ছোটবেলাতেই বুঝে গিয়েছিলেন আট-দশ জন স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবন তাঁর নয়। তাই বেড়ে ওঠার দিনগুলো পার করেছেন নিদারুণ কষ্টে। এই বন্ধুর পথ পেরোতে অনেক সময় হোঁচট খেয়েছেন, কিন্তু দমে যাননি। প্রাণশক্তি নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন অদম্য এই তরুণী। মাহবুবা হকের জীবনের গল্পটা যেন কষ্ট, হোঁচট ও সাফল্য—এই তিন শব্দে গাঁথা। সেটা তিনি আবার প্রমাণ করেছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর পরীক্ষার ফলাফল। তিনি ঢাকার ইডেন মহিলা কলেজের গার্হস্থ্য অর্থনীতি বিভাগ থেকে পেয়েছেন প্রথম শ্রেণি।
সাফল্যের গল্প শুনতে ফোন করেছিলাম মাহবুবা হককে। সবার কাছে ‘চাঁদের কণা’ নামে পরিচিত মাহবুবা হক তখন সিরাজগঞ্জ জেলার কাজীপুর উপজেলায় তাঁর গ্রামের বাড়িতে। কথার শুরুতে তিনি নিয়ে গেলেন তাঁর কষ্টের দিনগুলোতে, ‘আমি নয় মাস বয়সে পোলিওতে আক্রান্ত হই। তারপর থেকে আর নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারিনি।’ তাঁকে দৈনন্দিন কাজ, চলাচল করতে হয় হাতে ভর দিয়ে।
তাঁর বাবা-মা দুজনই ছিলেন চাকরিজীবী। তাঁদের ব্যস্ততার কারণে ছোটবেলায় নিঃসঙ্গ সময় পার করতে হয়েছে মাহবুবাকে। ‘হাতে ভর দিয়ে হাঁটতাম বলে অনেক বাচ্চা আমাকে দেখে ভয় পেত। তাই বাইরে বের হলে নানাজন নানা কথা বলত। খেলাধুলা করতে খুবই ইচ্ছে হতো। কিন্তু খেলতে গেলেও অপমানিত হতে হতো। তাই ছোটবেলা থেকে আমি অনেকটা গৃহবন্দী ছিলাম।’ কণ্ঠ ধরে আসে মাহবুবার।
সামাজিক এমন নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে নিয়মিত ক্লাস করতে পারতেন না। কিন্তু মাহবুবা হক বুঝেছেন জীবনে জয়ী হতে পড়াশোনা তাঁকে করতে হবে। ঘরে বসেই চালিয়ে যান পড়াশোনা। পরীক্ষার সময় শুধু হাজির হতেন স্কুল-কলেজে। এভাবেই ২০০৮ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন কাজীপুর থানা সদর কলেজ থেকে। স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন রাজশাহীর মাদার বখশ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে।
স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে বন্দিজীবন থেকে অনেকটা বেরিয়ে আসার সুযোগ পান তিনি। রাজশাহীতে এসেই পড়াশোনার পাশাপাশি সৃজনশীল বিভিন্ন বিষয় শিখতে শুরু করেন। সকালে গানের স্কুলে গান শেখেন তো, বিকেলে যান কবিতা আবৃত্তির ক্লাসে। এভাবেই তিনি সংবাদপাঠ, অনুষ্ঠান উপস্থাপনা, গল্পবলা, অভিনয়, কম্পিউটারের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ কোর্স করতে থাকেন। নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তোলার যেন এক অঘোষিত যুদ্ধে নেমে যান মাহবুবা। সাফল্যও আসে। কলেজে দাবা, ক্যারম ও গানে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পুরস্কার জিতেছেন বেশ কয়েকবার।
আবার হোঁচট খান তিনি। মাহবুবা হক বলেন, ‘স্নাতকে পড়ার সময় হঠাৎ মাকে হারাতে হয়। খুব খারাপ সময় গিয়েছিল তখন।’ কারণ, তাঁর বাবা আর ভাইদের পক্ষে সম্ভব ছিল না খরচ চালানো। তবু শারীরিক অসুস্থতা, মানসিক কষ্ট আর আর্থিক সমস্যার কাছে হেরে যেতে চাননি দৃঢ়প্রত্যয়ী মাহবুবা।
নিজের যোগ্যতায় চাকরি খুঁজতে থাকেন। তাঁর ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন ছিল প্রতিবন্ধী মানুষের জীবনের কষ্ট, পাওয়া না-পাওয়ার হতাশা নিয়ে টিভি অনুষ্ঠান করার। টিভি চ্যানেলের মতো একটা জায়গায় প্রোগ্রাম করার সুযোগ পাওয়াটা খুব একটা সহজসাধ্য ব্যাপার ছিল না। তবে চেষ্টা করে একসময় সাড়া পান মাহবুবা।
স্নাতক শেষ করে ঢাকায় এসে ভর্তি হন ইডেন মহিলা কলেজে। স্নাতকে ৬ নম্বরের জন্য প্রথম শ্রেণি হাতছাড়া হলেও স্নাতকোত্তরে তা আর মিস হয়নি।
মাহবুবা হক সম্পর্কে তাঁর শিক্ষক ও মাদার বখশ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের মনোবিজ্ঞানের প্রভাষক আখতার বানু বলেন, ‘শারীরিকভাবে সমস্যার মধ্যে থাকলেও অন্য অনেক শিক্ষার্থীর চেয়ে কর্মঠ ছিল। সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেই তার ছিল সরব উপস্থিতি।’
স্নাতক পড়ার সময় প্রথম বর্ষের কয়েক মাস তাঁকে সিঁড়ি বেয়ে পাঁচতলায় ক্লাস করতে হতো। এ জন্য নিয়মিত তিনি ক্লাস করতে পারতেন না। আখতার বানু বলেন, ‘আমরা অধ্যক্ষের সঙ্গে ওর কষ্টের বিষয়টি নিয়ে কথা বলি। তারপরই সিদ্ধান্ত হয় ওর সব ক্লাস দ্বিতীয় তলায় ২১০ নম্বর কক্ষে নেওয়ার ব্যাপারে।’
স্নাতকোত্তর পরীক্ষার সময় মাহবুবার পরীক্ষা কেন্দ্র ছিল ঢাকা শেখ বোরহান উদ্দীন পোস্টগ্র্যাজুয়েট কলেজ। পরীক্ষা দিতে হয়েছে চারতলার কক্ষে। সিঁড়ি বেয়ে ওঠা ছিল তাঁর জন্য কষ্টকর। মাহবুবা বললেন, ‘প্রতিটি ভবনে প্রতিবন্ধী মানুষের কথা ভেবে লিফট থাকা উচিত। আলাদা শৌচাগারও থাকা দরকার।’
এখন আপনার লক্ষ্য কী? মাহবুবা হক বলেন, ‘ভালো একটি সরকারি চাকরির, যেন চাকরির পাশাপাশি প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার নিয়ে কাজ করতে পারি।’