banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 770 বার পঠিত

 

আজ ৭ই এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস।

আজ ৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য খাদ্য নিরাপত্তা বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি (নিরাপদ পুষ্টিকর খাবার, সুস্থ জীবনের অঙ্গীকার)। খুব যুক্তিসঙ্গত কারণেই এ প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। কারণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী, খাবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রোগগুলো এবং মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক দিকগুলো নিয়ে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে। এ বছরের প্রতিপাদ্য অনুযায়ী প্রতিটি দেশে নিরাপদ খাদ্য সংগ্রহ, সরবরাহ ও গ্রহণ নিশ্চিত করে নিরাপদ থাকার ওপরই বিশেষভাবে জোর দেয়া হচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ইউরোপের ৩০ শতাংশ খাদ্যে বিষক্রিয়ার ঘটনা ঘটে বাসায় তৈরি খাবার থেকে। আমেরিকায় ৭ দশমিক ৬ কোটি মানুষ খাদ্যে বিষক্রিয়ায় ভুগে থাকেন, যাদের মধ্যে ৩ লাখ ২৫ হাজার মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হন এবং এর মধ্যে ৫ হাজার জন মৃত্যুমুখে পতিত হন।

খাদ্য নিরাপত্তা বলতে আমরা বুঝি বিজ্ঞানসম্মতভাবে খাদ্য নাড়াচাড়া করা, তৈরি করা এবং গুদামজাত করা, যাতে খাদ্যবাহিত কোনো রোগ সংক্রমণ হতে না পারে। এখানে বলে রাখা ভালো, খাদ্য গ্রহণে মানুষ থেকে মানুষের দেহে, পশু থেকে মানুষের দেহে রোগ সংক্রমণ হতে পারে এবং খাদ্যের মধ্যে পরজীবী জীবাণু ছত্রাক বংশ বৃদ্ধি করে মানবদেহে রোগ সৃষ্টি করতে পারে। নিরাপদ খাদ্যের মধ্যে বিশুদ্ধ পানিও অন্তর্ভুক্ত। সবার জন্য সুপেয় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা যে কোনো দেশের একটি মৌলিক অঙ্গীকার। খাদ্য নিরাপত্তা বলতে খাদ্যশস্য উৎপাদন, খাদ্যের লেভেলিং বা চিহ্নিতকরণ, খাবারের সঙ্গে এডিটিভ ও পেস্টিসাইড (কীটনাশক) ব্যবহার, খাবার গুদামজাতকরণ এবং বাজারে সরবরাহ ইত্যাদি সবকিছুকে বোঝায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সুখাদ্যের পাঁচটি বড় বৈশিষ্ট্য হল- ১. মানুষের মধ্যে, জীবজন্তুর মধ্যে, গৃহপালিত পশুর মধ্যে খাবারের সঙ্গে রোগ সংক্রমণকারী জীবাণু ছড়ানো বন্ধ করা। ২. কাঁচা ও সিদ্ধ করা খাবার আলাদা করা। যাতে সিদ্ধ করা খাবারে কোনো সংক্রামক জীবাণু না থাকে। ৩. খাবার সঠিকভাবে সঠিক সময়ে সঠিক পদ্ধতিতে রান্না করা যাতে সব সংক্রমণ করা জীবাণু মরে যায়। ৪. খাদ্য সঠিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা। ৫. সুপেয় পানি ও কাঁচামাল নিরাপদ করার ব্যবস্থা। উল্লেখ্য, তত্ত্বীয়ভাবে খাবারে বিষক্রিয়ার ১০০ শতাংশ প্রতিরোধযোগ্য।

কী কী সংক্রমণকারী খাবার সংক্রমণ ঘটিয়ে রোগ সৃষ্টি করতে পারে

১. জীবাণু ঘটিত : ক) ক্লষ্টিডিয়াম বুটোলিনা (খাদ্যে বিষক্রিয়া ঘটে মৃত্যু হতে পারে), খ) এসকেকোলাইরিশিয়া (ডায়রিয়া, ডিসেন্ট্রি), গ) সালমোনেলা (টাইফয়েড, প্যারাটাইফয়েড), ঘ) লিষ্টেরিয়া, ঙ) ভিব্রিও কলেরা (কলেরা তৈরি হতে পারে)।

