স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর সরকার বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকজনকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়েছে। সরকারের গেজেট তালিকা অনুযায়ী, সারা দেশে প্রথম দফায় ৪১ জনের মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ১১ জন রয়েছে। কিন্তু গত সাড়ে পাঁচ মাসেও কোনো অনুদান, ভাতা বা সম্মানী তাঁরা পাননি। ফলে স্বীকৃতি পেয়ে যে আনন্দ তাঁরা পেয়েছিলেন, অব্যাহত কষ্টে তা ম্লান হয়ে যাচ্ছে।
বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জেলার গোমস্তাপুর উপজেলার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের রাবিয়া বেগম, হাসনা বেগম, জলো বেগম, সফেদা বেগম, আয়েশা বেগম, রেনু বেগম, হাজেরা বেগম, আরবী বেগম, রাহেলা বেগমসহ সদরের লিলি বেগম ও শিবগঞ্জের মালেকা বেগম স্বীকৃতি পেয়েছেন। এই বীরাঙ্গনাদের মধ্যে ৯ জনই বোয়ালিয়া ইউনিয়নের।
এ ইউনিয়নের নরশিয়া, চকমজুমদার ও সাহাপুরে পাকিস্তানি বাহিনী এবং রাজাকাররা হত্যা, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া ও সম্ভ্রমহানির ঘটনা ঘটায় বেশি। এ এলাকায় সম্ভ্রম হারানোর সংখ্যা কয়েক শ। অনেকে লজ্জায় ভয়ে মুখ খোলেনি আজও।
গত বছরের ১২ অক্টোবর সরকার এ-সংক্রান্ত গেজেট তালিকাটি প্রকাশ করে। গত মঙ্গলবার সরেজমিনে গেলে হাজেরা বেওয়ার সন্তান কেতাউর রহমান ও রাবেয়া বেওয়ার সন্তান নাসিম বলেন, ‘গত বিজয় দিবসে জেলা প্রশাসক আমাদের মাসহ বোয়ালিয়ার সাত বীরাঙ্গনা মাকে একটি করে শাড়ি, একটি তোয়ালে ও একটি চাদর দিয়েছিলেন। ঘর করার জন্য টিন দিতে চেয়েছিলেন। তাঁদের পরামর্শে স্থানীয় সোনালী ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। কোনো টাকা আসেনি ব্যাংকে, টিনও পাননি কেউ।’
তাঁরা জানান, বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে পরের জমিতে কোনো মতে খুপরি চালা তুলে বসবাস করছেন। তাঁদের সংসার চলে জমিতে ধান কুড়িয়ে, ঝিয়ের কাজ ও ভিক্ষা করে। কেউ কেউ দিন যাপন ও বাস করছেন ছেলে-মেয়ে বা মেয়ে জামাইয়ের দয়ায়। বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হাসনা বেওয়ার ভিক্ষা করে সংসার চলে। বাড়ি করার জন্য দ্রুত জমি, টিন ও ভাতা দেওয়ার জোর দাবি জানান তিনি।
মালেকা বেগমের সাত সন্তান। কিন্তু থাকেন ননদের জমিতে খুপরি চালায়। ছেলেরা দেখে না। তাই চেয়েচিন্তে চলে চার মেয়ে ও তাঁর। এক টুকরা জায়গা ও একটি ঘরের দাবি তাঁর। রাহেলা বেগমের এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলের নিজ সংসারেই টানাটানি। মাকে দিতে পারেন না খরচ। তাই মেয়ে ও পরের বাড়িতে কাজ করে ও ধান কুড়িয়ে চলে সংসার। বোয়ালিয়া এলাকায় একাত্তরের ২২ নভেম্বর ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বেনজির আহমেদ বলেন, ‘স্থানীয় রহনপুরে এবি উচ্চ বিদ্যালয়ে স্থাপিত পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের ক্যাম্প ছিল। তারা নরশিয়া, চকমজুমদার ও সাহাপুর এলাকায় নেমে ১৭ মুক্তিযোদ্ধা ও ১৮ জন নিরীহ মানুষকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। বহু নারীর সম্ভ্রমহানি করে তারা, যা আজও ভুলতে পারেননি সম্ভ্রম হারানো ও শহীদদের স্বজনরা।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘অস্ত্রহাতে যুদ্ধ না করলেও এসব বীরাঙ্গনা আমাদের মতোই বীর। লোকলজ্জা আর ধর্মীয় গোঁড়ামির শিকার এসব নারী মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক।’ এ বিষয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি নতুন এসেছি। আপনার মাধ্যমে জানলাম, তাঁদের আশ্বস্ত করা টিন দেওয়া হয়নি। এক সপ্তাহের মধ্যে এসব বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার জন্য টিন পৌঁছে দেওয়া হবে। ভাতা পাওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে জানানো হবে।’
Facebook Comments