিন্তু আমরা অমানুষ হয়ে গেছি। বাবা মাকে বোঝা মনে করে ফেলে রেখে আসছি ওল্ড হোমে।
আমি তখন খুব ছোট। বাবা পুকুরে সাতার কেটে গোসল করতেন। আমি বলতাম বাবা আমিও পুকুরে নামবো। বাবা পুকুর থেকে উঠে এসে আমাকে তুলে ধরতেন তার পর ছুড়ে মারতেন পুকুরের পানিতে! আমি প্রায় ডুবেই যেতাম। অনেক পানি খেতাম। বাবা তখন আমাকে তুলে নিতেন। এভাবে অনেক বার বাবা আমাকে মাঝ পুকুরে ছুড়ে মেরেছেন। আমি অবিরাম পানি খেয়েছি আর ডুবতে ডুবতে বাবা আমাকে টেনে তুলেছেন। আমার মনে হত বাবা আমাকে ভালবাসলে নিশ্চই ওভাবে ছুড়ে ফেলতেন না।
ভাইয়ার একটা সাইকেল ছিল। আমি চাইতাম সেই সাইকেল চালানো শিখবো। বাবাকে অনেকবার বলার পর বাবা আমাকে সাইকেলে চড়তে দিলেন। নিজে পিছনে ধরে রাখলেন।আমি খুব বিশ্বাস করে সাইকেলে উঠে বসলাম। প্যাডেল করলাম আস্তে আস্তে। বাবা তখন হুট করে সাইকেলে ধাক্কা দিয়ে ছেড়ে দিলেন। আমি কিছুদুর গিয়ে পড়ে গেলাম। হাটু ছুলে গেল। এভাবে বাবা আমাকে অনেক বার সাইকেলে চড়িয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছেন। আমি ভাবতাম বাবা যদি আমাকে ভালবাসতো তবে নিশ্চই আমাকে ওভাবে সাইকেলে বসিয়ে দিয়ে ছেড়ে দিতেন না।
আমি জুতার ফিতা বাঁধতে পারতাম না। বাবাকে বলার পরও বাবা আমার জুতার ফিতা বেঁধে দিত না। অথচ আমার অন্য বন্ধুদের বাবা তাদের জুতার ফিতা বেঁধে দিত। বাবা আমার পাশে বসে বার বার বলতেন এভাবে বাঁধো ওভাবে বাঁধো কিন্তু নিজে বেঁধে দিতেন না। আমি ভাবতাম বাবা যদি আমাকে ভালবাসতেন তবে নিশ্চই ছোট বেলা আমার জুতার ফিতা বেঁধে দিতেন।
বাবার চা খাওয়ার খুব নেশা ছিল।নিজে একা একা চা বানিয়ে খেতেন।আমি যখন বলতাম বাবা আমাকেও এক কাপ দাওনা প্লিজ। বাবা কিচেন দেখিয়ে দিতেন। বলে দিতেন কি কি করতে হবে। নিজের বানানো এককাপ চা খাওয়ার পরও বলতেন আমার জন্যও এক কাপ বানাসতো। বাবা যদি আমাকে ভালবাসতো তবে নিজে যখন চা বানিয়েছিল আমার জন্যও এক কাপ বানাতো।
বাবা খুব গাছে চড়তে পারতো।আমারও খুব লোভ হত। বাবাকে বলতেই বাবা আমাকে কাঁধে করে নারকেল গাছের বেশ উপরে নিয়ে যেত। তার পর বলতো গাছ জড়িয়ে ধরতে। আমি যখনি জড়িয়ে ধরতাম বাবা আমাকে ফেলে রেখে তরতর করে নিচে নেমে যেত। আমার কান্না পেতো। আমি তখন আস্তে আস্তে হেচড়েপেচড়ে নিচে নামতাম আর আমার বুকটা ছুলে যেত। বাবা যদি আমাকে ভালবাসতো তবে ওরকমটি করতে পারতো না।
এক প্যারেন্টস ডেতে বাবাকে নিয়ে বলতে বলা হয়েছিল আমাকে। আমি তখন এসব কথা বলেছিলাম। এ গুলোই ছিল বাবার বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ। পরদিন বাংলা মিস ক্লাসে এসে বললেন আজ আর আমি পড়াবোনা। তোমাদের সাথে গল্প করবো।তোমাদেরকে কিছু প্রশ্ন করবো তোমরা যারা উত্তর জানো তারা হাত উচু করবা আর না জানলে চুপ থাকবা। তিনি প্রশ্ন করলেন তোমাদের মধ্যে কে কে সাতার কাটতে পারো? আমি সাথে সাথে হাত উচু করলাম। মিস আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলেন। আমি আশেপাশে তাকিয়ে দেখি আর কেউ হাত উচু করেনি।তার মানে তারা কেউ সাতার কাটতে পারেনা। এর পর মিস একে একে প্রশ্ন করলেন কে কে সাইকেল চালাতে পারো, কে কে গাছে চড়তে পারো, কে কে নিজে নিজে জুতার ফিতা বাঁধতে পারো ইত্যাদি ইত্যাদি। দেখা গেল আমি ছাড়া আর কেউ হাত উচু করছেনা।
