বাংলাদেশের সংবিধানে নারী-পুরুষের সম-অধিকার স্বীকৃত। এর পরও ঘরে-বাইরে সবখানেই নারীরা প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে আইন রয়েছে, কিন্তু কোনো বাস্তবায়ন নেই। আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে চলেছে ক্রমেই। সাক্ষাৎকারে এসব নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির (বিএনডব্লিউএলএ) নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী।
# বর্তমানে প্রচলিত বিভিন্ন আইনে যেসব বিধান রয়েছে, তা নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে কতটুকু কার্যকর?
সালমা আলী: আমাদের দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে বেশ কিছু আইন রয়েছে, যেমন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩); যৌতুক নিরোধ আইন, ১৯৮০; অ্যাসিড অপরাধ দমন আইন, ২০০২; ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন, ২০০৯; পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২; মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২ ইত্যাদি। এসব আইনে যেসব বিধান রয়েছে, তা নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে বলিষ্ঠ ও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু দুঃখজনক যে, এসব আইনের প্রয়োগ ও বাস্তবায়নে দুর্বলতা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী ও সাক্ষীদের সুরক্ষায় সঠিক ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ না নেওয়া এবং সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিও উল্লেখযোগ্য। পাশাপাশি বিচার-প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার জন্য নারীরা হয়রানির শিকার হন। মামলা পরিচালনার খরচ বেশি হওয়ায় অনেকের পক্ষে মামলা করা কঠিন হয়ে পড়ে।
# পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধে ২০১০ সালে আইন করা হয়েছে। কিন্তু এর বাস্তবায়ন কতটুকু?
সালমা আলী: পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ আইনটি একটি প্রতিরোধমূলক ও নমনীয় আইন। এটি পারিবারিক নির্যাতনকে অপরাধ হিসেবেও স্বীকৃতি দিয়েছে। এ আইনের আওতায় দেশে ইতিমধ্যে ১১৫টির বেশি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে বিএনডব্লিউএলএ ৫০টির বেশি মামলা করেছে। এই আইনে বিধি দ্বারা নির্ধারিত ফরমে মামলা করার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট বিধিমালা না থাকায় কোনো কোনো আদালত এ-সংক্রান্ত অভিযোগ আমলে নিতে অপারগতা প্রকাশ করতেন। একই কারণে আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তারা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছিলেন না। ব্যক্তিগত উদ্যোগে এ আইনের আওতায় খুব বেশি মামলা না হলেও বেশ কিছু সংগঠন আইনের আওতায় উপযুক্ততা ব্যবহার করে কিছু মামলা করেছে। গত ২৯ এপ্রিল সরকার গেজেট আকারে এই আইনের বিধিমালা প্রকাশ করেছে। এতে করে এ আইনের আওতায় মামলা করা এখন সহজ হবে।
# আইনটি বাস্তবায়নের পথে প্রধান বাধাগুলো কী?
সালমা আলী: আইনটি বাস্তবায়নের পথে প্রধান বাধা হচ্ছে আইনটি সম্বন্ধে সাধারণ জনগণের অজ্ঞতা। সাধারণ মানুষ পারিবারিক সহিংসতাকে নিতান্তই ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয় বলে মনে করে বিধায় একে বেশি গুরুত্ব দেয় না। এ আইনের আওতায় প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের অনেকের তাঁদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা নেই। অনেক ক্ষেত্রে মামলা করায় ‘স্বামী কর্তৃক তালাক’ দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়, যা একজন নারীর জীবনকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেয়। কারণ, একজন স্বামী পরিত্যক্ত বা নির্যাতনের শিকার নারীর পুনর্বাসনের জন্য পর্যাপ্ত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নেই। ফলে সাধারণ নারীরা পারিবারিক সহিংসতার বিষয় নিয়ে মামলা করতে আগ্রহী হন না। পাশাপাশি স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করা এখনো আমাদের সমাজে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয়। এ ছাড়া বিচার-প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা, দুর্নীতি, তদন্তে অবহেলা ও ধীরগতির কারণে অপরাধীরা অনেক সময় শাস্তি থেকে রেহাই পেয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে অপরাধীরা আরও বেশি সক্রিয় হয়। এ ধরনের অপরাধের পেছনে জেন্ডার সংবেদনশীলতার অভাব, সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, বেকারত্ব, দারিদ্র্যও ভূমিকা রাখছে।