২. ভাইরাস ঘটিত : ক) এনটেরে ভাইরাস (পাতলা পায়খানা), খ) হেপাটাইটিস এ (জন্ডিস, পাতলা পায়খানা), গ) রোটা ভাইরাস (বাচ্চাদের পাতলা পায়খানা), ঘ) নরওয়াক ভাইরাস (বয়স্কদের পাতলা পায়খানা)।

৩. পরজীবী ঘটিত : ক) এনটামোয়েবা হিস্টোলাইটিকা (আমাশয়, পাতলা পায়খানা, বদহজম), খ) জিয়ারডিয়া (আমাশয়, পাতলা পায়খানা, বদহজম), গ) ক্রিপটোস্পোরি ডিয়োসিস।

৪. এলার্জিজনিত প্রদাহ : বিভিন্ন ধরনের খাদ্য যেমন গরুর মাংস, চিংড়ি মাছ, বেগুন ইত্যাদি খাওয়ার কারণে।

খাদ্য নিরাপদ করার জন্য কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার

প্রতিটি উন্নত দেশে খাদ্য নিরাপত্তা তদারকির জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেমন- ফুড অ্যান্ড সেফটি অরগানাইজেশন, কাস্টমার-কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন এবং প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের আইন-কানুনসহ খাদ্য অধিদফতর, কৃষি, স্বাস্থ্য অধিদফতর ইত্যাদি। এসব প্রতিষ্ঠান বছরে বিভিন্ন সময়ে সভায় বসে খাদ্য সঠিকভাবে উৎপন্ন হচ্ছে কি-না, জৈব-অজৈব রাসায়নিক সার যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর তা ব্যবহৃত হচ্ছে কি-না, ফসল তোলার পর খাদ্য সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত বা গুদামজাত হচ্ছে কি-না, পরবর্তী সময়ে সেগুলো বড় বড় মার্কেটে এবং খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছাচ্ছে কি-না, সর্বোপরি প্রক্রিয়াজাত উৎপাদিত খাবারে সঠিক খাদ্য উপাদান আছে কি-না- তার লেবেল যুক্ত করা, উৎপাদনের তারিখ এবং শেষ হওয়ার তারিখ উল্লেখ করা এবং কত তাপমাত্রায় সার সংরক্ষিত করতে হবে তার উল্লেখ করা- এ সবকিছুর তদারক করে। এগুলোর উল্লেখ থাকার পরই তা জনসাধারণের কাছে সরবরাহের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এর ব্যত্যয় হলে অথবা কোনো খাবার গ্রহণের ফলে কোনো ব্যক্তি অসুস্থ হলে আক্রান্ত রোগীর সময়োপযোগী চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, সংক্রমিত খাবারটি বাজার থেকে তুলে নেয়া- এসব কাজও কর্তৃপক্ষের ওপর বর্তায়। এক্ষেত্রে সংবাদপত্র, টেলিভিশন, রেডিও, সরকার, পেশাজীবী আইন প্রণেতা এবং স্বাস্থ্য কর্মীদের একটি বড় ধরনের ভূমিকা আছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে এ ধরনের তত্ত্বাবধায়ক অধিদফতরের সংখ্যা কম। যে কয়টি অধিদফতর আছে তাদের লোকবল অপ্রতুল। এ কারণে আমাদের দেশে খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য নিচে উল্লিখিত ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করতে হবে-

১. খাদ্য নিরাপত্তা বলতে আমরা কী বুঝি এ বিষয়ে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করা। ২. খাদ্য ও পানির মাধ্যমে কী কী রোগ সংক্রমণ হয় সে সম্পর্কে রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র ইত্যাদিতে ডাক্তার, আইন প্রণেতা, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, সরকার ও পেশাজীবীদের আরও বেশি অংশগ্রহণ। ৩. খাদ্য সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা এবং সঠিক সময়ের জন্য সিদ্ধ করে খাওয়া। ৪. খাদ্যবাহিত রোগে আক্রান্ত হলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে চিকিৎসা নেয়া। ৫. যেসব রোগের টিকা আছে সেগুলোর জন্য প্রতিষেধক হিসেবে টিকা গ্রহণ করা।

এগুলো যথাযথভাবে পালন করা হলে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। সংশ্লিষ্ট সবাই এ ব্যাপারে উদ্যোগী হবেন- বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

(তথ্যসূত্র : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বুলেটিন)

অধ্যাপক ডা. মো. তাহমিনুর রহমান সজল : উপাধ্যক্ষ, আনোয়ার খান মর্ডান মেডিকেল কলেজ, ঢাকা

 mtahminur@yahoo.com
Facebook Comments