এই পর্বে ওভার জেনারালাইজেশন ও গ্লোবাল লেবেলিং এর বিরূদ্ধে কী করা যায় সে নিয়ে আলোচনা করা হবে। আগের পর্ব তে বলা হয়েছিল এ দুটো ক্ষেত্রে একটা ব্যর্থতাকে টেনে টেনে পুরো জীবনের/ব্যক্তিত্বের উপর দাগ ফেলা হয়। এই যেমন, মিটিং এ দেরি করে আসলাম, আমার মত অলস, অকর্মণ্য পৃথিবীতে কেউ নেই। বাসায় সুন্দরভাবে মেহমানদারি করতে পারলাম না, আমি জীবনেও ঘরকন্না শিখব না।
ওভারজেনারালাইজেশন যখনই মনের মধ্যে হতে চাইবে, এ প্রশ্নগুলো করতে হবে,
১. আমার এই চিন্তার ভিত্তি কী? ২. আমার কাছে কি এই সিদ্ধান্তে পৌছানোর জন্য পর্যাপ্ত তথ্য আছে? ৩. ঘটনাটা থেকে আমি যে উপসংহার টানছি, তার বদলে অন্যভাবে কি ভাবা যায়? ৪. গৎবাঁধা মন্তব্য না করে, পরিষ্কারভাবে বল, একদম পয়েন্ট আকারে। ৫. ভবিষ্যৎ দেখার দায়িত্ব তোমাকে কে দিল?
ধরা যাক, সূচি সবসময় মনে করে,
– আমাকে কেউ পছন্দ করেনা – বন্ধুরা কেউ আমাকে দাওয়াত দেয়না – সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে – আমি একটা গাধা স্টুডেন্ট – পুরো পৃথিবীতে আমার একটাও বন্ধু নেই – আমার সারা জীবনেও কোন বন্ধু হবে না
সূচির এক্ষেত্রে যা করা উচিৎ –
প্রথমেই মনটাকে একটা ধমক দেয়া উচিৎ, এইসব ফালতু চিন্তা মনে আসার জন্য। ধমক দিলে কিছুক্ষণের জন্য ক্রিটিকের বিরূদ্ধে লড়াই করার সাহস পাওয়া যায়। তারপর নিজেকে প্রশ্ন করা উচিৎ, এরকম সারাজীবনের জন্য সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলার জন্য আমার হাতে কী প্রমাণ আছে? সারা পৃথিবীতে আমার একটাও বন্ধু নেই – আমি সারা পৃথিবীর সবার সাথে মিশি নি। আমি পুরো পৃথিবী ঘুরে দেখিনি! আমাকে ‘কেউই’ পছন্দ করেনা কথাটা কি ঠিক? হ্যা, সঞ্চিতা আমাকে দেখতে পারেনা, মুহায়মিন ও না। কিন্তু রূপন্তি আমাকে ভীষণ ভালোবাসে! হ্যা, দুই দুইটা ক্লাশমেটের জন্মদিনে আমাকে দাওয়াত দেয়নি, কিন্তু সেদিন ও তো পিকনিকের প্ল্যান সবাই মিলে করলাম! তারপর আত্মীয়দের বাসায়, পাশের বাসার আপুর ঐখানে তো আমি প্রায়ই যাই! সুতরাং, আমাকে কেউ পছন্দ করেনা, কেউ দাওয়াত দেয়না – এগুলি ঠিক কথা না। আমার কোন বন্ধু নাই, এটাও ঠিক না! হয়ত যেমনটি চাই তেমন বন্ধু নেই, কিন্তু একেবারে নেই এটা মিথ্যা কথা! সুতরাং এইসব দুঃখবাদি চিন্তাভাবনা আমাকে বাদ দিতে হবে! আমি মোটেও এত একা নই, যতটা আমি ভাবি।
আর আমি গাধা স্টুডেন্ট না। আমি ছবি আঁকতে পারি খুব ভালো। আমার ক্রিয়েটিভিটি আছে। আমি এদের স্ট্যান্ডার্ডে ভালো করতে পারিনা ঠিকই, কিন্তু আমার পছন্দের ফিল্ডে আমি খুব ভালো করি। ক্রিয়েটিভিটি মুখস্ত বিদ্যার চেয়েও অনেক বেশি দামি।
পাশাপাশি, সূচি যদি মনে করে সে মোটা, নাকটা বিচ্ছিরি, অসামাজিক, তখন মনে মনে নিজেকে ধমক দিতে হবে, বলতে হবে, আমি ছোট ব্যাপারকে বড়সর করে ফেলছি। মোটা বললে যদি মন খারাপ হয়, তখন বলতে পারে, টার্গেট ওজনে আসার জন্য আমাকে ষোল কেজি কমাতে হবে।
আমি এই, আমি সেই – এই চিন্তাটা দূর করতেই হবে। তাতে করে সত্যিটা মিথ্যে হয়ে যাবেনা। কিন্তু বিষয়টাকে মোকাবেলা করা অনেক সহজ হয়ে যাবে।
আমার নিজের বেলায় যেমন, আমি বলতে ভালোবাসি আমি নিওফোবিক (নতুন যে কোন কিছুকেই আমি ভয় করি।) কথাটা সত্যি, পিএইচডি শেষ করে চাকুরি খুঁজতে ইন্টারভিউ দিতে হবে, আমি কখনও ইন্টারভিউ দেইনি, তাই ওটা ভাবতেই ভয় করে, মনে হয় আমাকে কেউ কখনও চাকরি দেবেনা। কনফারেন্সে প্রথমবার পোস্টার প্রেজেন্ট করতে কেমন দুরু দুরু বুক – অথচ ব্যাপারটা কিছুই না! প্রথমবার ক্লাশে লেকচার দিতে গিয়ে ভয়ে দম বন্ধ হয়ে আসার অবস্থা।
যাই হোক, সেল্ফ ক্রিটিক এর এই পর্যায়ে পেছন ফিরে দেখি, জীবনে নতুন কাজের সংখ্যা কম না। রিসার্চ প্রজেক্ট নিয়েছি এমন একটা, ডিপার্টমেন্টে আর কেউ আগে করেনি। সোশ্যাল ওয়ার্ক এর নতুন কোন সুযোগ আসলে যেটুকুই হোক অংশ নেয়ার চেষ্টা করেছি। আর অত কিছু কেন, নতুন পরিবেশে, নতুন দেশে টিকে থাকতে পারে যে, তার আর কিছু নিয়ে ভয় করার দরকার আছে?
নতুন জিনিস দেখলে এখনো ভয় লাগে, কিন্তু আবার পুরনো সফলতা মনে করে মনকে সাহস দিলে, আর একটু একটু করে একধাপ করে এগোলে জিনিসটাকে মোকাবেলা করা যায়। এতদিন পর্যন্ত নতুন কাজের কথা কেউ বললেই পিছিয়ে যেতাম, মনকে বলতাম, আমি নিওফোবিক, আমার সময় লাগবে। তারপর ফেলে রাখতাম অনেকদিন। এখন মনে হচ্ছে, তার বদলে এভাবে ভাবতে হবে, আগে করিনি? জানিনা কেমন হবে? ঠিক আছে, আরো একটু জেনে বুঝে নেই। পুরনো কাজগুলিও তো একসময় নতুন ছিল। শুরু না করলে তো ওগুলো চিরকাল নতুনই থেকে যেত!
নুসরাত রহমান
পিএইচডি(বায়োলজি)