বাড়ির সবার সাথে ফোনে কথা বলা শেষ করে সহযাত্রীর দিকে তাকালো সুবহা। গভীর মনোযোগ দিয়ে লিখতে কি যেন। একদম মুখোমুখি বসেছে সে তাই দেখার উপায় নেই কি লিখছে উনি। এত মনোযোগ দিয়ে কি লিখছে? লেখা দেখতে ব্যর্থ হয়ে লেখকের দিকে তাকালো সুবহা! চেহারার মধ্যে কি অদ্ভুত আত্ম নিমগ্নতা ছড়িয়ে গিয়েছে মানুষটির! মুগ্ধ না হয়ে পারলো না। খুব ইচ্ছে করতে লাগলো পাশে গিয়ে বসতে। কিন্তু নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মেরেছে সে। অকারণেই ঝগড়া বাঁধিয়েছে ট্রেনে উঠার পর। দুষ্টুমির ছলে ঝগড়া যে সিরিয়াস পর্যায়ে চলে যাবে মোটেই বুঝতে পারেনি। কথায় কথায় জাফরকে বলে ফেলেছিল তোমাকে বিয়ে করাই আমার ঠিক হয়নি। বাক্যেটি শোনা মাত্র দপ করে নিভে গিয়েছিল জাফরের চেহারার আলো। শক্ত হয়ে গিয়েছিল চোখ মুখ। সুবহা কিছু বলার আগেই কঠিন স্বরে জাফর বলেছিল, পুরো জার্নিতে তুমি আমার সাথে কোন কথা বলবে না। না আমি তোমাকে চিনি, না তুমি আমাকে চেনো। এরপর হাজারটা কথা বলেছে, অসংখ্যবার সরি বলেছে কিন্তু জাফরের মুখ দিয়ে একটি শব্দও বের করাতে পারেনি। এজন্যই ফোনে কথা বলে কান ঝালাপালা করে দেবার চেষ্টা করেছে। যাতে বিরক্ত হয়ে কিছু বলে জাফর। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। বই পড়ছে, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকছে, এখন লিখতে বসেছে। কিন্তু কথা তো দূরে থাক একটা শব্দ পর্যন্ত বের করছে না মুখ দিয়ে বান্দাহ। এত কঠোর মানুষ হয়? কিভাবে এই লোকের সাথে সারাজীবন কাটাবে ভেবে কিছুটা শঙ্কিত বোধ করলো সুবহা।
মা বড় ফ্লাক্সে করে চা/কফি দুটাই দিয়ে দিয়েছিলেন। নিজে চা নেবার সময় এক কাপ জাফরের সামনেও রাখলো। ওমা সাথে সাথে হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ নিলো জাফর। একেই মনেহয় বলে জাতে মাতাল তালে ঠিক। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে মোবাইল নিয়ে ম্যাসেজ করলো সুবহা। আচ্ছা আমরা কি অপরিচিতদের মত কথা বলতে পারি? সাথে সাথেই জবাব এলো, হুম! আনন্দে হুরররে… বলে চিৎকার দিতে ইচ্ছে করলেও চিৎকারটা গরম চায়ের সাথে গিলে ফেললো সুবহা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, আচ্ছা তো আপনি লেখক?
চোখ তুলে তাকালো জাফর। মুখে হাসি টেনে বলল, শখের লেখক বলতে পারেন। জীবনে ঘটমান হৃদয়াস্পর্শিত কথাগুলোকে মনের সাথে সাথে ডায়েরীর পাতাতেও টুকে রাখার চেষ্টা করি।
সুবহা বলল, এর সার্থকতা কি?
সার্থকতা কি সেটা তো ভেবে দেখনি। তবে কখনো যদি মন ভুলে যায় কোন সুন্দর মুহুর্ত। ডায়েরীর পাতার ভাঁজ থেকে সেটিকে সযতনে তুলে নেয়া যাবে।
এটাই তাহলে আপনার লেখক হবার পেছনের কারণ?
ইন্টারভিউ নিচ্ছেন নাকি?
নাহয় হলোই ইন্টারভিউ!
আমার আসলে লাভ স্টোরি পড়ার হবি আছে।
তো? এরসাথে লেখার কি সম্পর্ক?
আমি প্রথম লাভ স্টোরি পড়েছিলাম যখন আমার বয়স সাড়ে সাত বছর।
সুবহা চোখ বড় বড় করে বলল, সত্যি?
অবশ্যই সত্যি। বানান করে করে পুরো লাভ স্টোরি পড়ে ফেলেছিলাম। এরপর থেকে নিয়মিত পড়তাম।
আপনার বাবা-মা ধোলাই দেয়নি?
উনারা আসলে বুঝতেনই না যে আমি কঠিন সব বই পড়তে পারছি। তাই উনাদের চোখের সামনে বসেই জীবনের প্রথম আট দশটা লাভ স্টোরি পড়ে ফেলেছিলাম।
সুবহা হাসতে হাসতে বলল, শুধুই কি পড়েছিলেন নাকি কিছু মিছু বুঝেও ছিলেন ?
জাফর ঠোঁট টিপে হাসি চেপে বলল, সিরিয়াসলি লাভ স্টোরি পড়া শুরু করেছিলাম হাই স্কুলে উঠার পর। তখন কিছু মিছু না বেশ ভালোই বুঝতাম। কিন্তু বেশির ভাগ লাভ স্টোরিই আমার পছন্দ হতো না। কিছু অংশ খুবই বাজে লাগতো। একটা লাভ স্টোরি খুব পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু শেষে গিয়ে নায়িকা মারা যায়। আমি এটা কিছুতেই মানতে পারছিলাম না। খুব কান্না করেছিলাম। একটা সময় মনে হলো যে, আমি বোকার মতো কান্না করছি কেন? তারচেয়ে গল্পের এন্ডিংটা বদলে দেই। সেদিন থেকে শুরু আমার গল্পের অপছন্দনীয় অংশগুলোকে নিজের মনের পছন্দ মত লেখার। এরপর থেকে যদি একটা লাইনও আমার অপছন্দ হতো কোন বইয়ের আমি সেটা কেটে দিয়ে নিজের পছন্দের লাইন বসিয়ে দিতাম নীচে।
সুবহা হেসে বলল, শুনতেই অদ্ভুত রকম ভালো লাগছে। আমিও ইনশাআল্লাহ ট্রাই করে দেখবো আপনার এই পদ্ধতি। আচ্ছা এখনো কি এমন কিছু করছেন? অপছন্দনীয় কিছু কেটে দিয়ে পছন্দনীয় কিছু বসিয়ে দিচ্ছেন সে জায়গায়।
জাফর সামান্য হাসলো। কোন জবাব না দিয়ে আবারো লেখার মাঝে মগ্ন হলো।
লিখেছেন- ডা.আফরোজা হাসান। সাইকোলজিস্ট,মাদ্রিদ,স্পেন।