# বিএনডব্লিউএলএর সাম্প্রতিক গবেষণায় নারীর প্রতি সহিংসতা কোন পর্যায়ে?
সালমা আলী: আমরা নিয়মিত ১৪টি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত নারীর প্রতি সহিংসতাবিষয়ক তথ্য পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করি। এ ছাড়া সমিতির সদস্য এবং মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য পেয়ে গুরুতর নির্যাতন বা অপরাধের ক্ষেত্রে সত্যানুসন্ধান করি। সমিতির পক্ষ থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে নারীর প্রতি সহিংসতার কিছু তথ্য উপস্থাপন করেছিলাম। এতে দেখা গেছে, সম্প্রতি বাংলাদেশে নারীর প্রতি বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ধর্ষণ, গণধর্ষণ, যৌন হয়রানি, অপহরণ, যৌতুকের কারণে নির্যাতন ও হত্যা, পারিবারিক সহিংসতা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে পারিবারিক সহিংসতার কথা সাধারণত নারীরা বলতে চান না। মানসিক নির্যাতনের বেশির ভাগ ঘটনার তথ্য ঘরের বাইরে আসে না। আমরা শুধু প্রকাশিত তথ্য দিয়ে নির্যাতনের হার কম না বেশি, তা নিরূপণ করছি।
আমরা সমিতির পক্ষ থেকে প্রয়োজনে অপরাধের শিকার ব্যক্তিদের আইনগত সাহায্য করি। সম্প্রতি একজন সাংসদের এপিএস কর্তৃক গাজীপুরে কিশোরী গৃহপরিচারিকা নির্যাতন ও ধর্ষণ, মধুুপুরে কিশোরী গণধর্ষণের ঘটনায় সমিতি ওই কিশোরীদের পাশে দাঁড়িয়ে আইনগত সহায়তা দিয়েছে।
# সংসার, ঘরের বাইরে বা কর্মস্থলে নারীর প্রতি মানসিক নির্যাতন ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এর পেছনে কী কারণ?
সালমা আলী: নারীরা আগের চেয়ে বেশি ঘরের বাইরে কাজ করছেন। তাঁরা নিজেদের যোগ্যতা, দক্ষতা, সততা, আন্তরিকতা কাজে লাগিয়ে কর্মক্ষেত্রে উন্নতি করছেন দ্রুত। ফলে নারীদের সফলতা ঈর্ষণীয়। এতে কিছু কিছু পুরুষ হীনম্মন্যতায় ভুগতে পারেন। এ কারণে নারীর প্রতি মানসিক নির্যাতন বাড়তে পারে। নারীর প্রতি মানসিক নির্যাতনের পেছনে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার পাশাপাশি দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা ও কুসংস্কার দায়ী। পারিবারিক ক্ষেত্রে মানসিক নির্যাতন প্রতিরোধে পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ রয়েছে। তবে পারিবারিক পরিমণ্ডলের বাইরে বা কর্মক্ষেত্রে মানসিক নির্যাতন প্রতিরোধে বাংলাদেশে কোনো আইন নেই। শিক্ষা, চাকরি ও রাজনীতিতে নারী যখন নিজ মেধা, যোগ্যতা ও দক্ষতা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন, তখন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নেতিবাচক মানসিকতার কারণে নারীরা নানা নির্যাতনের মুখোমুখি হচ্ছেন। নারীর প্রতি বৈষম্য, নিষ্ঠুরতা, যৌন হয়রানি ও নিপীড়নসহ সব ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধ না করলে সমাজ থেকে নারী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন। দেশের অর্ধেক জনসংখ্যা এই নারী সমাজকে পিছিয়ে রেখে দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়। তবে সরকারি-বেসরকারি পর্যায় থেকে বিভিন্নমুখী উদ্যোগের ফলে সাধারণ মানুষের সচেতনতা বেড়েছে। ফলে মানুষ, বিশেষত নারীরা নির্যাতনের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। এটাও ঠিক, নারীদের একটা বড় অংশ এখনো তাঁদের অধিকার সম্পর্কে অসচেতন।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অনিকা ফারজানা
সূত্র: প্রথম আলো