banner

শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 324 বার পঠিত

বিয়ে যদি আবার করতেই হয়!

164

সঙ্গী হারিয়ে কিংবা জীবনের অন্য কোনো বাস্তবতায় দ্বিতীয়বার যদি বিয়ে করতেই হয়, তখন অবশ্যই সন্তানদের সঙ্গে কথা বলে নিতে হবে। তাদের মন বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

জীবনচিত্র ১: সন্তানের নিষেধাজ্ঞা
ক্যানসারে আক্রান্ত স্ত্রীবিয়োগের পর ১৩ বছরের একমাত্র মেয়ে অহনাকে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে রইলেন নিজাম হোসেন। বুকের নোঙর উপড়ে প্রিয়জনেরা এভাবেই চলে যায়। চলে যেতে হবে সবাইকে—এই সত্য উপলব্ধি করে শোক সামলে ঘুরে দাঁড়ালেন ৩৯ বছরের নিজাম।
মায়ের স্মৃতি বুকে নিয়ে শোকে বিহ্বল অহনাও একসময় আবার শুরু করল স্কুলে আসা-যাওয়া। বাবা ছাড়া কিছুই বোঝে না সে। কোনো বিষয়ে ছাড় দিতে চায় না বাবাকে। একদিন খাবারের টেবিলে খোশমেজাজে বাবার উদ্দেশে বলল, ‘তুমি কিন্তু আর কখনোই বিয়ে করতে পারবে না। বিয়ের জন্য আমার অনুমতিও পাবে না, জানিয়ে রাখলাম। মায়ের আসনে আর কাউকে বসতে দেব না আমি, বুঝেছ?’
‘বুঝেছি।’ বললেন নিজাম।

জীবনচিত্র ২: বাপের বাড়ির চাপ
জীবনের বাঁধ ভেঙে গেছে। আচমকা সড়ক দুর্ঘটনায় একেবারেই চলে গেছেন প্রতিষ্ঠিত আস্থাবান স্বামী। কষ্ট সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। তবু চলে জীবন। সময় যায়, শোক স্থিত হতে না হতেই ১০ বছরের মেয়ে আর ১২ বছরের ছেলেকে লালন-পালনের দায়িত্বের শৃঙ্খলে আটকে পড়েন ৩৫ বছরের সানজানা। ধানমন্ডিতে ফ্ল্যাট আছে নিজের নামেই। ব্যাংকে পর্যাপ্ত টাকাসহ আর্থিক নিরাপত্তাও রয়েছে তাঁর। রয়েছে বিত্তশালী বাবা-মায়ের নিঃশর্ত সহায়তা। বেঁচে থাকার জন্য, সন্তানদের মানুষ করার জন্য কোনো বেগ পাওয়ার কথা নয় তাঁর। তবু সানজানার চলার পথে তৈরি হতে লাগল জীবনের নতুন ঘূর্ণি।

স্বামী মারা যাওয়ার দুই বছর পর ঘনিষ্ঠজনেরা আবার বিয়ে করার জন্য ‘স্কাড’ ছুড়তে লাগলেন সানজানার দিকে। আশপাশের পুরুষেরাও নানা কৌশলে ফাঁদ পাততে লাগলেন, প্রলোভিত করতে লাগলেন সানজানাকে। পুরুষদের পাতা ফাঁদ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারলেও স্বজনদের পীড়াপীড়ি থেকে রেহাই পেলেন না তিনি। বিপত্নীক এক প্রকৌশলীকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলেন। সন্তানদের অনুমতি চাইলেন। নীরব হয়ে গেল তারা। হ্যাঁ-না কিছুই না—কোনো প্রতিক্রিয়াও দেখাল না আচরণে।

জীবনচিত্র ৩: চেনা-অচেনা পুরুষের লোভ-লালসা
শ্বশুরবাড়িতে পা দেওয়ার পরই স্বপ্নের পতন ঘটল রাহার। কানকথা ভেসে এল কানে, ‘কেবল চেহারা ফরসা হলে হয়? উচ্চশিক্ষিত হলেই চলবে? মেয়ে তো দেখছি খাটো!’ নতুন জীবনের উচ্ছ্বসিত আনন্দময় মুহূর্তগুলো আচমকা থেমে গেল কানকথার বিষবাণে। জীবনের নোঙর গেড়ে বসেনি আর শ্বশুরবাড়িতে। নিজের বাড়িতে ফিরে আসার পর আর যাননি ওই বাড়ি। আরও নানা তিক্ত কাহিনির পর তালাকনামা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। ডিভোর্সের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই টের পেতে লাগলেন চারপাশের চাপ। মুঠোফোন, ফেসবুক প্রযুক্তির অশুভ আক্রমণসহ চেনা-অচেনা মানুষের আনাগোনা, লোভ-লালসা যেন অরক্ষিত করে তুলল তাঁকে। একই সঙ্গে যুক্ত হলো নিজের বাড়িতে একমাত্র ভাইয়ের বউয়ের নানা কূটচাল। দুর্বিষহ হয়ে উঠল রাহার জীবন।

