কৃমি এক ধরনের অন্ত্রের পরজীবী যা শিশুদের অন্ত্রে বসবাস করে এবং বাচ্চাদের খাদ্য থেকে তাদের পুষ্টি অর্জন করে, যার ফলে বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে পড়ে। কৃমির সংক্রমণ, হেলমিন্থ সংক্রমণ নামেও পরিচিত, এটি শিশুদের মধ্যে পেটে ব্যথার প্রধান কারণগুলির মধ্যে একটি। এই সংক্রমণ খুব সাধারণ এবং সহজেই এর চিকিৎসা করা যেতে পারে। বিভিন্ন ধরনের কৃমি, তাদের কারণ, উপসর্গ এবং চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতন হওয়া সবসময় ভাল, যাতে আপনার বাচ্চার যদি কৃমির সংক্রামণ হয়ে থাকে তবে আপনি তাকে সময়মত চিকিৎসা পেতে সহায়তা করতে পারেন।
- কৃমির সংক্রমণ কত রকমের হয়:
মানুষের দেহের বিভিন্ন অংশে সংক্রামিত ও প্রজননকারী বিভিন্ন প্রকারের কৃমি আছে। সেগুলো বিভিন্ন সাইজের এবং প্রকারের হয়। ছোট বা বড়, চ্যাপ্টা না গোল হতে পারে এবং চোষক বা তিনটে ঠোঁট যুক্ত হয় এবং কোনো পা থাকে না। শিশু এবং ছোট বাচ্চাদের সংক্রামিত সবচেয়ে সাধারণ কৃমিগুলি হল: - ফিতাকৃমি
ফিতাকৃমি যাদের চ্যাপ্টাকৃমিও বলা হয়, তারা তাদের ত্বকের মাধ্যমে শ্বাস নিয়ে অক্সিজেন ও পুষ্টি গ্রহণ করে তাদের হুক এবং চোষক আছে যা অন্ত্রের সাথে যুক্ত হয় এবং তারা আশ্রয়দাতার শরীরের আংশিক হজম হওয়া খাদ্যের উপর প্রজনন সম্পন্ন করে। একটি ফিতাকৃমির দৈর্ঘ্য কয়েক ইঞ্চি থেকে ৪০ ফুট বা তার বেশি হতে পারে। সাধারণত দূষিত খাবারের মাধ্যমে তাদের ডিম বা লার্ভা শিশুদের পাকস্থলীতে প্রবেশ করে।
- গোলকৃমি
গোলকৃমির সংক্রমণ, যা “অ্যাস্কারিয়াসিস” নামেও পরিচিত, তা অ্যাস্কারিস লাম্ব্রিকয়েডস্ কৃমি দ্বারা সৃষ্ট। এগুলো ফাঁপা, কেঁচোর মতো একই রকম দেখতে এবং দৈর্ঘ্যে ৩০ থেকে ৩৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বড় হতে পারে। গোলকৃমি নোনাজল, মাটি বা পরিস্কার জলের মধ্যে বাস করে এবং এই কৃমিগুলি গৃহপালিত পশুদের মধ্যে সাধারণত দেখা যায় যেখান থেকে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। গোলকৃমির লার্ভা প্রায়ই অন্ত্র থেকে রক্ত প্রবাহে প্রবেশ করে এবং ফুসফুস পর্যন্ত বাহিত হয়।
- কুঁচোকৃমি বা সুতাকৃমি
কুঁচোকৃমিকে সুতাকৃমিও বলা হয়, কারণ তারা ক্ষুদ্র, পাতলা, সাদা এবং সর্বদা নড়াচড়া করে এমন কৃমি যা মলদ্বারে বসবাস করে। স্ত্রী কৃমি মলদ্বারের আশেপাশে ডিম পাড়ে। এই ডিম কাপড়, বিছানা এবং অন্যান্য উপকরণের উপর বেঁচে থাকতে পারে এবং স্পর্শ বা শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। সুতাকৃমির সংক্রমণ শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।
- হুকওয়ার্ম
হুকওয়ার্ম সাধারণত খারাপ নিকাশী ব্যবস্থাযুক্ত স্থানে পাওয়া যায়। হুকওয়ার্মগুলি ক্ষুদ্র পরজীবি কৃমি, তাদের মুখে কাটিং প্লেট থাকে, যার মাধ্যমে তারা অন্ত্রের প্রাচীরের সাথে সংযুক্ত হয়। দূষিত মাটির সংস্পর্শে শিশুটি সংক্রমিত হয়। হুকওয়ার্ম লার্ভা মানুষের পায়ের ত্বকের মাধ্যমে প্রবেশ করে রক্ত প্রবাহে প্রবেশ করতে পারে।
- কিভাবে জানা যাবে আমার বাচ্চা কৃমি দ্বারা সংক্রামিত কিনা?
