কর্মজীবী মায়ের সন্তান হিসাবে ছোটবেলায় প্রায়ই একটা কথা শুনতাম যে ইশ কি কষ্ট না, সারাদিন একা থাক, মাকে কাছে পাও না, এই রকম নানা আহা উহু। কিন্তু আমি আসলে কিছুতেই বুঝতে পারতাম না যে একা থাকলে সমস্যাটা ঠিক কোথায়? আমি তো দিব্য স্কুল থেকে এসে হোম ওয়ার্ক করে, বই পড়ে, পড়াশুনা করে নিজের মতনভাবে জীবন যাপন করছি। সময় মত ঘুম থেকে উঠছি, বা অন্যান্য সব করছি। আমার তো কোন সমস্যা হচ্ছে না বরং যখন যা দরকার নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে করছি, বইয়ে পড়ি যে নিজের কাজ নিজে করতে হয়, আমি ঠিক তাইই করছি। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? ঠিক কোন জায়গায়? আমার ক্লাস থ্রি থেকে সিক্স আব্বু সিঙ্গাপুরে ছিল, পোস্টিং ছিল তাঁর ওখানে আর আম্মার সরকারী চাকুরী সুবাদে আমরা বাংলাদেশে থাকতাম, মাঝেমধ্যে যেতাম সেখানে, কিন্তু কেউ কিন্ত আমাকে বলত না যে ইশ কি কষ্ট, বেচারা বাবার কাছ থেকে দূরে আছে ;-)। আমার প্রতি এই অহেতুক বেদনা প্রদর্শন আর আম্মার কাজকে অবহেলা করার জন্য আমি এই সকল আত্মীয়দের উপর খুব ই বিরক্ত হতাম। আর মনে মনে ভাবতাম এরা তো দেখি আমার চেয়েও ছোট, একা থাকতে পারে না, সারাক্ষণ মা দরকার এদের! তো যাই হোক যেটা বলছিলাম, স্কুলে বা কলেজে আমি কুইজ টিম রিপ্রেজেন্ট করতাম, এছাড়া গার্ল গাইড করতাম, সেখানে অনেক সময়ই নানা বিষয়ে প্রশ্ন আসলে বা মতামত দেয়ার হলে আমি বেশ ভালভাবে অংশ নিতে পারতাম। তো তখন অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করত কিভাবে এত কিছু জানা সম্ভব হল? বা সাহিত্যের জ্ঞান, সাধারন জ্ঞানের জন্য আমি কোন বিশেষ ট্রেনিং নেই কিনা বা এর জন্য আমি অন্য কিছু করি কিনা। আমি মনে মনে হাসতাম আর খুব শান্ত হয়ে বলতাম এর সিংহভাগ কৃতিত্ব আসলে আম্মার। তখন আবার সম্পূরক প্রশ্ন, তোমার মা না সারাদিন বাসায় থাকে না! তাহলে? আমিও মুখ টিপে হেসে জবাব দিতাম আম্মা বাসায় থাকলে আর জানা হত না, থাকেনা দেখেই না জানতে পারছি। ওরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যেত। আসলে আম্মা যখন অফিস থেকে আসত তখন প্রতিদিনের বই, ম্যাগাজিন, পত্রিকা কিছু না কিছু নিয়ে আসত। সিনেমা থেকে শুরু করে ক্রীড়া, অর্থনীতি থেকে শুরু করে বাংলা সাহিত্য, কোন কিছু বাদ নাই। আর আমার কাজ ছিল এই সব বাসায় একা থেকে মন দিয়ে পড়া আর পরের দিন আবার নতুন কিছুর জন্য অপেক্ষা করা। ফলে আমি খুব ছোটবেলায় সিনেমার জন্য আলাদা পত্রিকা আছে, ক্রীড়া জগতের কারা নক্ষত্র, তাদের নিয়ে লেখা , বা সমসাময়িক রাজনীতি সব জেনে যাই, এমন কি কেউ কেউ যে সংবাদ বিকৃত করার হীন চেষ্টা চালায় সেগুলো বুঝতেও কোন সমস্যা হত না, অথচ তখন আমার বয়স আক্ষরিক অর্থে বার বা তের! এছাড়াও আমি একদিন আগ্রহবশত গুনে দেখেছিলাম যে বাসায় ছোট-বড় সব মিলায় ডিকশনারি