banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 400 বার পঠিত

 

অন্তত শিশুদের কথা শুনুন। কেননা, শিশুরা মিথ্যা কথা বলে না।

নিকট অতীতে বাংলাদেশ নিয়ে যেসব আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সংস্থা ও গণমাধ্যম প্রতিবেদন তৈরি করেছে, তাদের প্রায় সবাই আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে আমাদের সাফল্যের ভূয়সী প্রশংসা করেছে। কেউ বলেছে, বাংলাদেশ একটি ধাঁধা। কেউ বলেছে, বাংলাদেশ পারে। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, সামাজিক খাত ও মানবসম্পদ উন্নয়নে ভারত যা পারেনি, বাংলাদেশ তা করে দেখিয়েছে।
একদা খাদ্যঘাটতির বাংলাদেশ চাল রপ্তানি করে অনেককে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। কেবল চাল নয়, মাছ, সবজি ও ছাগল উৎপাদনেও বাংলাদেশ রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। আগে বাজেটের আকার ছোট ছিল, তাও বিদেশি সাহায্য ছাড়া তৈরি করা ছিল অসম্ভব। এখন বাজেটের আকার দুই লাখ কোটি টাকা ছাড়ালেও বিদেশের ওপর তেমন নির্ভর করতে হয় না। পাঁচ বছরের ব্যবধানে জাতীয় বাজেটের আকার দ্বিগুণ হয়েছে। বাংলাদেশ গত এক দশক প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশে ধরে রেখেছে। বৈদেশিক মুদ্রাভান্ডার ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের বেশি, যা দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় বৃহত্তম।
বাংলাদেশের তরুণ বিজ্ঞানীরা, গবেষকেরা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নানা মাত্রায় কৃতিত্বের ছাপ রেখে চলেছেন। তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশ এখন দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে। বিজিএমইএ আশা করছে, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বর্তমান ২৫ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি ৫০ বিলিয়ন ডলারে রূপান্তরিত করতে পারবে। এই শিল্পে ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করছেন, যার ৯০ ভাগ নারী শ্রমিক। বাংলাদেশের তৈরি জাহাজ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ পেলে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরাও যে পারেন, পাট ও ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচন করে তা দেখিয়েছেন ড. মাকসুদুল আলম এবং তাঁর সহকর্মীরা। তিনি মারা না গেলে হয়তো আরও অনেক উদ্ভাবন তাঁর কাছ থেকে আমরা পেতাম। তাঁর মৃত্যু বাংলাদেশের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। আমরা আশা করি, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা নোবেল পুরস্কারেও ভূষিত হবেন।