মনোবিশ্লেষণ
মেয়ে অহনাকে দেওয়া কথা রাখতে পারেননি নিজাম হোসেন। নৈতিকভাবে পুরুষ সত্তার জৈবিক চাহিদা মেটানো, সামাজিকতা রক্ষা করতে গিয়ে বিয়ে করে ফেললেন অবিবাহিত এক তরুণীকে।
আরেকবার জখমপ্রাপ্ত হলো অহনার আবেগ। তার চিন্তার জগৎ ছেয়ে গেল অনিশ্চয়তার কালো মেঘে। মাকে সে হারিয়েছে রোগের কারণে। আর বাবা আবার বিয়ের করার পর তার মনে হতে লাগল, বাবাকে হারাচ্ছে অন্য নারীর কারণে। নিজেকে জখমের পর জখম করে ভুল উপায়ে উপশম ঘটাতে চাইল রক্তাক্ত মনের।
নিজাম কি ভুল করেছেন?
না, বিয়ে করে ভুল করেননি—এই বয়সে আবার বিয়ে করে শরীর-মন, সমাজের দৃষ্টিমতে ঠিক কাজটিই করেছেন তিনি। কিন্তু একটি বড় ভুল করে ফেলেছেন তিনি। বিয়ের আগে অবশ্যই অহনাকে রাজি করিয়ে নেওয়া উচিত ছিল তাঁর। নিজে না পারলে, স্বজনদের উদ্যোগও ব্যর্থ হলে তাঁদের উচিত ছিল অহনাকে মনোচিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসা। তবে নানা জীবনযন্ত্রণা ভোগ করে একসময় অহনা মেনে নেয় সৎমাকে। কিন্তু বাবাকে গোপনে এক শর্ত দেয় সে—যেন নতুন মায়ের কোলে কোনো সন্তান না আসে।
কথা দিয়েও সেই শর্ত রাখতে পারেননি নিজাম। নতুন স্ত্রী গর্ভবতী হয়ে পড়লে বিষয়টি জেনে যায় অহনা। এবার সে আত্মহননের জন্য চূড়ান্ত চেষ্টা করে। হাসপাতাল থেকে জান নিয়ে ফেরত আসে অহনা। উন্নতির একপর্যায়ে মনোচিকিৎসার একটি ধাপে মনোবিদ তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার সবচেয়ে আপন কে?’
‘বাবা ছাড়া কেউ নেই আর।’ সহজ উত্তর অহনার।
‘বাবা কেন তোমার অতি আপন?’
এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারেনি সে। উত্তরটা দিলেন মনোবিদই, ‘তোমার দেহমন জুড়ে রয়েছে তোমার বাবা-মায়ের জিনগত অস্তিত্ব। জিনের তীব্র টানেই বাবার প্রতি তুমি মমত্ববোধ অনুভব করো। তুমিই বলো, বাবা কি চিরকাল বেঁচে থাকবে?’
উত্তর না দিয়ে মাথা নত করে থাকে অহনা।
মনোবিদ আবার বললেন, ‘যে নতুন শিশু তোমার সৎমায়ের পেটে বেড়ে উঠছে, সেও কিন্তু ধারণ করছে তোমার বাবার জিন। মায়ের অংশ না থাকলেও সেই শিশুর মধ্যে জিনগতভাবে তোমার মতোই একই বাবার অস্তিত্ব প্রবহমান থাকবে না? সেই অস্তিত্ব কি তোমার আপন হবে না? কেউ নেইয়ের জগতে কেউ একজন কি আপন হয়ে তোমার পাশে দাঁড়াবে না জেনেটিক কোডের টানের কারণে, কী বলো তুমি?’
এবারও উত্তর দেয়নি অহনা। মনোবিদের দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছিল কেবল। চোখ থেকে ছিটকে বেরোচ্ছিল নতুন আলো, মুখ থেকে নেমে গেল অনিশ্চয়তার কালো মেঘ। আনন্দে মন ভরে না উঠলেও নতুন অতিথিকে মেনে নিয়েছিল সে।
দ্বিতীয় জীবনচিত্রের সানজানাও ভুল করেননি। তবে ভুল করেছিলেন সন্তানের মনোজগৎ যথাযথভাবে বুঝতে না পেরে। ফলে দুই সন্তান মায়ের বিয়ের পর নিরুদ্দেশে বেরিয়ে পড়েছিল। অনেক ভোগান্তির পর তাদের পাওয়া গেলেও ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল ব্যাপক। সেই ক্ষতি পূরণের জন্য এখনো কেঁদে বেড়ান সানজানা। বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ান মনোচিকিৎসকদের চেম্বারে।
তৃতীয় জীবনচিত্রের রাহা পুনরায় বিয়ে না করে বাবা-মায়ের আকুতি-মিনতি উপেক্ষা করে একা চলতে থাকার কারণে জড়িয়ে যান অশুভ জালে—অনৈতিক যৌনতা, মাদক ও অপরাধজগতের জালে জড়িয়ে যান নিজেরই অজান্তে।

