রমজানে সৃষ্টিকর্তার অপরিমেয় রহমত থেকে বঞ্চিত হতে রাজি নন কোনো ধর্মপ্রাণ মুসলিম। শত কষ্টের পরেও রোজা রাখার নিয়ত করেন আপন মনে। চরম বিপর্যস্ত বিপাকীয় তন্ত্রের অধিকারী ডায়াবেটিক রোগীরাও বাদ যান না সে নিয়ত থেকে। প্রচণ্ড ধর্মীয় আবেগ আর আগ্রহের কারণে তারা রোজা রাখতে চান। তবে দীর্ঘসময় না খেয়ে থাকলে শারীরিক কিছু সমস্যা হতে পারে। তাই রোজা রাখার কারণে সম্ভাব্য সমস্যা ও প্রতিকার সম্পর্কে আগেই জেনে নিতে হবে।
রক্তে গ্লুকোজ কমতে পারে
খাদ্য গ্রহণে দীর্ঘসময় বিরত থাকলে রক্তের গ্লুকোজের পরিমাণ কমতে থাকে। রোজা রাখা অবস্থায় টাইপ-১ ডায়াবেটিক রোগীর রক্তের গ্লুকোজের পরিমাণ কমে যাওয়ার আশঙ্কা ৪.৭ গুণ এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিকের ক্ষেত্রে ৭.৫ গুণ বেশি থাকে।
রক্তে গ্লুকোজ বেড়ে যেতে পারে
রোজা রাখার কারণে টাইপ-১ ও টাইপ-২ উভয় ধরনের ডায়াবেটিক রোগীর ক্ষেত্রেই রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যাওয়ারও কিছুটা ঝুঁকি থাকে। তবে টাইপ-১ ডায়াবেটিক রোগীর ক্ষেত্রে তা মারাত্মক হতে পারে। কারো কারো ক্ষেত্রে এ থেকে জীবননাশের ঘটনাও ঘটতে পারে।
ডায়াবেটিক কিটোঅ্যাসিডোসিস
টাইপ-১ ডায়াবেটিক রোগীরা বেশ কিছু ক্ষেত্রে রক্তের গ্লুকোজ মারাত্মকভাবে বেড়ে যায়। বিশেষ করে অনিয়ন্ত্রিত ডায়বেটিক রোগীর ক্ষেত্রে এধরনের সমস্যা বেশি হয়।
পানিশূন্যতা
দীর্ঘ সময় পানি বা পানীয় খাদ্য গ্রহণে বিরত থাকার কারণে শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। গরম ও বেশি আদ্র আবহাওয়ায় পানিশূন্যতা আরও প্রকট হতে পারে। যাদের রোজা রেখে কঠোর শারীরিক শ্রম দিতে হয় তাদেরও পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। তাছাড়া, রক্তে বেশি মাত্রায় গ্লুকোজ থাকলে শরীর থেকে পানি ও খনিজ পদার্থ বের হয়ে যাওয়ার হার অনেক বেড়ে যায়। ডায়াবেটিসের কারণে স্নায়ুবিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
প্রতিকারের উপায়
ঘন ঘন রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা দেখতে হবে। প্রতিদিন কমপক্ষে তিনবার রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা দেখতে হবে। টাইপ ১ ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে খুব সতর্কতার সঙ্গে রক্তের গ্লুকোজ লক্ষ্য রাখতে হবে।
প্রতিদিনের খাদ্যের পুষ্টিমান অন্যান্য সময়ের মতোই রাখার চেষ্টা করতে হবে। স্বাভাবিক দৈহিক ওজন ধরে রাখার ব্যবস্থা রাখতে হবে। গবেষণায় দেখা যায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ ডায়াবেটিক রোগীর দৈহিক ওজন কমে বা বাড়ে। ইফতারে চর্বি সমৃদ্ধ খাদ্য এবং তেলে ভাজা খাবার গ্রহণ করা হতে যতটা সম্ভব বিরত থাকতে হবে। দ্রুত হজম হয় এমন খাবার খাওয়া উপযোগী। ডায়াবেটিক রোগীর ইফতারের পর পরই খুব দ্রুত রক্তে গ্লুকোজ সরবরাহ করার ব্যবস্থা করতে হবে। ডায়াবেটিক রোগীর প্রচুর পানি পান করা এবং তরল জাতীয় খাবার খাওয়া উচিৎ।
শারীরিক শ্রম বা ব্যায়াম স্বাভাবিক শারীরিক কর্মকাণ্ড চালানো যেতে পারে এ সময়। তবে খুব বেশি কঠোর শ্রম বা ব্যায়াম না করাই ভালো। এতে করে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে। বিকেল বেলায় একদমই কঠোর শ্রম করা যাবে না।
প্রতিটি ডায়বেটিক রোজাদারের শরীরে হাইপোগ্লাইসেমিয়ার কোনো লক্ষণ দিলেই দ্রুত গ্লুকোজ, চিনি, মিষ্টি জাতীয় খাদ্য বা শরবত খেয়ে নিতে হবে। অতীত অভিজ্ঞতা থাকলে হাইপোগ্লাইসেমিয়ার লক্ষণ খুব সহজেই বোঝা যায়। যাদের তেমন অভিজ্ঞতা হয়নি, তারা বুক বড়ধড়ফড়ানি, মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগা, ঘাম হওয়া, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, চোখে অন্ধকার দেখা, মাথা ঘোরা ইত্যাদির এক বা একাধিক লক্ষণ দেখলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
যেসব ডায়াবেটিক রোগী সব ঝুঁকির কথা জেনেও রোজা রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, তাদের রোজা শুরুর কমপক্ষে ১ মাস আগে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিতে হবে। এর মধ্যে আছে খালি পেটে ও খাবার ২ ঘণ্টা পর মোট ৬ বার রক্তের গ্লুকোজ, খালি পেটে রক্তের লিপিড, লিভার, কিডনি ও হৃদপিণ্ডের কার্যকারিতার পরীক্ষা এবং এইচবিএ১ সি ইত্যাদি পরীক্ষা করে নিতে হবে।
ডায়াবেটিক রোগী রোজা রাখার সময় খাবার দাবারে সবচেয়ে বেশি সতর্ক থাকতে হবে।
– সময় শেষ হওয়ার অল্প কিছুক্ষণ আগে সেহরি খেতে হবে।
– ইফতারের সময় মিষ্টি ও চর্বি জাতীয় খাবার পরিমিত খাওয়া ভালো।
– ডায়াবেটিক রোগীদের পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি ও পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। এতে তাদের দেহ পানিশূন্যতার হাত থেকে রক্ষা পান।
– ফলমূল, শাকসবজি, ডাল, ডাবের পানি ও টক দই খেতে পারেন। ভাজা পোড়া খাবার যেমন- পেঁয়াজু, বেগুনি, পুরি, পরোটা কাবাব খেলেও খুব অল্প পরিমাণে খেতে হবে।
– রমজানের আগে যে পরিমাণ ক্যালরি যুক্ত খাবার খেতেন রমজানে ক্যালরির পরিমাণ ঠিক রেখে খাবার খাবার খেতে হবে।