পৃথিবীর সমস্ত সম্পর্ক কি কেবল ভালোবাসার সুতোয় বাঁধা?
একত্রে বছরের পর বছর কাটিয়ে দেওয়া সেই সমস্ত দাম্পত্য জীবনের ভিত কি প্রতিদিনের পরম মুগ্ধতায় গড়া?
না, প্রেমের সেই একরঙা কল্পনায় সত্যি মেলে না।
জীবন আসলে এক সমান্তরাল দুই ধারার যাত্রা, যেখানে একদিকে রোদ, অন্যদিকে ছায়া। একজন চায় ফ্যানের শীতল ঝাপটা, অন্যজনের দরকার এসির স্থির প্রশান্তি। কেউ রাত্রে আলো জ্বালিয়ে ঘুমায়, কেউ চায় নিঃশব্দ অন্ধকার। কেউ রেস্টুরেন্টে খেতে ভালোবাসে, আরেকজনের চোখে বাড়ির ভাতেই থাকে শান্তি। কেউ দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে, কেউ আবার সূর্য ওঠার আগেই দিন শুরু করে।
মতের এই অমিল, চাওয়া-পাওয়ার এই টানাপড়েনের মধ্যেই জন্ম নেয় এক গভীর সখ্যতা, যা প্রেমের চেয়েও দীর্ঘস্থায়ী।
অনেকেই ভাবেন—একসাথে থাকার মানে, একে অপরের ছাঁচে নিজেকে ঢেলে ফেলা। কিন্তু না, আসল সম্পর্ক তৈরি হয় যখন একজন আরেকজনের ভিন্নতাকে জড়িয়ে ধরে। প্রতিদিনের ছোট ছোট খুনসুটি, কারণহীন ঝগড়া, কিছুটা অভিমান—এসবই আসলে এক অন্য ভাষায় বলা ভালোবাসা। সেই ভালোবাসা চোখে পড়ে না, তবুও অনুভবে ছুঁয়ে যায়।
ভাবতে পারেন, একদিকে এত অমিল—তারপরও দেখা যায় সেই দুই মানুষ একদিন পাহাড়ে ঘুরতে যাচ্ছে, কাঁধে মাথা রেখে ছবি তুলছে, একসাথে সিনেমা দেখছে, নতুন গাড়ির স্বপ্ন দেখছে, মনের মতো করে সাজিয়ে নিচ্ছে তাদের ছোট্ট ঘরটা।
এটাই তো সম্পর্কের সৌন্দর্য। এই অমিলের ভেতরেই লুকিয়ে থাকে অদ্ভুত এক সমীকরণ, যাকে ছকে ফেলেও মেলানো যায় না।
আমরা সম্পর্কের শুরুতে যা করি, সেটাই সবচেয়ে বড় ভুল—আমরা মিল খুঁজি। কে কী পছন্দ করে, কার সঙ্গে কতটা মিলে যায়—সেই হিসেব কষি। অথচ, যেটা মিলছে না, সেটাই তো আসল দেখার জায়গা।
ভালোবাসা গড়ে ওঠে মতের মিল দিয়ে নয়—মতের অমিল আর মনের মিল দিয়ে।
জীবনটা আসলে একটা দীর্ঘ উপন্যাস। প্রতিটি অধ্যায়ে মতের দ্বন্দ্ব, কিছু ঝগড়া, কিছু অভিমান থাকবেই। কিন্তু সেই বইয়ের পাতাগুলো ভরে ওঠে যদি প্রতিটি বাক্যে থাকে সহানুভূতি, সম্মান আর একটুখানি হাসি।
তাই, সারাটা জীবন ভালোবাসবে এমন কাউকে খোঁজার দরকার নেই। বরং এমন কাউকে খুঁজুন, যার সঙ্গে আপনি প্রতিদিন একটু একটু ঝগড়া করেও ভালো থাকতে পারেন।
কারণ দিনের শেষে, ভালোবাসা মানে সারাক্ষণ একসাথে হাসা নয়—বরং ঝগড়ার মাঝেও আলতো করে হাতটা ধরে রাখা।
মতের অমিল থাকুক, থাকুক হাজারটি।
শুধু যেন মনের মিলটা থেকে যায়…
ঠিক বাতাসের মতো—দেখা যায় না, কিন্তু গায়ে লাগলেই বোঝা যায়, শান্তি দেয়।