দিনাজপুর থেকে চিরিরবন্দর উপজেলা। চিরিরবন্দরের ঘুঘরাতলী মোড় থেকে রানীরবন্দর যেতে তিন কিলোমিটার উত্তরে আক্তারের বাজার। আক্তারের বাজার থেকে আরও তিন কিলোমিটার পশ্চিমে কাঁকড়া নদীর ওপরে ‘রাবার ড্যাম’। সেখান থেকে নদী পেরিয়ে ‘দুমুখাডাঙ্গী’ গ্রাম।
দুমুখাডাঙ্গী গ্রামের একটি বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল আটজন গৃহবধূ ঘরের মেঝেতে নকশিকাঁথা তৈরি করছেন। তাঁদের একজন সোনা রানী রায়। তাঁর হস্তশিল্প স্পেনে আন্তর্জাতিক হস্তশিল্প মেলায় ‘সেরা’ তালিকায় স্থান পেয়েছে। সোনা রানীর ‘হোয়াইট অন হোয়াইট ময়ূর’ নামে নকশিকাঁথাটি স্পেনের লোয়েভে ক্রাফট প্রাইজের জন্য মনোনীত হয়েছে। বিশ্বখ্যাত লোয়েভে ফাউন্ডেশন–এর আয়োজক। তবে সোনা রানীর সহজ কথা—অত কিছু জানেন না তিনি। শুধু জানেন বড় পুরস্কারের জন্য নাম উঠেছে। ‘সবকিছু মিশায়েল ভাই জানেন।’
কেয়ারের রংপুর কার্যালয়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোডাকশন ম্যানেজার হোসনে মোবারক বলেন, মিশায়েল আজিজ আহমাদ কেয়ারের সামাজিক ব্যবসায় উদ্যোগ লিভিং ব্লুর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তাঁর সঙ্গে এর আগে সোনা রানী যুক্তরাষ্ট্রে সান্তাফে আন্তর্জাতিক ফোক আর্ট মার্কেট মেলায় অংশ নিয়েছিলেন।
বিদেশি ক্রেতারা তাঁদের কাজ অনেক পছন্দ করেন। চাহিদাও দেখেছেন। এর জন্য সোনা রানী কেয়ারকে ধন্যবাদ দেন। কারণ, আগেও নকশিকাঁথা সেলাই করতেন। এ ধরনের নিখুঁত সেলাই করতেন না। মিশায়েল আজিজ ও তাঁর দলের কর্মীরা তাঁকে আরও দক্ষ করে তুলেছেন। সোনা রানী বলেন, ‘২০০৬ সালে কেয়ার বাংলাদেশের দুজন কর্মকর্তা প্রথম তাঁদের দুটি নকশিকাঁথা তৈরি করতে বলেন। ওই কর্মকর্তারাই নকশা দেন। আমি, তাপসী ও বিউটি রানী মিলে ওই দুটি কাঁথা তৈরি করে দিয়েছিলাম। আমাকে যা সম্মাননা দেওয়া হয়ে থাকে, সেই কৃতিত্ব আমার একার নয়। দলের সব সদস্যদের।’
নকশিকাঁথার নকশার মধ্যে আছে গ্রামে চারচালা ঘরের আদলে চৌয়ারি ঘর, ময়ূরের পাখা ইত্যাদি। চারটা করে বল পাশাপাশি এঁকে যে কাঁথা, তার নাম দেওয়া হয়েছে বল প্রিন্ট। ফুলের পাতার শিরার সমন্বয়ে আটটি অংশ নিয়ে তৈরি আটটি পাতা, পুঁটি মাছের ঝাঁক, মৌমাছির চাক ইত্যাদি নকশায় গৃহবধূরা কাঁথা তৈরি করছেন।
নকশিকাঁথা তৈরির সব উপকরণ, নকশা ও কাজ এনে দেয় কোম্পানি। সোনা রানী রায় কোম্পানির পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সেই কাজ ভাগ করে দেন সমিতির সদস্যদের মধে্য। কাজ শেষে পণ্য চলে যায় কোম্পানির অফিসে। বিক্রি হওয়ার পর কাঁথা তৈরির মজুরি দেওয়া হয়।
কী রকম মজুরি পান? জানতে চাইলে সূচিশিল্পীরা বলেন, ছয় ফুট প্রস্থ আর সাত ফুট দৈর্ঘ্যের একটা কাঁথা তৈরি করতে একজনের ২৫ দিন সময় লাগে। মজুরি পাওয়া যায় ২ হাজার ৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকা। ছোট-বড় একেক আকারের পণ্যের একেক রকম মজুরি দেওয়া হয়।
হোসনে মোবারক বলেন, ‘গ্রামীণ নারীদের জীবনমান উন্নয়ন ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগাতে কেয়ার বাংলাদেশ এই উদ্যোগ নিয়েছে। যাতে বিশ্ব পরিসরে তাঁদের কাজ তুলে ধরতে পারি আমরা।’
তাই তো আজ আন্তর্জাতিক অঙ্গনেই স্বীকৃতি পাচ্ছে সোনা রানী রায়দের কাজ।