আমার বিয়ের আগে একটা মাত্র উপদেশ পেয়েছিলাম আমার এক কাজিনের থেকে, সে বলেছিল, যত যাই হোক, তোদের একটা কমন পয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট রাখবি। যাতে তোদের শখের জিনিসটা নিয়ে আলোচনা করতে পারিস, দেখবি অনেক ঝড়ের মধ্যেও ওটা তোদের কাছাকাছি রাখবে।
আমি এত ভাল বুঝি নাই। কমন পয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট – আমাদের ত আনকমন ইন্টারেস্ট খুঁজে পাওয়াই কষ্ট বেশি। এক সাবজেক্টে পড়াশুনা করেছি, এখনও একই জায়গায় একসাথে পড়ি, কমন না কী? সবই ত কমন। যাই হোক, মূল্যবান উপদেশটার মাথা মুণ্ডু হদিস করতে না পেরে শিকেয় যত্ন করে তুলে রেখেছিলাম। ল্যাব এ জয়েন করার পর আমার সুপারভাইজর কাপলটাকে দেখে খুউব ভাল লাগত। ভদ্রলোক বেশ আলাভোলা সাইন্টিস্ট, ভদ্রমহিলা খুব কেয়ারিং, অর্গানাইজড। আমরা বাসায় এসে বলাবলি করতাম, আমরা ওদের মত কাপল হব, হ্যা?
একই ওয়ার্কপ্লেসে কাজ করাটা অনেকটা ঘরের কাজ ভাগাভাগি করে করার মত। পারস্পরিক সমঝোতা তৈরি হওয়ার সুযোগ অনেক বেড়ে যায়। উল্টোটাও হতে পারে, ব্যক্তিত্বের সংঘাত আরো বেড়েও যেতে পারে, কারণ ভুলগুলো আরো বেশি চোখে পড়বে।
কিন্তু ভলান্টারি কাজ একসাথে করার মধ্যে যে আনন্দ তার কোন তুলনা হয়না। এতে ত কোন কিছু পার্থিব লাভ বা ক্ষতি নেই, তাই ভুলচুক হলেও অত গায়ে লাগেনা। আবার কাজটা না করলেও ত সে পারত – এরকম একটা মেন্টালিটি থাকে, তাই ছোট্ট কাজকেও খুব মহৎ লাগে। অন্যের জন্য স্বার্থ ছেড়ে কাজ করার একটা বাই ডিফল্ট ভাল অনুভূতি আছে, সেটা প্রিয় মানুষটার সাথে ভাগাভাগি হলে আনন্দটা বহুগুণ বেড়ে যায়। হয়ত কোনদিন ভাল করে চোখ মেলে দেখেন নি, যে তার ভেতর এত মহত্ত্ব আছে। আর কিছু না, ছোট্ট একটা চ্যারিটিও দুজন মিলে প্ল্যান করে করলে হঠাৎ একটা উপলব্ধি আসে, ‘কীসের জন্য তেল নুন চাল ডাল নিয়ে ঝগড়া করছি? আমরা একসাথে ত আছি অ-নে-ক উপরের লেভেলের কাজ করার জন্য।’ আমার সত্যিই মনে হয় আল্লাহ এরকম ইফোর্ট দেখলে এত খুশি হন যে নিজ উদ্যোগে তখন ঘরটা শান্তি দিয়ে ভরে দেন। আর ভাল কাজ একসাথে মিলে করলে খুব গর্বও হয়, আমার বউ/ স্বামী আর দশজনের মত না, সে অন্যদের কথা ভাবে, সে স্বার্থপর না।
অনেক দম্পতির নানা কারণে ঘরের বাইরে ভলান্টারি কাজ করার সুযোগ নেই। আসলে বাইরে যাওয়ার দরকারও নেই। সন্তান মানুষ করার কাজটাকে যদি কেউ জাস্ট আল্লাহ কে খুশি করার উদ্দেশ্যে পূর্ণ ইফোর্ট দিয়ে করে, তাহলে এর চেয়ে বড় চ্যারিটি আর হয়না। কিন্তু এই প্যারেন্টিং ইস্যু তে এসে দম্পতিরা সবচেয়ে বেশি ধরা খেয়ে যান। তারা এটাকে ঘাড়ের উপর চেপে বসা একটা বোঝা মনে করেন। যদি ভাবতেন একটা নতুন মানুষের জীবনের ট্র্যাক ঠিক করে দেয়ার জন্য আল্লাহ আমাদের দুজন কে এক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তাহলেই হয়ে যেত। স্বামী স্ত্রী করেন কি, একজন আরেকজনের উপর রাগ উঠলে বাচ্চাদের সামনে বা বাচ্চাদেরই উপর প্রতিশোধ নেন। অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টো। বাচ্চারা শিখে ফেলবে এই ভয়ে রাগ টা কপ করে গিলে ফেলা, কারণ shaping up someone’s personality is a far more superior task than winning in this psychological tug of war.
নিদেনপক্ষে অন্য মানুষটার শখের বিষয়টাতে আন্তরিকভাবে উৎসাহ দিলেও হয়। এই যে বিখ্যাত লেখকরা প্রায় সময়ই অদৈহিক ভালবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন, বেশির ভাগ সময় এটার শুরু হয় তাদের যার যার সৃষ্টি নিয়ে উঁচুমানের মত বিনিময় থেকে।
জাগতিক বিষয়াদি হয়ত তার স্ত্রী সামলাচ্ছে, কিন্তু ভাবনার জগতে, সৃষ্টির জগতে সে একদম একা। অন্তত ‘প্রথম আলো’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথের স্ত্রীর বর্ণনা পড়ে আমার ওরকমই মনে হয়েছে। এক জনপ্রিয় সাহিত্যিক তার স্ত্রী সম্পর্কে লিখেছিল, ওর অনেকগুলো মুগ্ধ করা গুণের মধ্যে একটা হল আমি টুকরো টাকরা কাগজে যাই লিখি ও যত্ন করে একটা বাক্সে গুছিয়ে তুলে রাখে, যদি পরে কাজে লাগে! এক অভিনেত্রী তার স্বামী এক্সিডেন্ট এ মারা যাওয়ার পর দুঃখ করে বলছিলেন, আমার সম্পর্কে কাগজে যত রিপোর্ট আসত সব সে সংগ্রহ করে লেমিনেট করে রাখত।
লেখার শুরুতে যে বলেছিলাম, ম্যাজিক স্পেল বা তালিসমান – আমি নিশ্চিত এটাই সে জিনিস। আপনাদের মধ্যে যত সমস্যাই থাকুক, খুঁজে এমন একটা কাজ বের করুন, যেটা দুজনের কাছেই নিঃস্বার্থ ভাল কাজ মনে হয়। যদি সেটা হয় ধর্মচর্চা বা প্রচার, তাহলে ত কথাই নেই। একসাথে করে দেখুন, সঙ্গের মানুষটার জন্য নতুন করে ভালবাসায় বুকটা ভরে যাবে। মনে হবে, s(he) may not be the perfect person of the world, but s(he) is perfect in my world.
দাম্পত্য – ৩
http://oporajitabd.com/?p=8495
দাম্পত্য – ২
http://oporajitabd.com/?p=8468
দাম্পত্য – ১.
http://oporajitabd.com/?p=8455
(পরের পর্বের জন্য “অপরাজিতার” সাথেই থাকুন)
নুসরাত রহমান
পিএইচডি(বায়োলজি)