banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 343 বার পঠিত

 

বুদ্ধিজীবী বাবার সন্তানদের কথা…

 

”বাবা ডাকতে পারিনি এটা আমাকে ভীষণ কষ্ট দেয়” নাহিদ গুলশান সোমা বাবা ক্যাপ্টেন শফিকুল আনোয়ার ছিলেন পিআইএ’র প্রকৌশলী। তার পোস্টিং ছিল ঢাকায়। একাত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে তিনি একাত্মতা প্রকাশ করেন। ফলে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর তিনি আর চাকরিতে ফিরে যাননি। তিনি বলেছিলেন, এই পাকিস্তানিদের সঙ্গে আর নয়। স্বাধীন দেশে নিজস্ব এয়ারলাইনস গড়ে তুলব। যতদিন তা দাঁড় করতে না পারব ততদিন বিনা বেতনে কাজ করব।

বাবা বিভিন্ন সময়ে আমাদের বাসায় বন্ধুদের নিয়ে গোপন মিটিং করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হল। বাবা পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার কথা ভেবে একপর্যায়ে ফেনীর লেমুয়াতে নানু বাড়িতে নিয়ে যান।সে সময়ে লেমুয়া গ্রামে প্রতি সপ্তাহে একদিন হাট বসত। অক্টোবর মাসের ২৮ তারিখ। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার, হাটবার। বাবা হাটে যান। সেখানে গিয়ে তিনি শুনতে পান মুক্তিযোদ্ধার একটি দল হাটে আসছে। লেমুয়া বাজারের কাছে কালিদহ আর্মি ক্যাম্প ছিল। পাক আর্মি এবং রাজাকাররা হাটে এসে গোলাগুলি শুরু করে। বাবা গোলাগুলির শব্দে লেমুয়া বাজার থেকে বের হওয়ার জন্য ছুটতে থাকেন। পেছন থেকে পাকসেনারা তাকে গুলি করে। গোলাগুলির পরেই এলাকায় কারফিউ দেয়া হয়। ঘর থেকে কেউ বের হতে পারেনি সেদিন। পরের দিন ধানক্ষেতে বাবার উপুড় হওয়া লাশ পাওয়া যায়। আমার বয়স তখন ১৩ দিন। আমাদের চার ভাই-বোনকে নিয়ে শুরু হল আমার মায়ের আরেক যুদ্ধ। পরিবারকে টিকিয়ে রাখার যুদ্ধ। আমাদের মানুষ করার জন্য গৃহিণী থেকে বাংলাদেশ বিমানে যোগদান করেন। চাকরি করে চার সন্তান মানুষ করলেন।আমি কখনও বাবা ডাকতে পারিনি। বাবার ভালোবাসা কেমন হয় অনুভব করতে পারিনি। এটা ভীষণ কষ্ট দেয় আমাকে। যদিও মা আমাদের বাবা-মা উভয়ের দায়িত্বই পালন করেছেন। বাবার পেশা প্রকৌশলী হওয়ায় জীবনযাপনের ধরনও ছিল উন্নতমানের। তার মৃত্যুর পর সেই জীবনযাপনে সন্তানদের মানুষ করা মায়ের জন্য ছিল কষ্টকর। ফলে বাবার অপূরণে সবকিছু পাল্টে যায়। কিন্তু মা আমাদের ভাই-বোনদের কষ্ট দেননি।

মা বড় মেয়েকে ব্যবসায়ী, বড় ছেলেকে প্রকৌশলী, মেজ মেয়েকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে এম.কম করিয়েছেন। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত ও নাট্যকলা বিভাগ থেকে এমএ করি। স্বামী, এক মেয়ে নিয়েই আমার সংসার। মেয়ে পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। ওকে আমি মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাই। মায়ের মুখে শোনা আমার বাবার কথা, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কথা। ও অবাক হয়ে শোনে।

বাবার মৃত্যু খবর শুনে মা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন সখিনা খন্দকার দীপু আমার বাবা খন্দকার আবু তালেবের গল্পগ্রন্থ ‘কাগজের মানুষ’। তিনি ছিলেন সাংবাদিক ও আইনজীবী। শখের বশে গল্প লিখতেন। মিরপুরে ১০ নম্বরের বাড়িটা আব্বা সবেমাত্র করেছেন। পুরো এলাকাটা ছিল বিহারি এলাকা। মার্চ মাস থেকেই মিরপুর এলাকার বিহারিরা বাঙালিদের ওপর নির্যাতন শুরু করে। আব্বা আমাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে মা’সহ আমাদের তিন ভাই-বোনকে ২৪ মার্চ রাজারবাগ ফুফুর বাড়িতে রেখে আসেন। বড় ভাই খন্দকার আবুল হাসান আইএ প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমি মিরপুর বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী। দুই ভাই, এক বোনের মধ্যে আমি ছোট। বাবা ফুফুর বাড়ি যান ২৫ মার্চ। ২৯ মার্চ বাবা মিরপুরে আসেন। বাবার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তিনি কারও কোনো ক্ষতি করেননি, তার ক্ষতিও কেউ করতে পারবে না।

২৯ মার্চ কাদের মোল্লার লোকজন মিরপুর থেকে বাবাকে ধরে জল্লাদখানায় নিয়ে যায়। সেখানে তাকে হত্যা করে। বাবাকে যে কেউ মারতে পারে এটা তার ধারণার বাইরে ছিল, এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তা সত্যি হল না। বাবার কোনো খোঁজ নেই। আমরা বাবার খোঁজ পেতে হন্যে হয়ে খুঁজছি। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার ছিলেন বিহারি। ড্রাইভারের কাছে সংবাদ পাই বাবাকে হত্যা করেছে। বাবার মৃত্যু খবর শুনে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন মা। বাবার মৃত্যুশোক কাটিয়ে ওঠার আগেই বড় ভাই মা, ভাই-বোনের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। পয়সার অভাবে মায়ের সুচিকিৎসা করাতে পারেননি। কিন্তু সন্তানের মতো দেখাশোনা করেছেন। তখন চালের দাম ছিল চড়া। একবেলা ভাত খেলে আরেক বেলা রুটি খেয়েছি। বিহারিরা আমাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আসবাবপত্র থেকে শুরু করে ঘরের দরজা-জানালা সব পুড়ে যায়। তারা ভাবেনি নয় মাসে দেশ স্বাধীন হবে। আমাদের প্রতিটি ঘরে গর্ত করে বিহারিরা বেনারসির তাঁত বসায়।

১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু মিরপুরে নিজের বাড়িতে আসতে পারিনি আমরা। তখনও হানাদাররা মিরপুর দখল করে রেখেছে। ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি মিরপুর হানাদারমুক্ত হয়। বাবা খুব রসিক, মিশুক প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। লেখাপড়া খুব পছন্দ করতেন। আমাদের সময় দিতেন। বাবার স্মৃতি আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। বাবার সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো। সেই ছোট্ট বয়সেই এলাকার লোকজন আমাকে চিনতেন। বাবা বলতেন, তোকে নির্বাচনে দাঁড় করালে জিতে যাবি।

সূত্র- যুগান্তর। আলোকচিত্রী ফয়সাল সিদ্দিক কাব্য ও তানভীর ফেরদৌস।

Facebook Comments