ছিল প্রায় আট থেকে দশটা। সবই আমার আম্মার অবদান। উচ্চারন-বানান-আঞ্চলিক কী নাই? আমার ভাষা নিয়ে মারাত্মক সংবেদনশিলতা আছে, তবে এমন যার শৈশব তাঁর ভাষার প্রতি এত স্পর্শকাতরতা না থাকার কি কোন যৌক্তিক কারণ আছে কি? ভাবা যায় আম্মু আমাকে বর্ণমালা শিখিয়েছেন ছড়ার ক্যাসেটের মাধ্যমে! সেটা সেই তিন দশক আগের কথা। তখন বাংলা একাডেমী থেকে ছড়ার ক্যাসেট পাওয়া যেত, আমাকে আম্মা ছয়টা ক্যাসেট কিনে দিয়েছিল, একটা সংখ্যার, একটা এবিসিডির, একটা স্বরবর্ণের, একটা ব্যাঞ্জন বর্ণের, আর বাকী দুইটা বাংলা ও ইংরেজি ছড়ার। ফলে সঠিক উচ্চারনে বাংলা শিখেছি আমি, অনেকের চেয়ে আগেই, অন্তত যারা আমাকে নিয়ে আহা-উহু করতে তাদের ছেলেমেয়েদের চেয়ে তো আগে বটেই। আম্মা আমাকে সব কিছু খাওয়ানোর অভ্যাস করিয়েছেন, কাটা মাছ থেকে কলার মোচা ঘণ্ট, সরিষা বাটা দিয়ে সাজনাসহ শক্ত চালের ভাত সব। শক্ত চালের ভাত এই জন্য বললাম যে জীবনে ভাত শক্ত একদিন হতেই পারে, প্রতিদিন সেটা ঠিক হবে না আর হয়ে গেলেও এতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় না, একটু কষ্ট করে খেয়ে নিতে হয়, এই শিক্ষাও আম্মার। আসলে আম্মা কর্মজীবী হওয়ার কারনে যে কত সুবিধা পেয়েছি বলার নয়। শুধু আর্থিক ভাবে যে তা নয়, মানসিক সাপোর্ট এবং যে কোন সমস্যার বাস্তব সমস্যা সমাধানে আম্মার কোন জুড়ি ছিল না। আম্মু …স্কুলের এই ফর্ম ফিল আপ করব কি করে? ঠিক মত দরখাস্ত ভাঁজ কিভাবে করে? কোন কাজে কি ধরনের খাম ব্যবহার করতে হয়? কাগজপত্র বিভিন্ন ফাইলে গুছায় রাখতে হয় কিভাবে? আম্মু ব্যাঙ্ক একাউন্ট করে কি করে? আম্মু অফিসিয়াল চিঠি কেমন করে লেখা? আম্মু এই কবিতার বই লাগবে… আম্মু অফিস থেকে আসার সময় আমার জন্য অমুক দোকানের চানাচুর নিজে দাড়ায় থেকে বানায় নিয়ে আসবা, বা আমি বাসায় পিজা বানাব, বইয়ে পড়েছি যে এর জন্য ইস্ট চাই, সেটা কোথায় পাব? আম্মু হয়ত বলল নিজেই গিয়ে নিয়ে আস, দেখ সাবধানে রাস্তা পার হবা, একা একা কাজ করতে শিখ। এই সবই আম্মা হাতে ধরে শিখিয়েছেন। আবার স্কুলে স্ক্র্যাপবুক বানাতে হবে, আমার তো //আমার মা সব জানে// এই সুবিধা আছেই, তাই আম্মুর কাছেই প্রশ্ন স্ক্র্যাপ বই কোথায় পাওয়া যায় ? স্ট্যাম্প জমাচ্ছি , স্ট্যাম্প এ্যালবাম কিনে দাও, নিচে খেলার জন্য ভালো ব্যডমিন্টন কর্ক এনে দাও ইত্যাদি নানান কিছু আছে যেগুলো আমি এখন বুঝি যে শুধু আম্মা চাকুরি করত দেখেই এই ব্যবহারিক জ্ঞান ধারন করত, নতুনা কোনভাবেই সম্ভব নয়। এখনও যে কোন কিছু খুজে বের করতে , কিনতে যে আমার তেমন কোন সমস্যা হয় না , কাউকে জিজ্ঞেস করা লাগে না সেটা আম্মার কারনেই। কাপড়ের যত্ন নেয়া কাকে বলে সেটাও আম্মার কাছ থেকেই শেখা, সিল্কের কাপড়ের জন্য আলাদা ওয়াশিং পাওডার হয়, সেটা নিউমার্কেটের পিছনে একটা দোকান আছে সেখানে পাওয়া