banner

শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫ ইং, ,

পোস্টটি 24 বার পঠিত

 

শিশুরা কি জন্মগতভাবে সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী? গবেষণার দুই মেরু দৃষ্টিভঙ্গি

 

মানুষ জন্মগতভাবে বিশ্বাসী—এটা তো আমরা অনেকেই জানি বা মানি। তবে প্রশ্ন হলো, “মানব শিশু কি জন্মগতভাবেই সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাসী?” এই দাবি একজন বিশিষ্ট গবেষকের—অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন অধ্যাপক জাস্টিন এল. ব্যারেট। উন্নয়নমূলক মনোবিজ্ঞান, সাংস্কৃতিক পার্থক্য ও নানা রকম মানসিক পরীক্ষার উপর ভিত্তি করে তিনি দাবি করেন, শিশুদের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবেই কোনো এক সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস গড়ে ওঠে। এই দীর্ঘ গবেষণার ভিত্তিতেই তিনি লিখেছেন Born Believers নামের বইটি (২০১২), যেখানে তাঁর ও সহ-গবেষক নিকোলা নাইটের কাজের সারাংশ তুলে ধরা হয়েছে।

অক্সফোর্ডের একটি ডকুমেন্টারিতে ব্যারেট বলেন, শিশুরা যখন বেড়ে ওঠে, তখন তারা চারপাশের জগতের জটিলতাকে দেখে মনে করে—এসব কিছু নিশ্চয়ই কেউ না কেউ তৈরি করেছেন। এটা যেন তাদের মস্তিষ্কের একটা স্বাভাবিক প্রস্তুতি, যেটা পরিবেশের ওপর নির্ভর করে না। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় তিন বছর বয়স থেকেই শিশুরা অতিপ্রাকৃত কোনো সত্ত্বার অস্তিত্বে বিশ্বাস করতে শুরু করে। সূর্য দেবতা, প্রকৃতির আত্মা, এমনকি ঈশ্বরের ধারণা—এসব বিষয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি নানা সংস্কৃতিতে একরকম রয়ে যায়। তবে তারা বড়দের মতো একমাত্রিক বা ধর্মবিশেষভিত্তিক ভাবনায় আটকে থাকে না। বরং তারা এসব সত্ত্বাকে “সবজান্তা” বা অত্যন্ত জ্ঞানী হিসেবে দেখে।

জাস্টিন ব্যারেট মনে করেন, শিশুরা জন্ম থেকেই ‘ক্রিয়েটর’ বা ‘সৃষ্টিকর্তা’র ধারণা ধারণ করতে প্রস্তুত থাকে। তাদের বিশ্বাসের ভিত্তি আগে থেকেই থাকে, কেবল বড় হয়ে সেই বিশ্বাসে ধর্মীয় কাঠামো বা সংস্কৃতির ছোঁয়া পড়ে।

তবে, এই দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে রয়েছে আরেকটি গবেষণা। ”Genius Science” নামের একটি বৈজ্ঞানিক সাময়িকীর জুলাই সংখ্যায় প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়—শিশুদের অতিপ্রাকৃত বিষয়ে বিশ্বাস মূলত শেখানো জিনিস। ক্যাথলিন করিভিউ নামের এক গবেষক এবং তার দল ৬৬ জন শিশুর উপর তিন ধরনের গল্পের ভিত্তিতে পরীক্ষা চালান—ধর্মীয়, ঐতিহাসিক এবং রহস্যভিত্তিক।

গবেষণায় দেখা যায়, ঐতিহাসিক গল্পগুলোকে প্রায় সব শিশুই সত্য হিসেবে নিয়েছে। তবে ধর্মীয় গল্পে পার্থক্য দেখা গেছে—যারা ধর্মীয় পরিবেশে বড় হয়েছে, তারা সেগুলোকে সত্য ধরে নিয়েছে; অন্যদিকে যারা ধর্মনিরপেক্ষ পরিবেশে বড় হয়েছে, তারা সেগুলোকে রূপকথা বলেই মনে করেছে। রহস্যমূলক গল্পেও এমনই পার্থক্য দেখা গেছে।
ক্যাথলিন করিভিউর মতে, ধর্মীয় গল্প ও বিশ্বাসে বেড়ে ওঠা শিশুরা বাস্তব আর কল্পনার সীমারেখা আলাদা করতে তুলনামূলকভাবে কম সক্ষম হয়। তবে তিনি এটাও স্পষ্ট করেন—এটা যে ক্ষতিকর, এমনটা নয়। বরং বাস্তববাদী জ্ঞান এবং ধর্মীয় বিশ্বাস—দুটোই একসাথে শেখানো দরকার।
এই প্রসঙ্গে ব্যারেটের প্রতিক্রিয়া ছিলো, “ধর্মনিরপেক্ষ শিশুদের আচরণই বরং অস্বাভাবিক।” তিনি মনে করেন, করিভিউর গবেষণাটি ম্যাসাচুসেটসের মতো একটি ধর্মনিরপেক্ষ এলাকায় পরিচালিত হওয়ায় সেখানকার শিশুদের ফলাফলকে সাধারণ শিশুদের মানসিকতার প্রতিফলন হিসেবে ধরা ঠিক নয়।

তবে এক জায়গায় দুজন গবেষকই একমত—শিশুদের চিন্তা-চেতনা গড়ে ওঠার পেছনে পরিবার, সমাজ ও সংস্কৃতির গভীর প্রভাব রয়েছে।

এই দুই গবেষকের বক্তব্য এবং গবেষণালব্ধ প্রমাণ পড়ার পর আমার কাছে যেটা স্পষ্ট হয়েছে, তা হলো—শিশুরা একদিকে যেমন শোষণক্ষম, অন্যদিকে কিছু কিছু ধারণা তারা যেন জন্মগতভাবেই ধারণ করে। ব্যারেটের মতে, শিশুদের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে একজন সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস গড়ে ওঠে। আর করিভিউর গবেষণা বলছে—এই বিশ্বাস আসলে শেখানো হয়।

আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি হলো, শিশুদের মন একদম খোলা মাঠের মতো। সেখানে তারা যা দেখে, যা শোনে, তাই থেকে বিশ্বাস গড়ে তোলে। তারা কল্পনা করে, প্রশ্ন করে, শেখে—আর এই শেখার উৎস যদি হয় যুক্তি বা বাস্তবতা, কিংবা ধর্মীয় বিশ্বাস—তবে তার প্রভাব পড়বেই।
তাই হয়তো বলা যায়, শিশুরা জন্ম থেকে নির্দিষ্ট কোনো বিশ্বাস নিয়ে আসে না, তবে তারা বিশ্বাস গড়তে সক্ষম একেকটি সম্ভাবনাময় চিন্তাশক্তির ধারক। তাদের সামনে বাস্তবতা, কল্পনা, ধর্ম এবং যুক্তি—সব কিছুরই পরিসর খুলে দিতে হবে, যেন তারা নিজের মতো করে বুঝে নিতে পারে কোনটিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবে।

আরওয়া আনাম

Facebook Comments