সম্প্রতি রাজধানীর কলাবাগানে মাস্টারমাইন্ড স্কুলের ১৭ বছরের কিশোরীকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছে সদ্য কিশোর বয়স পার করা তার ১৮ বছরের এক বন্ধু।
চলতি বছরের শুরুর দিকেই রাজধানীর কামরাঙ্গী চরের কয়লাঘাট এলাকায় পায়ে পাড়া দেওয়ার মতো তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে হত্যা করা হয়েছে সিফাত নামের ১২ বছর বয়সি এক শিশুকে।
এ ঘটনায় যে ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়- তাদের সবার বয়সও ১০ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। শুধু এ দুটি ঘটনাই নয়, প্রায়ই ধর্ষণ, ইভটিজিং, চুরি, আত্মহত্যা, মাদকসেবন, হত্যা থেকে শুরু করে এমন সব লোমহর্ষক কর্মকাণ্ড আমরা আশপাশে দেখি কিংবা পত্রিকা বা সংবাদের মাধ্যমে জানতে পারি যেখানে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় ভুক্তভোগী এবং অভিযুক্ত দু’জনই অপ্রাপ্তবয়স্ক।
এ বিষয়ে এভারকেয়ার হাসপাতালের মনস্তত্ত্ববিদ তারানা আনিস বলেন, ‘কিশোর-কিশোরীরা অপরাধ প্রবণতার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে। শিশু বিকাশের কয়েকটি ধাপ রয়েছে এবং প্রতিটি ধাপের কিছু চাহিদা বা বৈশিষ্ট্যও রয়েছে। কিশোর বয়সে মনের মাঝে নানারকম অ্যাডভেঞ্চার কাজ করে। এ বয়সে তারা নিজেকে প্রকাশ করতে চায়। আত্মপ্রকাশের চাহিদা তাদের কৌতূহলপ্রিয় করে তোলে। কৌতূহলের বশে তারা নতুন কিছু জানতে চায়, করতে চায়। তাদের একটা আলাদা জগৎ থাকে, মতামত থাকে। তারা চায় তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হোক। সামান্য প্রলোভন, কৌতূহল, আনন্দ ও ক্রোধ তাদের আলোড়িত করে। যা অনেক সময় কিশোর-কিশোরীদের বিপথগামী করে তোলে। তাদের বাধা দেওয়া হলে, তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া না হলে তারা সেই কাজটি করার জন্য আক্রমণাত্মক ও অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে।’
করোনার কারণে অনেকদিন ধরেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। এখন ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট থেকে শুরু করে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কাজ অনলাইনে করতে হচ্ছে। আবার বাইরে যাওয়ার সুযোগ কমে যাওয়ায়, ইনডোর-আউটডোর গেমের সুযোগ কমে যাওয়ায় বর্তমানে ইন্টারনেটেই শিশু-কিশোরদের বেশিরভাগ সময় কাটছে। এ সুযোগে তারা ইন্টারনেটে নানা ধরনের প্রাপ্তবয়স্ক মুভি দেখছে, গেম খেলছে, সামাজিক মাধ্যমে আসক্ত হয়ে পড়ছে। ইন্টারনেটে মারামারি, ধ্বংসাত্মক গেম খেলে কিশোরীরা বাস্তবেও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে। সিনেমা, অপরাধবিষয়ক বিভিন্ন সিরিয়াল দেখে তারা অপরাধ সংঘটনের বিভিন্ন কৌশল শিখছে। চাওয়া-পাওয়া বা মতের মিল না হলে, ধর্ষণে বাধা দিলে খুন করে ফেলছে বন্ধু বা সহপাঠীকেই।
মনস্তত্ত্ববিদ তারানা আনিস জানান, ‘বয়ঃসন্ধিক্ষণে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে হরমোনাল চেঞ্জ হয়। এ বয়সে তাদের সেক্সের প্রতি আগ্রহ, কৌতূহল তৈরি হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সেক্স রিলেটেড বিষয়গুলো নিয়ে আমরা সন্তানদের সঙ্গে খোলামেলা আলাপ করি না। সচেতন করারও প্রয়োজন বোধ করি না। এতে করে তারা সেক্স রিলেটেড বিষয়গুলো বন্ধুবান্ধব, সহপাঠীদের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করে। এতে অনেক ক্ষেত্রেই এ বিষয়ে তারা ভুল ইনফরমেশন পায়। যেটা তাদের ভুলের দিকেই প্রভাবিত করে। এমনও হচ্ছে কিশোর বা কিশোরীরা হয়তো শিক্ষামূলক কোনো কনটেন্ট গুগলে সার্চ করছে কিন্তু পাশে প্রাপ্তবয়স্ক বা নিষিদ্ধ কোনো কনটেন্ট চলে আসছে- এসব কনটেন্ট কিন্তু তাদের কৌতূহল প্রবণ করে তোলে। আবার ওই কনটেন্টটি সামনে চলে আসার মুহূর্তে অনেক সময় মা-বাবা তা দেখে ফেলছে এবং সন্তানকে এসব দেখার কারণে বকাঝকা করছে। এতে কিন্তু ওর মধ্যে মা-বাবা ওকে ভুল বুঝল এমন একটা ধারণা জšে§, সঙ্গে লুকোচুরি করে এ জিনিসগুলো দেখার প্রতি আগ্রহ তৈরি করে।’
