সুদীর্ঘকাল ধরে নারীরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নানা বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হয়েছেন নারী। প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে সংগ্রাম করে নিজ যোগ্যতাবলে একটু একটু করে নারীকে অধিকার আদায় করে নিতে হচ্ছে। তবে নারী ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন রুখে দিতে যোগ হচ্ছে নতুন কৌশল।
নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের দীর্ঘ ইতিহাস। ঘটনার শুরু ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে নারীর মজুরি বৈষম্য, শ্রমঘণ্টা ১২ ঘণ্টা কমিয়ে ৮ ঘণ্টা করার দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের সুতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা। তার তিন বছর পর ১৮৬০ সালের একই দিনে গঠন করা হয় ‘নারী শ্রমিক ইউনিয়ন’।
একটা সময় ছিল নারীরা নিজেদের সুবিধা-অসুবিধার কথা জানাতে পারতেন না। সে সময় নারীরা নিজের কোনো বিষয়ে মতামত দিতে পারতেন না। পরিবারের চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্তই মেনে নিতে হতো তাদের। এমনকি কর্মক্ষেত্রে নারীরা সমান পরিশ্রম করেও সমান মজুরিতে ছিল বৈষম্য।
নারীর অবস্থান অনেকটা পরিবর্তিত হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশ্বে প্রতিটি দেশে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নারীরা পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যোগ্যতার প্রমাণ করে যাচ্ছে।
তবে পরিবর্তনের এ প্রেক্ষাপটে নারীর প্রতি সহিংসতা বা নির্যাতন বন্ধ নেই। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের চেষ্টা করে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তবে পদক্ষেপ নিলেও তার বাস্তবায়নে ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে।
মহিলা পরিষদের এক জরিপে দেখা গেছে, ২০১৫ সালে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৪ হাজার ৪৩৬টি। ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে। ২০১৫ সালে ১ হাজার ৯২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। যৌন নির্যাতন, বাল্যবিবাহ, নারীর আত্মহত্যা, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন অত্যাধুনিক যুগেও নারীর প্রতি এ ধরনের বর্বর নির্যাতনগুলো হচ্ছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম দীর্ঘদিন ধরে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল, নারীর সমঅধিকারভিত্তিক সমাজ গড়ার কাজে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন।
বাংলাদেশে বর্তমান নারী অবস্থান ও দীর্ঘ নারী আন্দোলনের ফলাফল সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আজকে যে পাহাড়ে উঠছে, ভার উত্তোলন করছে। সমাজ-সংসার ও কৃষিতে অবদান রাখছে, এসব ১০০ বছরের নারী আন্দোলনের ফল। শুধু আমরা নই, আমাদের পূর্বসূরি বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামালসহ অনেক নারীর অবদান। বর্তমানে সাড়ে ৪ হাজার নারী পুলিশে কাজ করছে। এগুলো শতাব্দীর নারী আন্দোলনের ফল। সুতরাং ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগোচ্ছে নারী।’
পুরুষ-নারী উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানো গেলে এ অগ্রযাত্রা আরও হবে বলে জানান তিনি। পলিসি মেকিংয়ে নারীর আবদান রাখার সুযোগ দিতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বড় বড় পদে দরকার নারীর আরও প্রবেশ করা দরকার। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতারা ভূমিকা রাখতে পারে। তারা নারীকে সুযোগ করে দিতে পারে।’
মানবাধিকার বিষয়ক আইনজীবী ও নারীনেত্রী এলিনা খান বলেন, ‘স্বাধীনতার আগে বা তারও আগে নারীরা ঘরে বন্দি ছিল, বাইরে আসতে পারত না। পড়াশোনা করতে পারত না, শারীরিক-মানসিক সমস্যার সমুখীন হয়েছে। এখন বাইরে আসার সুযোগ হয়েছে। কাজ করার সুযোগ হয়েছে। তবে নির্যাতনের জায়গায় নতুন নতুন কৌশল যোগ হয়েছে।
‘আগের থেকে নারীরা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও কথা বলার স্বাধীনতা পেয়েছে। তবে নির্যাতনের চিত্র থেকে বেরোতে পারেনি। আগে নারীরা ভোগ বিলাসের শিকার হতো মুষ্টিমেয় লোকের হাতে। এখন ঘরেবাইরে সবখানে নারীরা রেপের শিকার হচ্ছে।’
তিনি বলেন, এখনও অনেক নারী নিজেই নিজের সম্মান বিকিয়ে দেন। একটা সংসারে একজন নারী আরেকজন নারীকে সম্মান করেন না। নারীদের সম্মান করার বিষয়টি পরিবার থেকে শেখানো দরকার। ঘর স্কুল থেকে দুজনকেই নারীকে সম্মান করা শেখাতে হবে। সন্তানদের শেখাতে হবে। সেই সঙ্গে অধিকারও দিতে হবে।’
এলিনা খান বলেন, ‘আজকাল নারীরা সমধিকারের কথা বললে বাসে বা বিভিন্ন জায়গা শুনতে হয়, আপনারা সব জায়গায় সম অধিকার চান, তাহলে আলাদা সিট আলাদা, আলাদা পরিবেশ চান কেন? তাদের বলতে চাই, সমঅধিকার চাওয়া মানে এই নয় যে তুমি আমাকে প্রাপ্য সম্মানটুকু দেবে না। সম-অধিকার মানে অধিকারের সঙ্গে সম্মানটুকু দেয়া। আমার আলাদা সিট সেদিন লাগবে না, যেদিন কোনো ছেলে পাশে বসলে কোনো মেয়েকে টিজ করবে না, কুৎসিত দৃষ্টিতে তাকাবে না।’
নির্যাতনের পর নারীরা সুষ্ঠু বিচার পাচ্ছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি নির্যাতনের পর একজন নারী থানায় গেলে তাকে দিয়ে মিথ্যা মামলা করানো হচ্ছে। সে জানে না কোন মামলাটি করলে সে সঠিক বিচার পাবে। এ ক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি, পুলিশের চাপে মিথা মামলা করছে। আবার মামলা হলেও দীর্ঘসূত্রিতার কারণে সঠিক বিচার পাচ্ছে না।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের শিল্প ও কৃষি ক্ষেত্রে প্রায় ৮০ শতাংশ নারী নিয়োজিত আছে। কিন্তু কৃষিখাতে নিয়োজিত নারীর মধ্যে প্রায় ৯৪.৮ শতাংশ নারীই বিনাশ্রমে কাজ করে। অন্যদিকে শিল্পখাতেও নারী পুরুষের চেয়ে কম মজুরি পেয়ে থাকে। এ ছাড়া পোশাক খাতে মোট শ্রমিকের ৮০ শতাংশই নারী। এ খাতে নারী শ্রমিকদের অবদান বেশি থাকলেও এখানেই সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার নারী। পোশাক খাতে বেশিরভাগ নারীই শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। উঁচুস্তরে নারীর অংশ্রগ্রহণ হাতেগোনা।