সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭১তম অধিবেশনে সারা বিশ্ব থেকে ১৭ জন ‘তরুণ নেতা’ অংশ নেওয়ার সুযোগ পান, যাঁরা নিজ নিজ দেশে জাতিসংঘ-ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনে কাজ করে যাচ্ছেন। এই ১৭ জনের মধ্যে ছিলেন ময়মনসিংহের মেয়ে সওগাত নাজবিন খান। ছুটির দিনের পাঠকদের জন্য লিখেছেন তাঁর সেই অভিজ্ঞতার কথা
আমি তখন জামার্নিতে। আরডব্লিউটিএইচ আচেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লিন এনার্জির ওপর স্বল্পমেয়াদি গবেষণা করছিলাম। সে সময়ই জাতিসংঘের ‘ইয়াং লিডার’ হওয়ার জন্য আবেদন করি। সেটা গত জুন মাসের কথা। তারপর কয়েকটি ধাপ পেরিয়ে আগস্টের শেষে জাতিসংঘ মহাসচিবের যুবদূত-বিষয়ক অফিস থেকে পাওয়া ই-মেইল আমাকে আনন্দের সাগরে ভাসাল! জানানো হলো, আমি বাংলাদেশ থেকে জাতিসংঘের তরুণ নেতা হিসেবে নির্বাচিত হয়েছি।
তখন ঘটনার শুরু। কারণ, আমি ভেবেছি, যুবদূত হিসেবে জাতিসংঘের কোনো আয়োজনে হয়তো আমাদের ডাকবে। তবে ৩১ আগস্ট যে ই-মেইল পেলাম, তা ছিল অকল্পনীয়। সেদিন জার্মানি থেকে দেশে ফিরছিলাম। আবুধাবিতে বসে দেশে ফেরার বিমানের অপেক্ষায় তখন। সেখানে বসেই ই-মেইল চেক করছিলাম। তখনই জানতে পারলাম, জাতিসংঘের ৭১তম সাধারণ অধিবেশন চলার সময় আমাকে নিউইয়র্কের পথ ধরতে হবে ১৭ সেপ্টেম্বর। কারণ, সাধারণ অধিবেশনে ১৮ থেকে ২১ সেপ্টেম্বর যুবদূতদের থাকতে হবে। হাতে তখন মাত্র দিন পনেরো সময়।
যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাওয়ার ঘটনাটি অনেকটা গল্পের মতো বলা যায়। যুবদূত হওয়ার জন্য সারা বিশ্ব থেকে ১৮ হাজারের বেশি আবেদন জমা পড়ে। পুরো নির্বাচন-প্রক্রিয়া শেষ করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে কর্তৃপক্ষের। যখন ভিসার জন্য আবেদন করি তখন হাতে ছিল মাত্র ১০ দিন। এর মধ্যে প্রায় পাঁচ দিন ছিল ঈদের ছুটি। ভিসা পাব কি না, তা নিয়ে শঙ্কায় ছিলাম। ১৭ সেপ্টেম্বর একবার মার্কিন দূতাবাসের ভিসা প্রদান সেন্টারে ফোন করলাম। অনেক কিছুর পর তাঁরা জানালেন, আমার পাসপোর্ট তাঁদের হাতে! অর্থাৎ আমার ভিসা হয়েছে। সেদিন দুপুর ১২টায় পাসপোর্ট সংগ্রহ করে রাতের ফ্লাইটে নিউইয়র্কের বিমানে উঠি।
নিউইয়র্কের দিনরাত
অধিবেশনে অংশ নেওয়ার আগেই আয়োজকেরা আমাদের নিয়ে ফেসবুকে একটি ক্লোজড গ্রুপ খোলেন। সেখানে এসডিজি ইয়াং লিডার হিসেবে আমরা যে ১৭ জন নির্বাচিত হয়েছি, তাঁদের সবাইকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। তবে তা ছিল ‘হাই-হ্যালো’ পর্যায়ে। কারণ, তখন আমরা সবাই ভ্রমণ পরিকল্পনা নিয়ে নিজেরা গোছগাছ করতেই বেশি ব্যস্ত ছিলাম। তখন ভাবতাম, নিউইয়র্কে যাওয়ার পর সবার সঙ্গে বেশ আড্ডা হবে, গল্প হবে। কিন্তু সেখানে পা রাখার পরই কঠিন হিসাবের মধ্যে সময় কাটাতে হলো। তাই নিজেদের মধ্যে খুব বেশি কথা বলার সুযোগ হয়নি।
সেখানে আমাদের দিন শুরু হতো সকাল ছয়টায়। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের বিভিন্ন সম্মেলনে আমাদের অংশ নিতে হতো। আমাদের কাজই ছিল অধিবেশনে যোগ দেওয়া বিশ্বনেতা, জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, শুভেচ্ছাদূতসহ আমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া। তাঁদের সঙ্গে মতবিনিময় করা। এ কাজ চলত সকালের নাশতার টেবিল থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত।
আমাদের সে কাজের শুরু ১৯ সেপ্টেম্বর সকাল থেকে। সেদিন গ্লোবাল গুড সামিটের মাধ্যমে সবার সামনে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। জাতিসংঘ মহাসচিবের যুবদূত আহমেদ আলহানডাউ আমাদের সবার নাম ঘোষণা করেন। সারা বিশ্ব থেকে আসা বিখ্যাত সব মানুষ তখন আমাদের দেখছেন। সে সময় দারুণ উত্তেজিত ছিলাম। এবারের অধিবেশনের অন্যতম আকর্ষণ ছিলাম কিন্তু আমরা এই ১৭ তরুণ। জাতিসংঘের সম্মানজনক আমন্ত্রণের ইতিহাসে এমন ঘটনা এবারই প্রথম।
দ্বিতীয় দিন, অর্থাৎ ২০ সেপ্টেম্বর আমরা নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে যাই। সেখানে আমাদের জন্য সকালের নাশতার আয়োজন ছিল। বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধান, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, সচিবসহ আরও সম্মানিত অতিথিদের সঙ্গে বসে আমরা নাশতা করি। শুধু নাশতা করেছি এমন নয়, তরুণ নেতৃত্ব ও এসডিজি বাস্তবায়ন নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়।