শুধু ইন্টারনেট বা বাবা-মায়ের অতিশাসন নয়, মাতা-পিতার অযত্ন-অবহেলা, উদাসীনতা, সন্তানকে প্রয়োজনীয় ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা না দেওয়া, পিতা-মাতার ঝগড়া বিবাদ, ভাঙন, দারিদ্র্য, আর্থিক প্রাচুর্যতা, সুষ্ঠু বিনোদনের সংকট, মাদকসেবন, খারাপ সঙ্গসহ আরও বিভিন্ন কারণ কিশোরদের অপরাধী করে তোলে।
‘কিশোর বয়সে সন্তানকে খারাপ সঙ্গ থেকে দূরে রাখতে সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। তাকে তার মতো করেই বুঝতে হবে, মিশতে হবে। মনে করুন আপনি আপনার মেয়ের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশলেন। সেই বন্ধুত্ব থেকে আপনার মেয়ে আপনাকে এসে বলল মা ওই ছেলেটা আমাকে প্রোপোজ করেছে। এটা শুনে আপনি তাকে বকাঝকা করলেন কিংবা এ জন্য তাকেই দোষারোপ করলেন- এটা কিন্তু সঠিক পদ্ধতি নয়। আপনার সন্তানের সঙ্গে বন্ধু হয়েই তাকে ধীরে ধীরে বিষয়টির নেগেটিভ দিকগুলো বুঝাতে হবে। সন্তানের সঙ্গে ইভেকটিভ কমিউনিকেশন বাড়াতে হবে। অর্থাৎ তাদের কথাগুলো মন দিয়ে শুনতে হবে। তারা কী বলতে চাচ্ছে সেটা বোঝার চেষ্টা করতে হবে এবং জাজমেন্টাল না হয়ে অনেক বিষয় চিন্তা করে তারপর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পাশাপাশি তাকে সমান হিসাবে বিবেচনা করতে হবে। বাসার কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার মতামতকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে’- বলে তিনি মনে করেন ।
বাবা-মায়ের মধ্যে যদি সব সময় ঝগড়া বিবাদ লেখে থাকে, তাদের মধ্যে যদি সম্মানসূচক সম্পর্ক না থাকে তাহলে সন্তানরাও এ ধরনের নেতিবাচক আচরণ শিখে। কারণ তারা যত না শুনে শেখে তার চেয়ে অনেক বেশি দেখে শেখে। আপনি সন্তানকে বলছেন মোবাইল না চালাতে, টিভি না দেখতে কিন্তু আপনি নিজে সারাক্ষণ মোবাইল নিয়ে পড়ে আছেন, সিরিয়াল দেখছেন। এতে কিন্তু আপনার কথাগুলো আপনার সন্তান মান্য করবে না। কারণ বড়রা বা বাবা-মা যেটা করে না শিশুরা ধরেই নেয় যে, তারা সেটা না করলেও চলবে।
সন্তানকে রক্ষা করা বাবা-মায়ের দায়িত্ব। তবে সন্তানকে বিপদ থেকে রক্ষার জন্য সর্বক্ষণ চোখে চোখে রাখা কোনো ভালো অভ্যাস নয়। সন্তান কার সঙ্গে মিশল, ইন্টারনেটে কী করছে এ বিষয়গুলো অবশ্যই মনিটরিং করতে হবে। কিন্তু এ মনিটরিং যেন টর্চারের মতো না হয়। সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। সেই সঙ্গে শুধু সন্তান ঠিকমতো খাচ্ছে কিনা বা ঘুমাচ্ছে কিনা এ বিষয়গুলো চিন্তা না করে তার সঙ্গে কানেকশন বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। কারণ সন্তানকে কারেক্ট করার চেয়ে তার মনোজগতের সঙ্গে কানেকশন বাড়ানো বেশি জরুরি। এতে করে সে ভুল পথে পা বাড়ানোর আগেই আপনি তা বুঝতে পারবেন এবং সংশোধনের সুযোগ পাবেন।
হাজার ব্যস্ততার মাঝেও বাবা-মায়েদের সন্তানের সঙ্গে গুণগত সময় ব্যয় করতে হবে। তাদের ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে। ছোটবেলা থেকে ছেলেমেয়েদের একসঙ্গে মিশতে দিতে হবে। এতে বড় হলে কিশোরদের সহপাঠী বন্ধু বা মেয়েদের প্রতি অতি কৌতূহল তৈরি হবে না। স্কুলগুলোতে পাঠ্যসূচিতে সেক্স এডুকেশন অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং ক্লাসে আলোচনা করতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।-যুগান্তর