যে সিঁড়িতে গুলিবিদ্ধ বঙ্গবন্ধু পড়ে ছিলেন, সেখানে কাচের এপারে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি আমরা। বঙ্গবন্ধু ও শেখ ফজিলাতুন্নেছার রক্তমাখা পোশাক দেখে শিউরে ওঠেন ফারজানা, মলি ও শাহনাজ। এমন মৃত্যু কি প্রাপ্য ছিল জাতির জনকের? তিনজনই বলে ওঠেন একসঙ্গে।
টিপটিপ বৃষ্টি উপেক্ষা করে সকাল সকাল এসে হাজির তাঁরা তিনজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছাত্রীদের মধ্যে বিশেষ একটি মিল আছে—তাঁরা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে থাকেন। ফারজানা আকতার ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিতে স্নাতকোত্তর করছেন, মলি হালদার দর্শন বিভাগের তৃতীয় বর্ষে ও শাহনাজ কবীর ব্যবস্থাপনা বিভাগে তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন। ফারজানা ও মলি হলের রুমমেট। তবে শাহনাজের সঙ্গে সেদিনই পরিচয় হয় বাকি দুজনের। ফজিলাতুন্নেছা হলের এই তিন ছাত্রীকে নিয়ে ১১ আগস্ট গিয়েছিলাম ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরে। চাপা একটা উত্তেজনা ছিল তাঁদের মধ্যে। গেটের বাইরে ফলক পড়ার সময় জানালেন, আগে আসার সুযোগ হয়নি। এবারই প্রথম আসা তিনজনের।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরের বর্ধিত ভবনের শেখ লুৎফর রহমান ও শেখ সায়রা খাতুন প্রদর্শনী গ্যালারি থেকে দেখা শুরু হয়। আমাদের সঙ্গে ছিলেন জাদুঘরের গাইড বরুণ রাহা। হলে নিয়মিত অনুষ্ঠান হয়, প্রতিবছর আগস্ট মাসে অনুষ্ঠানের কারণে বঙ্গবন্ধুর পরিবার, বিশেষ করে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সম্পর্কে জেনেছেন এই তিন ছাত্রী।
‘বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী হিসেবে সারা জীবন বঙ্গবন্ধুকে নানাভাবে সমর্থন দিয়েছেন। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে গতকাল (১০ আগস্ট) আমাদের হলে অনুষ্ঠান ছিল। আগামীকাল (১২ আগস্ট) বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছার স্মরণে অনুষ্ঠান হবে। প্রতিবছরই হয়। নিজের আগ্রহ থেকেই যাই। এভাবেই তাঁর সম্পর্কে জানতে পেরেছি।’ বললেন শাহনাজ। তবে মলির জানাবোঝা একটু বেশি। জাদুঘরে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন সময়ের ছবি দেখে তার পেছনের ইতিহাস বলতে শুরু করেন তিনি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সকালে বঙ্গবন্ধুর যাওয়ার কথা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেটা কি জানা আছে এই তিনজনের? হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়েন। বর্ধিত ভবন থেকে আমরা গেলাম পুরোনো ভবনে। একতলায় রান্নাঘর দেখে দোতলায় উঠি আমরা। কাচঘেরা রক্তের ছোপ ও গুলির চিহ্ন দেখে ফারজানা, মলি ও শাহনাজ যেন কিছুক্ষণ কথা বলতে পারেন না। ‘আমার খুব খারাপ লাগছে। কী ভয়াবহ ছিল সেই রাত, এখানে না এলে বুঝতে পারতাম না। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের ওপর দিয়ে কী দুর্যোগ গিয়েছে, ভাবতেই পারছি না। যারা মেরেছে, তারা আসলে মানুষ হতেই পারে না। মানুষ মানুষকে এভাবে মারতে পারে?’ ফারজানা বলেন। চোখভর্তি পানি তিনজনেরই।
কত বই এখানে! বঙ্গবন্ধুর লাইব্রেরি ছিল যেখানে, সেটা দেখে তাঁরা অবাক হলেন। শেখ কামাল ও শেখ জামালের শোয়ার ঘর দেখে বিস্ময়ের শেষ নেই। বাহুল্য নেই, কিন্তু রুচিশীল। শেখ কামালের ঘরে কি-বোর্ড, সেতার দেখে শাহনাজ বলেন, ‘শেখ কামাল সংগীতচর্চা করতেন, সুলতানা কামাল কত বড় অ্যাথলেট ছিলেন। সুলতানা কামালের মিষ্টি হাসির সৌরভ যেন এখনো ছড়িয়ে আছে ঘরময়—তাই না?’ তাঁর সঙ্গে সম্মত হন বাকি সফরসঙ্গীরা। কিন্তু মলি ও ফারজানার মন খুব খারাপ হয়ে গেছে। মলি বলেন, ‘এখানে না এলে জীবনে একটা অপূর্ণতা থাকত। আসব আসব করে এখানে আসা হচ্ছিল না। ধন্যবাদ, তাদের এই উদ্যোগের কারণে আসা হলো।’
‘শেখ রাসেল বেঁচে থাকলে এখন কত বড় হতেন, তাঁর জন্য খুব খারাপ লাগছে।’ একটা দীর্ঘশ্বাসের পর ফারজানা আকতার বলেন। যে নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটেছে তাঁদের জন্মের আগে, সেই ঘটনায় যেন ফিরে গেলেন তাঁরা। নতুন প্রজন্ম জানল, যে বাড়িতে তাঁরা দাঁড়িয়ে, সেখানে ঘটেছিল ইতিহাসের কালো অধ্যায়।
পুরো জাদুঘর ঘুরে দেখার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরের কিউরেটর নজরুল ইসলাম খান এই তিন ছাত্রীকে ঘুরতে আসার জন্য ধন্যবাদ দেন। বলেন, ‘শিগগিরই আমরা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের ছাত্রীদের এখানে নিয়ে এসে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করব। যেখানে শেখ ফজিলাতুন্নেছার জীবন নিয়ে স্মৃতিকথা বলবেন বিশিষ্টজনেরা।’
তিন ছাত্রী যখন বেরিয়ে এলেন, মন ভারী তাঁদের। ইতিহাসের নিষ্ঠুরতার কালো ছায়া তখন তাঁদের মন ছেয়ে গেছে। প্রকৃতিও যেন তা বুঝতে পেরেছিল। আবারও আকাশ তাই ছেয়ে গেল কালো মেঘে।