১১ বছর বয়সী গৃহকর্মী আদুরি। নাম আদুরি হলেও ওর ভাগ্যে কখনো আদর জোটেনি। বরং কাজ করতে এসে নানা ধরনের অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। আদুরিকে ঠিকমতো খাবার দেওয়া হয়নি কখনো। মুখে আগুনের ছ্যাঁকা দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ইস্ত্রি দিয়েও গায়ে ছ্যাঁকা দেওয়া হয়েছে। গৃহকর্ত্রী নওরীন জাহান ব্লেড দিয়ে সারা শরীর কেটে দিয়েছেন। নানা ধরনের বীভৎস নির্যাতন করেও ক্ষান্ত হননি তিনি। একদিন মারতে মারতে আদুরিকে মৃত ভেবে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয়। রাজধানীর বারিধারা ডিওএইচএস এলাকার একটি ডাস্টবিন থেকে অর্ধমৃত অবস্থায় পাওয়া যায় আদুরিকে। এরপর হাসপাতালে নিলে দেখা যায়, লিকলিকে শরীরের আদুরির সারা গায়ে নির্যাতনের চিহ্ন। শরীরজুড়ে দগদগে ঘা। মাথার হাড়ে ফাটল। হাতে ব্যান্ডেজ। সূত্র: প্রথম আলো
পরিবার-নিজস্ব পরিবেশ ছেড়ে বেঁচে থাকার তাগিদে বহু শিশু ও নারী গৃহকর্মীর কাজ করেন। রাতদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হয় গৃহকর্ত্রীর মন জয় করতে। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই গৃহকর্মীদের ভাগ্যে জোটে নির্যাতন। কাজ একটু এদিক-সেদিক হলেই মারধর থেকে শুরু করে গরম খুন্তির ছ্যাঁকা, ধারালো ছুরি-ব্লেডের আঁচড় খেতে হয়। অনেকে আবার গৃহকর্মীকে ঠিকমতো খাবারও দেন না। এমনকি গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রী দুজনে মিলেই গৃহকর্মীর ওপর পাশবিক নির্যাতন চালান। এমনকি গৃহকর্মী হত্যার ঘটনাও কম ঘটে না।
বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) তথ্যানুযায়ী, সারা দেশে গত পাঁচ বছরে ১৮২ জন নির্যাতিত গৃহকর্মীর মৃত্যু ঘটেছে। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১৪৩ জন। এর মধ্যে ২০১৫ সালে মোট ৭৮ জন গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।
দুমুঠো খাবার আর পরিবারের খরচ জোগাতে নীলফামারী থেকে রংপুরে আসে গৃহকর্মী রেশমা (ছদ্মনাম)। ১২ বছর বয়সে যখন স্কুলে থাকার কথা, তখন কাজ নেয় রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার এক সরকারি কর্মকর্তার বাসায়। কিন্তু রেশমার সে বাসায় কাজ করা হয়ে ওঠেনি। পরিবারকেও কোনো সাহায্য করা হয়নি। বরং তাকে আশ্রয় নিতে হয়েছে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখান থেকে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে। কারণ, গৃহকর্মী হিসেবে কাজে যোগ দেওয়ার প্রথম দিন রাতেই গৃহকর্তা শিশুটির ওপর যৌন নির্যাতন চালান। এতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে যায় শিশুটি। সূত্র: প্রথম আলো
গৃহকর্মী নির্যাতনের এ রকম হাজারো উদাহরণ আছে। তবে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির ‘বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে গৃহকর্মীর ওপর নির্যাতনের ঘটনা কমেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ সালে মোট ৪৮ জন গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১৫ জনকে হত্যা করা হয়েছে এবং ১৬ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২০১৪ সালে সেখানে ১০৮ গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। অর্থাৎ ২০১৪ সালের তুলনায় গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা ৫৬ শতাংশ কমেছে।
এ বিষয়ে বিলসের মহাসচিব নজরুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, গৃহকর্মীর ওপর নির্যাতন হচ্ছেই। কারণ, গৃহকর্মী শ্রমিক হলেও তাঁদের শ্রমিক হিসেবে গণ্য করা হয় না। ফলে তাঁরা শ্রমিকের কোনো অধিকারই ভোগ করতে পারেন না। তাঁদের কোনো কর্মঘণ্টা নেই। ছুটি নেই। ঘুমানোর জায়গা নেই। ঠিকমতো বেতন পান না। আটকে রাখা হয়। আসলে তাঁরা খুবই মানবেতর জীবন যাপন করেন। এককথায় তাঁদের কর্মপরিবেশ যেমন অস্বাস্থ্যকর, তেমনি অনিরাপদ। ফলে কাজ করতে এসে তাঁরা শারীরিক নির্যাতন থেকে শুরু করে হত্যার শিকার পর্যন্ত হন।
সরকার ২০১৫ সালে গৃহকর্মীদের জন্য ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা’ অনুমোদন করেছে। এতে গৃহকর্ম শ্রম হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। গৃহকর্মীরা বিশ্রামসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাও পাবেন। গৃহকর্মীরা সবেতন চার মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি ছাড়াও অন্য ছুটি ভোগ করতে পারবেন। শ্রম আইন অনুসারে, ১৪ বছরের কম বয়সীদের গৃহকর্মী নিয়োগ প্রদানে বিধিনিষেধ মানতে হবে। গৃহকর্মীদের শ্রমঘণ্টা এবং বেতন আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করতে হবে।
এ বিষয়ে নজরুল ইসলাম খান বলেন, শুধু আইন করলেই হবে না, আইনের সঠিক প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন থাকতে হবে। গৃহকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে মূল্যায়ন করতে হবে।
নারী নির্যাতন প্রতিরোধে এবং শিশু সুরক্ষায় সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও গৃহকর্মীর প্রতি নির্যাতন ও সহিংসতার দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। বরং দিনকে দিন ভয়াবহতা ও নৃশংসতা বাড়ছে। এর কারণ হিসেবে নারীনেত্রী মালেকা বানু বলেন, সমাজের নেতিবাচক মানসিকতা গৃহকর্মীর ওপর সহিংসতার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। গৃহকর্মীর ওপর নির্যাতন কমাতে তাই দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। পাশাপাশি একটা আনুষ্ঠানিক নিয়মের মধ্য দিয়ে তাঁদের কাজে নিয়োগ দিতে হবে। শ্রমিক হিসেবে তাঁদের সব ধরনের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।