banner

রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 536 বার পঠিত

 

শিশুরা কি শিখবে?মূল্য নাকি মূল্যায়ন!

বেশ কয়েকদিন আগে স্কুল থেকে ফেরার পথে নাকীবের এক ক্লাস ফ্রেন্ড ড্রাভিদও হাঁটছিল আমাদের সাথে! হাঁটতে হাঁটতে নানান বিষয়ে কথা বলছিলাম দুজনের সাথে! একসময় নাকীব ওর মামা ওকে নতুন খেলনা কিনে দিয়েছে সেকথা জানালো। খেলনাটির মূল্য কত জানতে চাইলো ড্রাভিদ। নাকিব মূল্য বলার পর ড্রাভিদ বলল, আমার কাছে ২৯ ইউরো আছে। আর ১৬ ইউরো জমালেই আমিও তোমার খেলনাটি কিনতে পারবো। কিন্তু আমি কিনবো না। ১৮ তারিখে আমার মাম্মার বার্থডে। আমি মাম্মাকে উপহার কিনে দেবার জন্য ইউরো জমাচ্ছি দুই মাস ধরে। মাকে উপহার কিনে দেবার জন্য টাকা জমাচ্ছে শুনেই কেমন যেন মুগ্ধতার ভরে গেলো মনটা। মনে পড়ে গিয়েছিল নিজের টাকা দিয়ে যেদিন প্রথম মামণিকে আর বাবাকে উপহার কিনে দিয়েছিলাম সেই দিনের কথা! স্মৃতিটা নাকীবের সাথে শেয়ার করার জন্য ওর দিকে তাকাতেই নাকীব হড়বড় করে বলতে শুরু করলো, আম্মুতা আমিও কিন্তু তোমাকে সবসময় ভালোবাসা উপহার দিই। ভালোবাসা সবচেয়ে সুন্দর উপহার। ভালোবাসা অমূল্য তাই এটা অর্থের বিনিময়ে কেনাও যায় না। চাইনি কিন্তু চেপে রাখতে না পেরে হেসে ফেলেছিলাম আমি! নাকীব মুখ একটু কালো করে বলল, তুমিই তো বলেছিলে কাউকে দেবার ভালোবাসার চেয়ে সুন্দর কোন উপহার নেই। তাই যারা আমার অনেক আপন তাদেরকে যেন সবসময় অনেক অনেক ভালোবাসা দেই! আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, অবশ্যই বাবা ভালোবাসার চেয়ে সুন্দর, পবিত্র ও অনন্য কোন উপহার নেই পৃথিবীতে। তোমার ভালোবাসা উপহার স্বরূপ পেয়ে আম্মুতা অনেক অনেক খুশি হই সবসময় আলহামদুলিল্লাহ।