যায় ( নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা বলছি, তখন সুপারশপ হয় নাই)। আবার শীতের কাপড়ের ভাজে ভাঁজে নিম পাতা দিয়ে রাখলে সেগুলো ভাল থাকে এই তথ্যও আম্মু জানিয়েছেন। শুধু যে আম্মা আমার একজন মেন্টর হিসাবে কাজ করেছেন তা নয়, চাচাত-ফুফাত-মামাত-খালাত ভাই-বোন যে যখন আম্মার কাছে হেল্প চেয়েছে আম্মা সাধ্যের মধ্যে যতটুকু পারতেন করেছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা আম্মা করেছেন আসলে আমি যখন সিক্স থেকে সেভেন এ উঠি তখন, এর আগ পর্যন্ত আমি পড়াশুনা করেছি রীতিমত খেলার ছলে, ইচ্ছা হলে পড়েছি না হলে নাই, কিন্তু আম্মু প্রেশার দেন নাই, তাঁর কথা, আগে দেখি ওর আগ্রহ বা দুর্বলতা কোথায়? আগে বেসিকটা ঠিক হতে হবে। অন্য অনেকের অভিভাবকেরা যখন কেন বাংলায় এক নম্বর কম পেল এই নিয়ে পেরেশান আম্মা তখন আমার ঔষধ, ওষুধ আর অষুধের পার্থক্য বুঝাচ্ছেন! ক্লাস সেভেনে উঠার আগ দিয়ে তাঁর মনে হল যে এখন একটু অঙ্কে জোর দেয়া দরকার, কারন এখন বীজগনিত শুরু হবে, এখন ভিত্তি শক্ত না হলে পরে ও বিপদে পড়বে, এমনিতে পাটীগনিত তো খারাপ পারে না ও, বীজগণিতও ভাল করে পারুক। তো আমার এক ভাইয়াকে বললেন একটু দেখানোর জন্য, প্রেশার দেয়ার দরকার নাই। আর আমি এই নতুন এবিসি (!) দিয়ে লেখা গনিতে এত আনন্দ পেলাম যে কিছুদিনের মধ্যেই আমার বীজগনিতের প্রতি মারাত্মক মায়া জন্মে গেল। সেই মায়া এমনই প্রবল হল আর কাটলই না, পদার্থ বিজ্ঞান যে পরে পড়েছি সেটার কারনও ছিল আম্মার সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ, আমার কোনদিকে পারদর্শিতা ছিল সেটা তিনি ধরতে পেরেছিলেন। মাকে ছোটবেলায় চাকুরি করতে দেখেছি বলেই হয়ত আমি মারাত্মক কাজপাগল, কাজ ছাড়া আমি এক মুহূর্ত থাকতে পারি না, অন্তত যেটা আমার ভাল লাগে আমি সেইটুকু করতে চাই। এই চাই বলেই হয়ত নিজের কর্মজীবন পনের বছর হয়ে গেল দেখতে দেখতেই। আম্মার কথা অনুযায়ী কোন কাজই ছোট নয় এটা শুনে টিউশনি দিয়ে শুরু করা, পড়াশুনার পাশাপাশি চার বছর চাকুরি করা, তারপর শিক্ষকতা শুরু করে বিদেশে পড়তে যাওয়া, বেশ দ্রুত ও কোন ঝামেলা ছাড়াই পিএইচডি করে ফেলা, পরে আবার দেশে ফিরে চাকুরি করা, সঙ্গে সংসার করা ও ব্যবসা আরম্ভ করা সব কিছুই তো হয়ে যাচ্ছে বেশ আনায়াসেই। আর এখন যখন সেই আত্মীয় বা প্রতিবেশী বা অন্যরা আগের সেই যুক্তিই দিয়ে যাচ্ছে মা বাসায় না থাকলে বা চাকুরী করলে ছেলে-মেয়ে বখে যাবে, নষ্ট হবে তখন নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করি আমি আসলে কি তাহলে ব্যতিক্রম? না উনাদের বুদ্ধির লেভেল……থাক আর বললাম না, তবে আমার ছোটবেলায় নেয়া সিদ্ধান্ত কোনভাবেই তো এরা পরিবর্তন করতে পারলনা… কি আর করা, সবাই সব কিছু পারে না, মা লাগে এদের সব সময়!
কর্মজীবী মায়ের সন্তান কি শুধু কষ্টেই থাকে?
Facebook Comments