banner

মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 519 বার পঠিত

 

নারীবাদী নয়,সমতাবাদী

প্রথম আলোর ‘স্বপ্ন নিয়ে’ পাতা থেকে হ্যারি পটারখ্যাত অভিনেত্রী এমা ওয়াটসন ‘হি ফর শি’ নামের কর্মসূচি নিয়ে কাজ করছেন বলে জানা গেল। তিনি বলেছেন,

‘আমি যত বেশি ফেমিনিজম বা নারীবাদ নিয়ে কথা বলি, তত বেশি বুঝতে পারি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারীর অধিকারের লড়াইকে পুরুষবিদ্বেষী ভাবা হয়। আমি একটা কথাই বিশ্বাস করি, সব ধরনের বিদ্বেষ রুখতে হবে। নারী ও পুরুষের সম–অধিকার ও সমান সুযোগই নারীবাদের ভাবাদর্শ।’
৫০ থেকে ৬০ বছর আগে কাউকে ‘কমিউনিস্ট’ হিসেবে জানতে পারলে সাধারণ ধর্মভীরু মানুষজন আঁতকে উঠত। নুরজাহান বোসের আগুনমুখার মেয়ে বইটিতে এ রকম উল্লেখ আছে যে একটা বাড়িতে এক কমিউনিস্ট এসেছেন জানতে পেরে কেউ আর ওই বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে রাজি নয়। ইদানীং আবার উল্টোটাও দেখা যায়, কোনো কট্টর মৌলবাদী বেড়াতে আসবে জানতে পেরে সে বাড়ির আধুনিক ছেলেমেয়েরা আগেভাগেই কেটে পড়ে। ‘নারীবাদী’ শব্দটাও অনেকের কাছে ও রকমই ভীতিপ্রদ। যেন নারীবাদী মানেই তসলিমা নাসরিন।

