অপরাজিতাবিডি ডটকম: একজন নারীকে ঘরে-বাইরে হাজারো দায়িত্ব পালন করতে হয়, দিতে হয় পুরুষের চেয়ে বেশি শ্রম এবং সময়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে এই দিকটি।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ি এলাকায় বসবাসরত গৃহিণী সালমা আক্তারের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, ভোরে ঘুম থেকে উঠে শুরু হয় তার কর্মজীবন। ঘরে সবার জন্য পছন্দসই নাশতা তৈরি, স্বামীর অফিসে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তদারকি, সন্তানদের স্কুলে পৌঁছে দেওয়া আবার নিয়ে আসা, বাজার করা, রান্না করা, স্বামী-সন্তানরা বাড়ি ফিরলে তাদের তদারকি করা, কাজের শেষ নেই তার। এগুলো প্রতিদিনকার রুটিন। এর ভেতর আবার তাকে যেতে হচ্ছে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে, বিয়ে ও জন্মদিনের পার্টিতে, সন্তানদের স্কুলের নানা আয়োজনে। শুক্র, শনিসহ কোনোদিনই তার ছুটি নেই ঘরের কাজ থেকে। সবকিছু গুছিয়ে হাসিমুখে সবার চাহিদা পূরণ করে যাচ্ছেন তিনি।
অন্যদিকে একজন চাকরিজীবী নারীর দিনও একইভাবে শুরু হয়। রাজধানীর খিলগাঁও বসবাসরত কর্মজীবী নারী তানজিলা খাতুন জানান, সংসারের সব দায়িত্ব পালন করে তবেই তাকে যেতে হচ্ছে কর্মস্থলে। সেখানে গিয়েও তার নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় নেই। ঘরে ছেলেমেয়েরা কী করছে, গৃহকর্মী ঠিকমতো কাজগুলো করছে কি-না সে টেনশন তো থাকেই। সবশেষে ক্লান্ত হয়ে যখন ঘরে ফেরেন তখনও ব্যস্ত সময় কাটাতে হয় তাকে। এ রকম সালমা আক্তার, তানজিলা খাতুনের মতো প্রায় প্রতিটি নারীকেই শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাতে হয়।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের গার্ল পাওয়ার প্রজেক্টের কমিউনিকেশনস কো-অর্ডিনেটর শেখ সারাহজিন আহমেদ বলেন, বর্তমানে নারীরা চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা কাজে বাইরে যাচ্ছে। পাশাপাশি তাদের ঘরের দায়িত্বও পালন করতে হচ্ছে। যেখানে উন্নত বিশ্বে নারী-পুরুষ ঘরে-বাইরে সমানভাবে কাজ করছেন সেখানে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটটা ভিন্ন। এখানে সে অর্থে নারীরা পুরুষের তুলনায় বেশি পরিশ্রমী। সারাহজিনের মতে, এ দেশের নারীদের মস্তিষ্ক ঘুমের মধ্যেও কাজ করে_ সকালে উঠে কী নাশতা তৈরি হবে, ক’টায় বাসা থেকে বের হবে ইত্যাদি পরিকল্পনা। অফিস থেকে বাসায় ফেরার পর একজন পুরুষ যেখানে টিভি দেখে, চা খায়, নিচে হাঁটতে যায়, সেখানে একজন নারীকে বাসায় ফেরার পর ব্যস্ত থাকতে রান্নাবান্না কিংবা ছেলেমেয়ের পড়াশোনা নিয়ে। পাশাপাশি পরের দিনটির কথাও ভাবতে হয় তাকে। প্রকৃতপক্ষে একজন নারীর জীবনে বিশ্রাম বলে কিছু নেই।
প্রথমবারের মতো ২০১৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) কর্তৃক প্রকাশিত জরিপে স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে, বাংলাদেশে পুরুষের চেয়ে নারীরাই বেশি পরিশ্রমী। কর্মে নিয়োজিত একজন পুরুষ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অর্থের বিনিময়ে ৬ ঘণ্টা ৫৪ মিনিট কাজ করেন। আর নারীরা পাঁচ ঘণ্টা ১২ মিনিট কাজ করেন। তবে কর্মজীবী নারীরা গৃহস্থালির কাজে পুরুষের চেয়ে তিন গুণ বেশি সময় দেন। এ ক্ষেত্রে পুরুষ ১ ঘণ্টা ২৪ মিনিট আর নারীরা ৩ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট ব্যয় করেন। অন্যদিকে বেকার পুরুষরা গৃহস্থালির কাজে মাত্র ১ ঘণ্টা ১২ মিনিট ব্যয় করেন। আর পুরুষের চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি সময় দেন বেকার নারীরা। নারীরা ৬ ঘণ্টা ১২ মিনিট বাসার কাজ করেন। আবার বেকার পুরুষরা বেকার নারীদের চেয়ে অবসর ও বিনোদনে প্রায় দ্বিগুণ সময় ব্যয় করেন।
শহরাঞ্চলের পেশাজীবী নারীরা সবচেয়ে কম অবসর পান। তারা দৈনিক গড়ে ৫ ঘণ্টা ১২ মিনিট চাকরিস্থলে কাজ করে বাসায় এসে মাত্র ৫৪ মিনিট অবসর পান। কেননা, বাসায় এসে তারা পৌনে চার ঘণ্টা গৃহস্থালির কাজ করেন। আর একই পেশার পুরুষরা পৌনে ৯ ঘণ্টা কাজ করে কর্মস্থল থেকে ফিরে মাত্র ৫৪ মিনিট গৃহস্থালির কাজে সময় দেন।
অন্যদিকে গ্রামের পেশাজীবী নারীরা প্রতিদিন ৩ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট কাজ করেন, পুরুষরা করেন মাত্র দেড় ঘণ্টা। শহরে পেশাজীবী নারীরা বাসার কাজ করেন ৩ ঘণ্টা, পুরুষরা করেন মাত্র ১ ঘণ্টা।
জরিপ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবা নাসরীন বলেন, নিঃসন্দেহে জাতির জন্য এটি একটি ইতিবাচক দিক। তিনি মনে করেন, বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে তৃণমূল থেকে উচ্চপর্যায়ে নারীর শ্রমকে ভাগ করে নেওয়ার মতো মানসিকতা এখনও পুরুষের তৈরি হয়নি। যদিও বর্তমানে তারা নারীদের সহযোগিতা করছে, তবে তা গৃহস্থালির কাজে নয়। সে ক্ষেত্রে পুরুষের যেমন উচিত ঘরে-বাইরে নানা কাজে নারীকে সহযোগিতার করা পাশাপাশি একজন নারীরও প্রয়োজন তাকে সংসারের সব কাজ একাই করতে হবে এমন ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে আসা।
প্রতিবেদক-অপরাজিতাবিডি ডটকম