তাড়াহুড়া নয়
বিপত্নীক কিংবা বিধবা হলে, ডিভোর্স হলে ঠিক বয়সে, ঠিক সময়ে আবার বিয়ে করা মনস্তাত্ত্বিকভাবে একটা দরকারি পদক্ষেপ। জোর করে বিয়ে টিকিয়ে রাখার প্রবণতা অনেক সময় ভয়াবহ ক্ষতি ডেকে আনে। ডিভোর্স অনিবার্য হলে তা মেনে নিয়ে পরিণতি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা চিন্তা করে ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আবার ঠিক সময়ে পুনরায় বিয়ে না হলে নানা সংকটে জড়িয়ে যেতে থাকেন ভুক্তভোগী—এটিও মাথায় রাখতে হবে। সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী না ঘটলে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, বিষণ্নতাসহ আত্মহননের মতো প্রবণতা ঘনীভূত হতে থাকে মনে। দৈহিক সমস্যা এবং দৈহিক রোগও চক্রবৃদ্ধি হারে জটিল হতে থাকে। সন্তান না থাকলে ডিভোর্সি, বিধবা বা বিপত্নীকদের অবশ্যই দেখেশুনে পুনরায় বিয়ে করা উচিত। শুধু চাপে পড়ে আবেগের বশে যেনতেনভাবে বিয়ে করা বা কারও সঙ্গে তাড়াহুড়া করে জড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়। সময় নিয়ে ধীরেসুস্থে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর মোটামুটি বোঝার বয়সী সন্তান থাকলে তাদের রাজি করিয়ে বা অনুমতি নিয়ে আবার বিয়ের জন্য এগোনো উচিত। এ ক্ষেত্রেও সময় নেওয়া জরুরি। অবুঝ সন্তান থাকলে আবার বিয়ে করা বা না-করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে সচেতন হতে হবে অবশ্যই। এ ক্ষেত্রে সামাজিকতা, শিক্ষাগত যোগ্যতা ও আর্থিক নিরাপত্তার কথা মাথায় রাখতে হবে। বিয়ে না করে থাকলে যেমন ভেতরের জৈবিক তাড়না বা চাপ সৃষ্টি করতে পারে, তেমনিভাবে বাইরের জগতের চাপও আবেগে তৈরি করে অনিয়ন্ত্রিত ঘূর্ণি। এ অবস্থায় যখন-তখন মেজাজের বিস্ফোরণ ঘটে, রাগ-ক্রোধ উসকে ওঠে, চারপাশের সম্পর্কগুলো তখন জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে।

সন্তান অধিকৃত সম্পত্তি নয়
অনেকে দৃঢ়ভাবে সন্তানকে বুকে নিয়ে পার করে দিতে চান পুরো জীবন। তাঁরা সন্তানকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চান, অধিকৃত সম্পত্তি হিসেবে ভাবতে চান নিজেদের অজান্তে। কিন্তু সন্তান বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজের আবেগ ও স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তার কারণে প্রকৃতিগতভাবে জড়িয়ে যায় অন্য তরুণ-তরুণীর সঙ্গে। অনেক ক্ষেত্রে মা আরও বেশি একা হয়ে পড়েন এ সময়। এই একাকিত্ব তখন তাঁদের কুরে কুরে খায়। সময় ফুরিয়ে যাওয়ার কারণে ভুক্তভোগীদের আর কিছুই করার থাকে না। হতাশা ও বিষণ্নতা হয় তাদের জীবনের নিত্য সঙ্গী। মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক রীতিনীতির কারণে নর-নারী আবার বিয়ের কথা ভাবতেই পারেন।
*লেখায় উল্লেখ করা সব চরিত্রে ছদ্মনাম দেওয়া হয়েছে।
লেখক: অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও কথাসাহিত্যিক।
drmohitkamal@yahoo.com

Facebook Comments