বর্তমান সময়ে শিশুরা আগের চেয়ে বেশি সময় স্ক্রিনের সামনে কাটাচ্ছে। স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ কিংবা টেলিভিশনের প্রতি তাদের ঝোঁক এতটাই বেড়েছে যে সাধারণ কিছু কাজ করতেও তারা এখন হিমশিম খায়। জুতার ফিতা বাঁধা, বোতাম লাগানো, চামচ ধরা, কাঁচি চালানো কিংবা কলম দিয়ে ঠিকমতো লেখা—এসব কাজ আগের তুলনায় অনেক শিশুর জন্য কঠিন হয়ে উঠেছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিশুরা এখন হাতে-কলমে কাজ কম করছে, ফলে তাদের ফাইন মোটর স্কিলস (Fine Motor Skills) গড়ে ওঠার সুযোগ কমে যাচ্ছে। ফাইন মোটর স্কিলস হলো আমাদের হাত ও আঙুলের সূক্ষ্ম নড়াচড়ার ক্ষমতা, যা লেখা, আঁকা, জুতা বাঁধার মতো কাজে দরকার হয়। কিন্তু প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে শিশুরা এসব কাজে দক্ষতা হারাচ্ছে।
এই প্রবণতা নতুন কিছু নয়, তবে কোভিড-১৯ মহামারির সময় এটি আরও প্রকট হয়েছে। মহামারির সময় শিশুরা ঘরবন্দি ছিল, স্কুলে যেতে পারেনি, খেলাধুলার সুযোগ কমে গিয়েছিল। অনেকেই তখন অনলাইনে পড়াশোনা করত, যার ফলে হাতে-কলমে লেখার চর্চা কম হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, মহামারির সময় যারা জন্মেছে, তারা ছয় মাস বয়সে ফাইন মোটর স্কিলস পরীক্ষায় তুলনামূলকভাবে খারাপ ফল করেছে। কিছু গবেষক মনে করেন, এর কারণ হতে পারে মায়ের মানসিক চাপ, আবার কেউ বলেন, শিশুদের বেড়ে ওঠার পরিবেশ বদলে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে।
তবে শুধু মহামারি নয়, এর অনেক আগে থেকেই শিশুরা হাতে কাজ করার সুযোগ হারাচ্ছে। একসময় শিশুরা পাজল খেলত, কাঠের ব্লক দিয়ে টাওয়ার বানাত, রঙ করত, কাটাকুটি করত। এসব কাজ শিশুদের ধৈর্য বাড়াতে এবং হাতের ওপর নিয়ন্ত্রণ তৈরি করতে সাহায্য করে। কিন্তু এখন তারা বেশি সময় স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে, ফলে হাতের ব্যবহার কমে গেছে। অনেকে মনে করেন, ডিজিটাল মাধ্যমে পড়াশোনা বা ছবি আঁকা করাও উপকারী হতে পারে, কিন্তু এতে হাতে-কলমে কাজ করার যে বাস্তব অভিজ্ঞতা দরকার, তা তৈরি হয় না।
শিশুরা শুধু ফাইন মোটর স্কিলস নয়, বই পড়ার অভ্যাসও হারাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুরা আগের তুলনায় বিনোদনের জন্য বই পড়ছে অনেক কম। অথচ বইয়ের পাতা উল্টানো, মনোযোগ ধরে রাখা, শব্দ অনুসরণ করা—এসবই তাদের হাতের সূক্ষ্ম নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বাড়ায়।
এই সমস্যার সমাধান কী?
শিশুদের স্ক্রিন থেকে পুরোপুরি দূরে রাখা সম্ভব নয়, তবে তাদের হাতে-কলমে কাজ করার অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি। অভিভাবকরা চাইলে সহজ কিছু উপায়ে শিশুর ফাইন মোটর স্কিলস বাড়াতে পারেন।
একটি ভালো উপায় হলো শিশুদের বেশি করে লেখার সুযোগ দেওয়া। রঙ করা, কাটাকুটি করা, পেন্সিল দিয়ে ছবি আঁকা—এসব কাজ তাদের হাতের শক্তি বাড়ায়। ব্লক গেমস বা লেগো খেলতে দিলে শিশুরা হাতের নড়াচড়ায় আরও দক্ষ হয়ে ওঠে। জুতার ফিতা বাঁধতে শেখানো, বোতাম লাগাতে দেওয়া, রান্নার ছোটখাটো কাজে যুক্ত করা—এসবও সাহায্য করতে পারে।
এছাড়া, শিশুরা যাতে বই পড়ায় উৎসাহিত হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাদের হাতে গল্পের বই তুলে দিলে তারা পাতা উল্টানোর অভ্যাস করতে পারবে, যা তাদের হাতের সূক্ষ্ম নড়াচড়ার জন্য ভালো।
শিশুরা প্রযুক্তির সঙ্গে বেড়ে উঠবেই, তবে প্রযুক্তির পাশাপাশি হাতে-কলমে কাজ করার অভ্যাস তৈরি করাও গুরুত্বপূর্ণ। অভিভাবকরা যদি সচেতন হন এবং শিশুদের হাতে কাজ করার সুযোগ বেশি করে দেন, তাহলে তারা এই দক্ষতা ফিরে পেতে পারবে।