মিস আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে কাঁধে হাত রেখে বললেন তুমি কি বুঝতে পারছো কিছু? আমি বুঝতে পারলাম।আমার অগচরে বাবা আমাকে সব শিখিয়েছেন।আমার চোখেও তখন পানি চলে এসেছিল।সেদিন বাড়িতে গিয়ে দেখি আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরে অনেক ক্ষণ কেঁদেছিলাম। বলেছিলাম বাবা তুমিই পৃথিবীর সেরা ।
হয়তো কারো কারো বাবা তাকে মাসে দু মাসে আগ্রার তাজমহল,মিশরের পিরামিড কিংবা নায়াগ্রা ফলস দেখাতে নিয়ে যায়।হয়তো কারো কারো বাবা তাকে আইফোন সিক্স থেকে শুরু করে অন্য সব না চাইতেই দেয়।আবার কারো কারো বাবা হয়তো সন্তানকে কিছুই দিতে পারেনা।এমনকি দুবেলা পেটভরে খাবারও দিতে পারেনা।কিন্তু বাবাদের ভালবাসার কোন কমতি নেই।যে বাবা সন্তানকে আলিশান বাড়ি দিচ্ছেন ঘুরতে নিয়ে যাচ্ছেন প্যারিসে,ভেনিসে ট্রয় নগরিতে সেই বাবা তার সন্তানকে যেমন ভালবাসেন বাসতে চান ঠিক তেমনি ভাবে যে বাবা মা তার সন্তানের মুখে পেট পুরে খাওয়ার মত খাবারটুকুও তুলে দিতে পারছেন না তারাও তাদের সন্তানকে একই রকম ভালবাসেন।শুধু ভাগ্যের দরুন বাকিদের মত দেখাতে পারেন না।
বাবারা আসলে সন্তানের কাছে তেমন কিছু চায়না।যদিও সন্তান হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হল তারা যেমন আমাদের অসহায় কালে আমাদের আগলে রেখেছিলেন তেমনি তাদের অসহায় কালে আমরাও তাদের যেন আগলে রাখি।এবার একটা গল্প বলি শুনুন, এক বৃদ্ধ লোক একটা মোবাইল মেকানিকের কাছে তার মোবাইলটা দিয়ে বললেন দেখতো বাবা আমার মোবাইলটার কি সমস্যা।কল আসেনা। মোবাইল মেকানিক ভাল করে দেখে বললেন চাচা আপনার মোবাইলেরতো কোন সমস্যা নেই। বৃদ্ধা তখন মোবাইলটা হাতে নিতে নিতে বললেন মোবাইল যদি ঠিকই থাকবে তবে এই মোবাইলে আমার ছেলে মেয়েদের ফোন আসে না কেন?বৃদ্ধর চোখে তখন অবিরাম অশ্রুধারা।
তার সন্তানেরা তাকে ছেড়ে গেছে ওল্ড হোমে। তাদের কারো কারো আছে আলিশান বাড়ি ঠিক যেমনটি আমরা এবারের প্রবীণ দিবসে বাংলাট্রিবিউনের করা ফিচারে দেখতে পেলাম। মায়ের একধার দুধের দাম শরীরের চামড়া কেটে জুতা বানিয়ে দিলেও শোধ হয়না বলে আমরা শুনেছি। অন্ধকারে ভয় পেয়ে যে মাকে জড়িয়ে ধরতাম সেই মাকে কি করে আমরা ওল্ডহোমে ফেলে যাই জানা নেই। একটিবারও কি কখনো আমরা ভেবে দেখেছি আমাদের সেই সব দিনের কথা।
যে বাবার গলাজড়িয়ে না ধরলে ঘুম আসতো না।যে মা হাতে তুলে খাইয়ে না দিলে খাওয়া হত না।যে মায়ের আঁচলের তলে ছিল আমাদের সব থেকে নিরাপদ ভূবন সেই মা বাবাকে কি করে সন্তান হয়ে আমরা ভুলে যাচ্ছি তা ভাবতেই মনে হচ্ছে ধরণী দ্বিধা হও।নিজের স্ত্রী সন্তান যদি বাড়িতে থাকার যায়গা পায়,দু বেলা দু মুঠো ভাত পায় তবে জন্মদাতা পিতা মাতা কেন পাবেনা?
ইউরোপ আমেরিকার কথা বাদ দিতে চাই।আমাদের দেশে আইন করা উচিত কেউ যদি বাবা মাকে ওল্ডহোমে রেখে আসে তবে তাদের জেল জরিমানা করা হবে। এতো নীতি বাক্য বলে লিখে ভাষণ দিয়ে যখন ওই সব সন্তানদের মনে বাবা মায়ের প্রতি দায়িত্ব বুঝানো যায়নি তখন আইন করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।লোকে যেমন বলে সোজা আঙ্গুলে ঘি ওঠেনা অনেকটা সেরকম।অন্তত তার পরও বাবা মা নিজের সন্তান পরিবারের সাথে থাকুক আমি এমনটিই চাই।পৃথিবীতে কোন মা বাবাকে যেন উহ শব্দটিও করতে না হয় সে প্রত্যাশা ব্যক্ত করি। আজ থেকে পণ করি নিজে খেয়ে না খেয়ে হলেও বাবা মাকে দেখে রাখবো ভালবাসবো। পৃথিবীর সব দুঃখী বাবা মার কাছে সেই সব অপরাধী সন্তানের হয়ে ক্ষমা চাই।
———–
বাবা মায়ের দুঃখ গুলি
জাজাফী
উত্তরা,ঢাকা-১২৩০
০১ অক্টোবর ২০১৭
দৈনিক ইত্তেফাকে ৩ অক্টোবর ২০১৭ প্রকাশিত