২.
বাংলাদেশের এই উন্নতি, অগ্রগতির পেছনে আছে মানুষের অদম্য ইচ্ছাশক্তি। তাদের কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায় আমাদের অর্থনীতিকে পুষ্ট করছে, সামাজিক সূচককে এগিয়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশের তরুণেরা যেখানেই যান, সাফল্যের স্বাক্ষর রাখছেন। বাংলাদেশের তরুণ কম্পিউটর প্রোগ্রামার সালমান খান ও সুমাইয়া কাজী আমেরিকাকে মাতিয়েছে। আমাদের যেসব তরুণ দেশের বাইরে পড়াশোনা করেন, তাঁদের অধিকাংশ নিজ নিজ ক্ষেত্রে অনেক উঁচু পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তাঁদের শ্রম, মেধা ও অধ্যবসায়ের সুফল পাচ্ছেন বিদেশিরা। যদি আমরা তাঁদের উপযুক্ত পরিবেশ দিতে পারতাম, তাহলে তাঁরা দেশেই ফিরে আসতেন, দেশের মানুষের সেবা করতেন।
কিন্তু ফিরে না আসার বড় কারণ অস্থির, অনিশ্চিত ও সংঘাতময় রাজনীতি। এই রাজনীতি আমাদের সমাজ, সভ্যতা ও মানুষের চাহিদা মেটাতে পারছে না। এ রাজনীতি মেধাবী তরুণদের আকৃষ্ট করতে পারছে না। ক্ষমতাসীনেরা ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখালেও তারা দেশ, প্রশাসন, শিক্ষাঙ্গন—সবই চালাচ্ছে অ্যানালগ কায়দায়। এ কারণেই আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্দুকযুদ্ধে সম্ভাবনাময় তরুণদের খুন হতে দেখি, সরকারি অফিসে টেন্ডারবাজি এবং সর্বত্র দখলবাজির মহড়া চলতে দেখি।
আধুনিক মানুষের জীবনযাপন, দৈনন্দিন কাজ-কর্ম সব তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর হলেও আমাদের রাজনীতিটা রয়ে গেছে সেই মান্ধাতার আমলে। রাজনীতিকেরা একে অপরকে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করেন, জিবের ধার পরীক্ষা করেন। তাঁদের এই বাগ্যুদ্ধে মানুষের স্বার্থ ও কল্যাণের কথা নেই। মানুষের স্বপ্ন ও ভালোবাসার কথা নেই। আছে কেবল হিংসা-দ্বেষ, ঘৃণা ও জিঘাংসা। রাজনীতি এখন বিদ্যাচর্চার মাধ্যম নয়, বুদ্ধিনাশ ও পেশিশক্তি চাষের মাধ্যম।
এ কথা সত্য যে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক ধ্যানধারণা, নীতি ও আদর্শ অনুযায়ী। যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁরা দলীয় আদর্শ বাস্তবায়ন করবেন, এটাই স্বাভাবিক। আওয়ামী লীগ তাদের নীতি ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে প্রতিপক্ষের কাছ থেকে কঠিন বাধার মুখে পড়েছে, এমন নয়। বরং তারাই কখনো রাষ্ট্রধর্ম রেখে, কখনো নারীনীতি সংশোধন করে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সঙ্গে আপস করছে। আপস করছে পরিত্যক্ত স্বৈরাচারের সঙ্গেও।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য যেসব উপাদান অপরিহার্য, যা কোনো দলই উপেক্ষা করতে পারে না, সেগুলো হলো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, সব নাগরিকের প্রতি সমান আচরণ, মানুষের মতপ্রকাশের মৌলিক অধিকারগুলো সমুন্নত করা। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ও গণতন্ত্রের অতন্ত্র প্রহরী বলে দাবিদার সরকার সেই কাজগুলো কেন করছে না, সেটি আমরা বুঝতে অপারগ। কেন আমরা ৪৩ বছরেও একটি সরকারপদ্ধতি, নির্বাচনপদ্ধতি নিয়ে ঐকমত্যে আসতে পারলাম না? বন্দুকের জোরে যাঁরা ক্ষমতাসীন হয়েছেন, তাঁদের কথা বাদ দিলাম, কিন্তু যাঁরা বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন (লক্ষ করুন ১৯৭৩, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ সালের নির্বাচন), তাঁরা কেন গণতন্ত্রকে টেকসই ভিতের ওপর দাঁড় করতে পারলেন না? আমাদের গণতন্ত্রীরা এতটাই অগণতান্ত্রিক আচরণ করেছেন যে পরিত্যক্ত স্বৈরাচারও আজ গণতন্ত্রের সবক দেওয়ার দুঃসাহস দেখাচ্ছে। যে দেশে গণতন্ত্র থাকে, সে দেশে গণতন্ত্র হত্যা দিবস কিংবা গণতন্ত্র রক্ষা দিবস পালন করতে হয় না। গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, এ নিয়ে এত হাঙ্গামা, এত মারামারি, এত ঝগড়াঝাঁটি হয় না। এখানে হচ্ছে, কেননা সত্যিকার গণতন্ত্র নেই। এখানে হচ্ছে, কেননা যেকোনো উপায়ে আমরা ক্ষমতায় থাকতে চাই বা যেতে চাই।