নারীবাদী মানেই পুরুষবিদ্বেষী। অনেক প্রগতিশীল পুরুষও নারীবাদীদের এড়িয়ে চলেন, আর যেসব পুরুষ নারীবাদী, তাঁদের পৌরুষ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। আবার এমনও অনেক নারীবাদী নারী-পুরুষ আছেন, যাঁরা কেবল তাত্ত্বিক নারীবাদিত্বের বড়াই করেন কিন্তু ব্যবহারিক জীবনাচরণে নারীকে দেখেন পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিতে। অল্প কিছুসংখ্যক ঠিকই বোঝেন যে নারীবাদীরা যেসব যুক্তিতে সমতার কথা বলে, তার ষোলো আনাই সঠিক, কিন্তু পারিপার্শ্বিকতাকে বুড়ো আঙুল দেখানোর মতো সৎ সাহস তাদের নেই বলে তারা মুখ বুঝে থাকে। কিন্তু এ কথা তো ঠিক যে নারী যেমনভাবে নারীর কথা বলতে পারবেন, পুরুষ তা পারবেন না। কিন্তু নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এখনো যেখানে পুরুষপ্রাধান্য, সেখানে খামোখা শত্রু বাড়িয়ে লাভ কী?
একসময় উইড (উইমেন ইন ডেভেলপমেন্ট) বেশ সরব ভূমিকা পালন করলেও পরবর্তী সময়ে গ্যাড (জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) অধিক জনপ্রিয় ও কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। জেন্ডার উন্নয়নে নারী-পুরুষ উভয়ের কথাই বলা হয়। তার পরও জেন্ডার পরামর্শক বা বিশেষজ্ঞদের (নারীই এসব পদে বেশি বহাল আছেন) নারীবাদীরূপেই বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশ সরকারের একজন সচিবের কাছে এক নারী কর্মকর্তা বিধি অনুযায়ী তাঁর পদোন্নতির কথা বলতে গেলে সচিব ‘নারীর ক্ষমতায়ন?’ বলে এমন অবজ্ঞামিশ্রিত এক হাসি দিলেন যে সে নারী দ্বিতীয়বার আর অনুরোধের সাহস করলেন না। অথচ সে নারী কর্মকর্তার চেয়ে পদমর্যাদায় জ্যেষ্ঠ একজন পুরুষ কর্মকর্তা কেবল সরকারদলীয় বিবেচনায় বছরের পর বছর পদোন্নতির সুবিধা ভোগ করে আসছেন। নারীর ক্ষমতায়ন যেখানে এ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর উল্লেখযোগ্য প্রতিশ্রুতির একটি, সেখানে নারীদের তাঁদের ন্যায্য পাওনাটার জন্যও লড়াই করতে হচ্ছে। তাহলে ক্ষমতায়নের আগে দরকার সমতায়ন?
নারীরা যেমন নারীশক্তির মাহাত্ম্য সম্পর্কে সম্যক অবহিত, পৃথিবীতে পুরুষদের বিজয়গাথা নিয়েও পুরুষেরা গর্বিত। যেসব নারী জানেন পুরুষের গৌরবগাথা ভুলে থাকার বিষয় নয় এবং যেসব পুরুষ জানেন নারীর শক্তিও কালে কালে আলোকবর্তিকা হয়ে দেখা দিয়েছে, কেবল তাঁরাই একত্রে অভিন্ন মতাদর্শ নিয়ে এগিয়ে আসতে পারেন। একে অন্যের সুকৃতি ও পথচলাকে শ্রদ্ধা করতে না পারলে বাহ্যিক ইতিবাচকতা অন্তর্গত দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে তেমন উল্লেখযোগ্য ছাপ রেখে যেতে পারবে না। অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর শেষ প্রশ্ন উপন্যাসে শতাধিক বছর আগেও যা বলে গেছেন, আজকের দিনেও তা আমরা অনেককেই বলতে শুনি না। উপন্যাসের নায়িকা কমল বলছেন, ‘মানুষ তো কেবল নরও নয় নারীও নয়—এ দুয়ে মিলেই তবে সে এক।’
সহমর্মী পুরুষেরা নারীদের শক্তি। তাদের ভালো দিকগুলোকে উদ্ভাসিত না করে কেবল খারাপ দিকগুলো নিয়ে আক্রমণ করে গেলে সমব্যথিতা হারানোর ভয় থাকে। পুরুষতন্ত্র অবশ্যই বর্জনীয়, তা বলে পুরুষমাত্রই পুরুষতান্ত্রিক নন, অন্যদিকে নারীজীবনের বঞ্চনা ও নির্যাতনের মধ্যে কাল কাটিয়েও সব নারীই নারীবাদী নন। শাশুড়ি, ননদ, জা যখন নিপীড়ক ও হন্তারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, তখন জেন্ডারকানারা বলেন, ‘এত যে পুরুষতন্ত্র পুরুষতন্ত্র বলে যুদ্ধ ঘোষণা করা, এরা তবে কারা?’ তাঁরা আসলে নারী হলেও পুরুষতন্ত্রেরই ধ্বজাধারী। পুরুষতন্ত্র হচ্ছে পুরুষ কর্তৃত্বের একটি নীতি, যে নীতি তার সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে নারীকে নিপীড়ন করে। আজ নারীবাদী হিসেবে যাঁরা বিশ্বে খ্যাতি বা অপবাদ কুড়াচ্ছেন, তাঁরাও কম দুঃখে নারীবাদী হননি। নারীবাদের ধারণা, নারীর ওপর নিপীড়ন ও তা থেকে মুক্তির উদ্দেশ্য ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচিত মতের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে।
তবে প্রণোদনায় হোক বা নগরায়ণ-শিল্পায়ন অথবা ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের জয়জয়কারেই হোক, দুটির বেশি সন্তান নিতে চাইছেন না মা-বাবারা। উন্নত বিশ্বে তো শিক্ষা ও পেশাকে অগ্রাধিকারে রেখে সন্তান জন্ম দেওয়ার ব্যাপারে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে অনীহা তৈরি হয়েছে। এতে ছোট পরিবারগুলোর মধ্যে মেয়েসন্তান ও ছেলেসন্তানের সঙ্গে আচরণে বৈষম্য কমে আসছে। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মেয়েরাই বৃদ্ধ বয়সের মা-বাবার দেখাশোনা-সেবাযত্ন করেন বলে মেয়েদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্টের অভিযোগও আছে। অনেক নারী নিজের বা তাঁর মায়ের জীবনের অবহেলা-নিপীড়নের কথা চিন্তা করে বা সমাজে নারীর দুঃসহ অবস্থান দেখে নিজের সন্তানদের মধ্যে কন্যাকেই অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন। সার্বিকভাবে এ চিত্র যদিও নগণ্য, তবু কারও প্রতি বৈষম্যই কাম্য হওয়া উচিত নয়।

এমা ওয়াটসন বাস্তবিকই বলেছেন, ‘আমাদের এমন মানুষই দরকার বেশি করে, যারাই পৃথিবীতে সম–অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে। লিঙ্গভিত্তিক সম–অধিকার প্রতিষ্ঠাই নারীবাদের মূল লক্ষ্য। নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে সাধারণ মানুষ পুরুষবিদ্বেষী হিসেবে দেখে থাকেন। শুধু নারীদের একার পক্ষে অধিকারের জন্য লড়াই করা সম্ভব নয়। পুরুষদেরও নারীর সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। পুরুষেরাও নানা কারণে অধিকারবঞ্চিত। নানা কারণে নারীর মতো পুরুষেরাও নির্যাতনের শিকার। আমরা একজন আরেকজনের জন্য দাঁড়িয়ে বৈষম্য বিলোপ করার চেষ্টা করতে পারি।’
হ্যারি পটার–এর সেই ছোট্ট মেয়েটি, যিনি এখন জাতিসংঘের নারী সংস্থার শুভেচ্ছাদূত হিসেবে কাজ করছেন, সেই মেয়েটিকে আমাদের জ্ঞানচক্ষু খুলে দেওয়ার জন্য অজস্র ধন্যবাদ।

লেখা– উম্মে মুসলিমা: কথাসাহিত্যিক।

Facebook Comments