বেশ কয়েক বছর আগে এক ক্লাস ফ্রেন্ড ভালোবাসার কারণে নিজ পরিবার পরিজন সবকিছু তুচ্ছ করে, চলে গিয়েছিল ভালোবাসার মানুষের হাত ধরে ভালোবাসাময় জীবন গড়ার স্বপ্ন নিয়ে। সেই ভালোবাসার মানুষটি যখন ভালোবাসা ছাড়া জীবন ধারণের নিত্য প্রয়োজনীয় বিলাশ বাসন দিতে ব্যর্থ হচ্ছিলো। এবং ভালোবাসার দ্বারা সবকিছুই অভাব পূরণ করার চেষ্টা করছিল কয়েকমাস যেতে না যেতেই সেই ক্লাস ফ্রেন্ডটি হাঁপিয়ে উঠেছিলো ভালোবাসার মানুষটির দেয়া ভালোবাসার আতিশায্যে। সংসারে শুরু হয়ে গিয়েছিল ছোট ছোট চাওয়া-পাওয়াকে ঘিরে দ্বন্দ্ব-কলহ। যেই ভালোবাসার জন্য পরিবার ছেড়েছিল সেই ভালোবাসাতেই অতিষ্ট হয়ে সংসার ভেঙে সে ফিরে এসেছিল। এই ঘটনাটি দেখে গভীর চিন্তায় নিমজ্জিত হয়েছিলাম আমি। বার বার মনে প্রশ্ন জাগছিল যে, ভালোবাসার জন্য পরিবারকে ছেড়ে দেবার মত ত্যাগ স্বীকার করতে পারলে, নিজের ছোট ছোট চাহিদাকে কেন ত্যাগ করতে পারলো না?! সমস্যাটা কোথায়? ভাইয়া হেসে বলেছিলেন, সমস্যাটা হচ্ছে শাড়ি-গহনা ইত্যাদিও মেয়েদের কাছে ভালোবাসার উপকরণ। বলেছিলাম, আমি এমনটা মনে করি না। ভাইয়া বলেছিলেন, কারণ তোমাকে এমনটা মনে করার শিক্ষা দেয়া হয়নি। তোমাকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে, ‘সবার উপরে ভালোবাসা সত্য, সুখের জন্য শুধু ভালোবাসা প্রয়োজন নিত্য’। হেসেছিলাম তখন খুব। আসলেই এই শিক্ষাটাই দেয়া হয়েছে আমাদের সব ভাইবোনদেরকে। মামণি, বাবা, ভাইয়া, হাসানজ্বি, থেকে নিয়ে শুরু করে পরিবারের সবাই কবে আমাকে কি উপহার দিয়েছে মনে করতে হলে আমাকে ভাবতে হবে। যেহেতু ঐসব উপহার আমার কাছে কখনোই তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিল না। কিন্তু উনাদের দেয়া সুন্দর সুন্দর ভালোবাসাময় মূহুর্ত আমি ননস্টপ বলে বা লিখে যেতে পারবো। কারণ আপনজনদের ভালোবাসা আমার জীবনের অমূল্য সম্পদ।

জীবনে ভালোবাসার প্রয়োজনীয়তা আমরা কেউই অস্বীকার করতে পারি না। ভালোবাসা মনে এমন এক আশার জন্ম দেয় যা মানুষকে সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখতে শেখায়। আমরা জানি জীবনের ভালোবাসার প্রয়োজনীয়তাকে কিন্তু তবুও কেন জানি ঠিক গুরুত্ব দিতে পারিনা সেভাবে। কাউকে ভালোবাসি ভালোবাসি করে জীবন দিয়ে দেই। অথচ সেই ভালোবাসার মানুষটি যদি শুধু ভালোবাসা নিয়ে কাছে আসে আমাদের মুখ কালো হয়ে যায়। এর কারণ আসলে আমরা শুধু ভালোবাসা পেয়েই সুখী বা তৃপ্ত হতে শিখি না বেড়ে ওঠার পরিবেশ থেকে। আমরা ভালোবাসাকে মূল্যায়ন করতে শিখি অর্থের মূল্যে। যে যত বেশি দামের উপহার দেয় বা দিতে পারে। সে আমাদের কাছে ততবেশি গুরুত্ব ও ভালোবাসার দাবীদার হিসেবে গণ্য হয়। এর প্রভাব গিয়ে পড়ে জীবনের সর্বক্ষেত্রে। জীবনকে ঘিরে ঘূর্ণায়মান প্রতিটি সম্পর্কের উপরেও। ছোটবেলা থেকেই তাই শিশুদেরকে কোনকিছুর মূল্য নয় মূল্যায়ন করা শেখাতে হবে। যাতে জীবনের চলার পথে মানুষকে তার ভালোবাসার দ্বারা বিবেচনা করে। কাউকে দেবার ক্ষেত্রে এবং নিজে পাবার ক্ষেত্রেও।

লিখেছেন – ডা.আফরোজা হাসান,শিশু-মনোবিজ্ঞানী। মাদ্রিদ,স্পেন।

Facebook Comments