এর পরের পর্বটি ছিল বেশ মজার। আমাদের সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয় ‘ভিআইপি সোশ্যাল মিডিয়া জোনে’। সেখান থেকে ইনস্টাগ্রাম, স্নাপচ্যাট, ফেসবুক লাইভ, টুইটার ও মিরর ওয়েবে সরাসরি সম্প্রচার করে। বিশ্বখ্যাত ভ্যানিটি ফেয়ারআমাদের ছবি তুলে ইতালীয় ভাষায় তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশও করে। ছিল বিভিন্ন বিষয়ের ওপর কর্মশালা। ইউএনডিপিতে এক বছরের কৌশলগত পরিকল্পনা নিয়ে আমাদের কর্মশালা ছিল। তৃতীয় দিন আমরা ইউএনএফপিএ দপ্তরে কাজের অভিজ্ঞতা বিনিময় করি। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়েও কথা হয়।
ওই তিন দিনে আমার কথা বলার সুযোগ হয়েছে আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে, নেদারল্যান্ডস ও কেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী, ডেনমার্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি, জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থার প্রধান এবং তারকাদের সঙ্গে। নিঃসন্দেহে এই পরিচয়ের সুযোগ পাওয়াকে জীবনের সুন্দর মুহূর্তগুলোর একটি বলতেই হবে। তাঁদের সঙ্গে কথা বলার সময় তাঁরা আমাদের কাছে জানতে চেয়েছেন, আমরা কী ধরনের কাজ করি সেসব বিষয়ে। তবে ডেনমার্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দীর্ঘ সময় কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম।
যেকাজনির্বাচকদের নজর কাড়ে
ঢাকায় বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করার পাশাপাশি আমার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলায় প্রতিষ্ঠা করি এইচএ ডিজিটাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি ২০১৪ সালে চালু হলেও সেটার কাজ শুরু হয়েছিল বলা যায় ২০১১ সালে। তখনো আমার স্নাতক শেষ হয়নি। এরপর তো ভারতে চলে গেলাম। তবে স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য কাজের পরিকল্পনা থেমে থাকেনি। দেশে ফিরেই আমাদের পারিবারিক জমিতে স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করি। বেশ বড় অঙ্কের অর্থের প্রয়োজন ছিল সে সময়। তখন পরিবারের সদস্য ও এলাকার কয়েকজন মানুষ অনুদান দিয়ে আমার কাজকে এগিয়ে নেন। এমন ২৫ জন রয়েছেন যাঁরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদে আছেন।
স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রমে শুরুর দিকে বেশ সময় দিতে হয়েছে। তখন আমি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতাম। স্কুলে সময় দিতে হয় বলে সপ্তাহে শুধু দুদিন ক্লাস নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। বাকি দিনগুলো কাটাতাম স্কুলেই। এভাবে কয়েক মাস পার করার পর সবকিছু স্বাভাবিক নিয়মেই চলতে থাকে। এখন তো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, অভিভাবকসহ এলাকাবাসীও উদ্যোগী। এ ছাড়া খায়রুজ্জামান নামে এক চাচা সেখানকার পুরো বিষয়গুলোই দেখভাল করেন।
এসডিজি বিষয়ে সবাইকে জানানোর কাজটি শুরু করব আমার স্কুল থেকেই। জাতিসংঘের তরুণ নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই স্কুলের কাজটা বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। এ ছাড়া কমনওয়েলথ যুব পুরস্কার, জার্মানির গ্রিন লিডার পুরস্কারও নির্বাচকদের কাছে গুরুত্ব পেয়েছে। এদিকে গত বছর জাপানে এসডিজি নিয়েও গবেষণা করি। সেই গবেষণার কাজটিও তরুণ নেতাদের তালিকায় আমাকে জায়গা করে দিতে সহায়তা করেছে।
এখন আমাদের কাজ
ইয়াং লিডার হিসেবে আমাদের কাজ হবে নিজেদের প্রকল্পগুলো এগিয়ে নেওয়া। পাশাপাশি আমার কাজ হবে এসডিজি বাস্তবায়নে তরুণদের যুক্ত করা, উদ্বুদ্ধ করা। তবে আমাদের কাজের পরিধি শুধু আমাদের কমিউনিটি বা আমাদের দেশ নয়। জাতিসংঘ সদর দপ্তর থেকে আমাদের বিভিন্ন দেশে এসডিজি নিয়ে বিভিন্ন আয়োজনে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দেবে। এ ছাড়া আমরা একটি বা দুটি বিষয় নিয়ে কাজ করলেও কথা বলতে হবে এসডিজির ১৭টি বিষয়েই।
এখন আমরা এই ১৭ তরুণ হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুক গ্রুপে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করি। প্রত্যেকে নিজেদের কাজের আপডেট দিই। জাতীয় পর্যায়ে তাঁরা কেমন সাড়া পেয়েছেন, সেসব নিয়েই কথা হয়।