৩.
২০১৪ সালটি জাতির জীবনে ভালো গেছে বলা যাবে না। তবে আগের বছরের চেয়ে কম খারাপ গেছে। এখন প্রশ্ন, ২০১৫ সাল কেমন যাবে? বছরের শুরুটা হয়েছে জামায়াতের হরতাল দিয়ে। তার আগে ২০ দলের সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ছিল। হরতাল-অবরোধ, হাঙ্গামা, বাসে আগুন, ভাঙচুর চলবে কি না, সেটি নির্ভর করছে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর। তাদের শুভবুদ্ধি হলে এগুলো এড়ানো যায়। দুর্বুদ্ধি বজায় থাকলে এ থেকে রেহাই নেই। সংকট সমাধানে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া সাত দফা প্রস্তাব দিয়েছেন। আলোচনার কথা বলেছেন। সরকারি দল পাল্টা ১৪ দফা দিয়ে তার অসারতা প্রমাণ করতে পারত। কিন্তু সেদিকে না গিয়ে তারা সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে। যেমনটি গত বছর নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়া করেছিলেন। এই পাল্টাপাল্টির নাম গণতন্ত্র নয়। খালেদা জিয়া নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের কথা বলেছেন, সেটি তো আগামী নির্বাচনের আগে করতেই হবে। সংবিধান অনুযায়ী কোনোভাবে এ কমিশন পাঁচ বছরের বেশি থাকতে পারবে না। কমিশনের মেয়াদ তিন বছর পার হয়ে গেছে।
নির্বাচন কবে হবে, কোন সরকারের অধীনে হবে, সে সমস্যা অমীমাংসিত রেখেও সরকার ও বিরোধী দল অন্তত দুটি বিষয়ে সন্ধি বা সমঝোতা করতে পারে। এক, বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে সরকার বাধা দেবে না, দুই, বিরোধী দল এমন কোনো কর্মসূচি নেবে না, যাতে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত এবং জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়।
ক্ষমতাসীনদের মধ্যে একটি ধারণা বদ্ধমূল যে যারাই তাঁদের সমালোচনা করে, ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দেয়, তারা দেশের শত্রু, সমাজের শত্রু, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। তারা এও মনে করেন যে, একমাত্র তারাই দেশের ভালো চান। কল্যাণ চান। আর কেউ দেশ নিয়ে ভাবেন না। দেশের জন্য আর কারও দরদ নেই। ভালোবাসা নেই। গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ—সবাই সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। সরকারের কোনো ভুল পদক্ষেপের সমালোচনা করলেও তাঁরা সেটি মানতে পারেন না। দেশের সাধারণ মানুষ, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কী চায়, তাও তাঁরা বুঝতে চান না। গত এক বছরে বিএনপি জোট আন্দোলন করতে পারেনি বলে সরকারি দলের নেতারা বাহবা নেন। কিন্তু বিরোধী দলের আন্দোলনহীন গত এক বছরে যত খুন, গুম হয়েছে, তার দায় তো সরকারকেই নিতে হবে।

৪.
গত বছর ৩০ ডিসেম্বর জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার ফল প্রকাশ পেয়েছে। সেই পরীক্ষায় ভালো ফল করেছে, এ রকম চারজন শিক্ষার্থীর সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে প্রথম আলোয়। গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ, মানবাধিকার সংস্থা, বিদেশি কূটনীতিক—যাঁরাই সরকারের সমালোচনা করছেন, তাঁদেরই ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু এই শিশু–কিশোরদের সরল সত্য ভাষণ সরকার কীভাবে নেবে?
রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের ছাত্রী তাকীয়া এহসান বলেছে, ‘আমি নতুন বছরটি আনন্দে কাটাতে চাই। শান্তিতে থাকতে চাই। আর দেশকে এগিয়ে নিতে একসঙ্গে কাজ করতে চাই।…আমি চাইলেও সন্ধ্যার পর একা বের হতে পারি না। আমার সমাজ ও রাষ্ট্র এখনো এভাবে নিরাপত্তা দিতে পারেনি।’
চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থী আদিল আহমেদ বলেছে, ‘রাজনৈতিক কর্মসূচি দিলে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়, সেটি ২০১৩ সালে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম।…ওই বছর অনেক দিন স্কুলে যেতে পারিনি।…আমরা দেশে হানাহানি দেখতে চাই না। আমরা দেশ গড়ার রাজনীতি চাই। গাড়িতে ঢিল ছুড়ে একজন শিক্ষিকাকে খুন করা হয়েছে। এই বীভৎস চিত্র আমাদের মর্মাহত করেছে। আপনারা সমঝোতা করে শান্তি আনুন দেশে।’
রাজশাহী পিএন সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের নাফিসা বিনতে আসিফ বলেছে, ‘চারদিকে যেভাবে পরিবেশদূষণ হচ্ছে, তা দেখে মন খারাপ হয়। তার চেয়েও বেশি খারাপ হয় দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখে।’
মনিপুর উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাওহিদ আহসান বলেছে, ‘ঢাকা শহরের নোংরা পরিবেশ আর ট্রাফিক জ্যামটা সবচেয়ে খারাপ লাগে। যতই পরীক্ষা হোক না কেন, যেন প্রশ্নপত্র ফাঁস না হয়। তাহলে দেশে মেধাবীদের সংখ্যা কমে যাবে। পরীক্ষার আগে প্রশ্ন পাওয়া একটি প্রতারণা।’
তাই সরকারকে বলব, গণমাধ্যমের সমালোচনা কানে না নিন, নাগরিক সমাজের উদ্বেগ অগ্রাহ্য করুন, মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সমালোচনাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিন, অন্তত এই কোমলমতি শিশুদের চাওয়া-পাওয়ার কথাটি ভাবুন। তারা নোংরা ঢাকা শহরের মতো নোংরা রাজনীতিও অপছন্দ করে। তারা প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়াকে ঘৃণা করে। তারা ঘরে-বাইরে নিরাপত্তা চায়।
অন্তত শিশুদের কথা শুনুন। কেননা, শিশুরা মিথ্যা কথা বলে না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।

Facebook Comments