banner

বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 303 বার পঠিত

 

সানজিদার জয়ের গল্প

‘২০০৩ সালে পত্রিকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেখি। নারী শিক্ষকদের যোগ্যতা ন্যূনতম এসএসসি। এইচএসসি পাস আমার মনটা আনন্দে ভরে যায়। ভাশুর ও স্বামীর হাতে চাকরির দরখাস্ত দিতে থাকি। টানা ছয় বছর। কিন্তু কখনোই লিখিত পরীক্ষার প্রবেশপত্র পাইনি। এভাবে সন্দেহ হয়, তাঁরা হয়তো আমার আবেদন পোস্টই করেন না।’ কথাগুলো বলেন নারায়ণগঞ্জ বন্দর উপজেলার ৫৯ নম্বর বন্দর মোল্লাবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সানজিদা জামান। ২০১৩ সালে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য তাঁকে ‘জয়িতা’ সম্মাননা দেয়।

‘২০০৯ সালে নিজেই দরখাস্ত জমা দিই। পরীক্ষা দিয়ে ২০১০ সালে স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি। তবে এটা সহজ ছিল না। এর জন্য অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে।’ ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় ভীষণ আগ্রহ ছিল সানজিদার। মা-বাবাকে কখনো বলতে হয়নি, ‘পড়তে বসো।’ বাবা ছিলেন সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরের সার্জেন্ট। নিজে ‘বড়’ চিকিৎসক নন বলে স্বপ্ন দেখতেন মেয়ে দেশের নামকরা চিকিৎসক হবে। তা ছাড়া মা প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন বলে সানজিদার মধ্যেও চিকিৎসক হওয়ার বাসনা পোক্ত হতে থাকে।

বাবা সরকারি চাকরিজীবী হলেও তাঁর বেতন-ভাতা ছিল খুব কম। চার ছেলেমেয়ের সংসারে অভাব লেগেই ছিল। মা সংসারের চাহিদা মেটাতে দরজির কাজ করতেন। সানজিদা বলেন, ‘তখন আমি ঢাকা সেনানিবাসের শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী। মাকে একদিন বললাম, প্রাইভেট পড়া দরকার। মা কিছু না বলে খুব কেঁদেছিলেন। বুঝতে পারি সম্ভব নয়। সেদিন খুব খারাপ লেগেছিল।’ বাবা বদলি হলে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে চলে আসেন সানজিদা। কুমিল্লা ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে কিছুদিন ক্লাস করে চলে আসেন গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের বন্দরে। বাড়ি থেকে চার মাইল দূরের সোনাকান্দা উচ্চবিদ্যালয়ে ক্লাস করতে থাকেন। এক আত্মীয়ের পরামর্শে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই মা সানজিদাকে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ান। ‘মায়ের যুক্তি, সংসারে অভাব। তার ওপর মেয়েদের পড়াশোনা তাড়াতাড়ি শেষ হলেই ভালো। মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেও খুব খেটে পরীক্ষা দিই। ১৯৯৫ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে রেকর্ড নম্বর পেয়ে পাস করি।’ বলেন সানজিদা।

এখানেই শেষ নয়। সানজিদা বলেন, ‘ভাগ্য বলতে কিছু আছে, এটা আমি বিশ্বাস করি। তবে জীবনের মোড় এভাবে ঘুরে যাবে, তা ভাবতে পারিনি। ভুয়া রেজিস্ট্রেশনের জন্য আমার মতো কুমিল্লা বোর্ডের প্রায় হাজার পরীক্ষার্থীর ফলাফল স্থগিত করা হয়। বোর্ড পর্যন্ত গিয়ে ফলাফল জানতে পারি, রেকর্ড নম্বর পেয়েও আমি বিফল!’

দমকা হাওয়ার মতো এক নিমেষেই জীবনের লক্ষ্য, স্বপ্ন শেষ হয়ে যায়। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন সানজিদা। এক বছর বিরতি দিয়ে আবার ১৯৯৭ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেন। আবারও স্টার মার্কস পেয়ে পাস করি। কিন্তু ফলাফল প্রকাশের তিন মাসের মাথায় বিয়ে হয় সানজিদার।

‘একান্নবর্তী পরিবারের বউ আমি। বড় সংসার। জায়েরা আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। তাদের সন্তানেরা আমার সহপাঠী। বাড়ির বউ চাকরি করতে পারবে না, এমন মানসিকতার মধ্য দিয়ে গৃহিণী হয়ে দিন কাটাচ্ছি। কিন্তু ভেতরে-ভেতরে গুমরে মরি। রাতভর কান্না করি। পড়ার নেশা কাটেনি! আবার পড়ার উপায়ও নেই।’ বড় ভাশুরকে অনেক অনুরোধ করে অনিয়মিত ছাত্রী হিসেবে ভর্তি হন নারায়ণগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজে। কলেজে ভর্তি হলেও ক্লাস করা হয় না। দিনভর হাড়ভাঙা খাটুনি, ক্লান্ত শরীরে রাতে বারান্দায় পড়তে বসেন। পরিবারের শান্তি বজায় রাখতে প্রবাসে থাকা স্বামীর কাছেও নিজের ইচ্ছেগুলো প্রকাশ করতে পারতেন না সানজিদা।

এভাবেই বুঝে না বুঝে পড়াগুলো মুখস্থ করে কখনো গাইড বইয়ের সাহায্য নিয়ে দ্বিতীয় বিভাগে এইচএসসি পাস করেন তিনি। লেখাপড়া আবার স্থগিত! ‘তবে আমি থেমে থাকিনি। চেষ্টা করেছি কিছু একটা করতে। শেষ পর্যন্ত পেরেছি। এখন আমি দুই সন্তানের মা। তাদের পড়াশোনার পাশাপাশি আমিও লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছি। স্কুল কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে নারায়ণগঞ্জ সরকারি তোলারাম কলেজ থেকে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে ২০১৫ সালে বিএসএস পাস করি। এখন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করছি।’

শিক্ষকতার পাশাপাশি সানজিদা লেখালেখিও করেন। নিজেকে ‘জয়িতা’ পরিচয় দিতে গর্বে বুক ভরে ওঠে তাঁর। ছাত্রছাত্রীদের, অভিভাবকদের সব সময় বোঝান লেখাপড়ার গুরুত্ব।

Facebook Comments