প্রায়ই, শিশুর কৃমি সংক্রমণের কোনো উপসর্গ দেখা যায় না। সংক্রমণ খুব হালকা হতে পারে সুতরাং উপেক্ষা করা হয়। আপনি যদি নিজেকে জিজ্ঞেস করেন, ‘বাচ্চাদের কি কৃমি হতে পারে?’ উত্তরটি হল হ্যাঁ; এমনকি শিশুরাও কৃমি দ্বারা সংক্রামিত হতে পারে। উপদ্রবের ধরণ এবং তীব্রতার উপর নির্ভর করে, আপনার নিম্নলিখিত সতর্কতা লক্ষণগুলি অনুসন্ধান করা উচিত:
- থুথু ফেলা: শিশুটি বিনা কারণে প্রায়ই থুতু ফেলতে শুরু করে কারণ কৃমি মুখের মধ্যে লালা বাড়িয়ে দেয়।
মারাত্মক দুর্গন্ধযুক্ত মল: শিশুর মারাত্মক দুর্গন্ধযুক্ত মলের অর্থ হল কৃমির কারণে পেটে সংক্রমণ।
মলদ্বারের কাছাকাছি চুলকানি: স্ত্রী কৃমি সাধারণত ডিম দেওয়ার জন্য মলদ্বারে চলে যায়, যা মলদ্বারের চারপাশে জ্বালা ও অস্বস্তি সৃষ্টি করে।
পেট ব্যথা: এটি অন্ত্রে কৃমি থাকার সবচেয়ে সাধারণ চিহ্ন।
ঘুম ব্যাহত হওয়াঃ চুলকানি, পেট ব্যথা এবং অস্থিরতা যৌথভাবে শিশুর ঘুমকে ব্যাহত করে। - বাচ্চাদের কৃমি সংক্রমণের অন্যান্য লক্ষণ ও উপসর্গ:
শিশুরা কদাচিৎ সংক্রামিত হওয়ার লক্ষণগুলি প্রদর্শন করে, এবং যদি তাই হয়, তবে ক্ষতিকারকতা সর্বনিম্ন হতে পারে। এটা, তাই, নাও লক্ষণীয় হতে পারে। যাইহোক, লক্ষণগুলির বিষয়ে সচেতন হওয়ার সুপারিশ করা হয় এবং সন্দেহ থাকলে শিশুকে পরীক্ষা করা উচিত। বাচ্চাদের মধ্যে বিদ্যমান বিভিন্ন ধরণের কৃমি সংক্রমণগুলি কমবেশি একই রকম উপসর্গ সৃষ্টি করে। সেগুলি নিম্নলিখিত: - পেট ব্যথা
- অবসাদ
- ডায়রিয়া
ওজন হ্রাস পাওয়া - বমি
ক্ষুধামান্দ্য - ঘুমের অভাব
জন্ডিস - খিটখিটেভাব
পেটে অস্বস্তি - পেট খারাপ
- ফুসকুড়ি, আমবাত, কালশিটে এবং অন্যান্য এলার্জির মত ত্বকের অবস্থা
- পরজীবী বিপাকীয় বর্জ্য দ্বারা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের জ্বালার কারণে সৃষ্ট অস্থিরতা এবং উদ্বেগ
- ক্লান্তি এবং শক্তির অস্বাভাবিক পরিবর্তন
- ঘন ঘন গ্যাস এবং পেট ফাঁপা
- কোষ্ঠকাঠিন্য
- আচরণগত পরিবর্তন
- শিশুদের কৃমি সংক্রমণের কারণ কী কী?
শিশুদের এবং অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের ক্রমাগত হামাগুড়ি দেওয়া এবং বাইরে খেলার কারণে কৃমি সংক্রামিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পরিবারের জীবনধারার উপর নির্ভর করে, শিশুদের কৃমি হওয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে। কৃমি সংক্রমণ হওয়ার সবচেয়ে সাধারণ কারণগুলি নীচে তালিকাভুক্ত করা হল:
- একটি সংক্রামিত পৃষ্ঠতলের সংস্পর্শে আসা
- সংক্রামিত খাদ্য বা জল খাওয়া
অনুপযুক্ত স্বাস্থ্যবিধি বা পরিচ্ছন্নতার অভাব - কাঁচা বা ভালোভাবে রান্না না করা খাদ্য গ্রহণ
- অপর্যাপ্তভাবে হাত ধোওয়া
- সংক্রামিত ব্যক্তির সান্নিধ্যে আসা
একটি কৃমি সংক্রমণ নির্ধারণ করার পরীক্ষা:
নিম্নলিখিত সহজ পরীক্ষাগুলি করে শিশুদের মধ্যে কৃমি সংক্রমণের সম্ভাবনা ডাক্তাররা নির্ধারণ করতে পারে:
- মল পরীক্ষা
- কৃমি বা কৃমির ডিমের উপস্থিতি নির্ধারণের জন্য মলের নমুনা ল্যাবে পাঠানো হয়।
নখ পরীক্ষা করা - ডাক্তার শিশুদের নখের নিচে কৃমির বা মলের উপস্থিতি দেখতে বাচ্চাদের নখ পরীক্ষা করে দেখেন।
- একটি আঠালো টেপ পরীক্ষা
এই পরীক্ষা বিশেষভাবে সুতাকৃমি সনাক্ত করার জন্য করা হয়। যদি কৃমির ডিম উপস্থিত থাকে, তবে তা সংগ্রহের জন্য বাচ্চাদের নীচে একটি টেপ রাখা হয়।
তুলোর ফালি দিয়ে মোছা
কৃমির ডিমের উপস্থিতি পরীক্ষা করার জন্য বাচ্চার শরীরের নিচের অংশ একটি তুলোর ফালি দিয়ে মোছা হয়।
আল্ট্রাসাউন্ড টেস্ট
গুরুতর কোনও সংক্রমণের ক্ষেত্রে এই পরীক্ষা করা হয়, ডাক্তার আল্ট্রাসাউন্ড ব্যবহার করে জীবাণুর অবস্থান শনাক্ত করেন।
শিশুদের কৃমির চিকিৎসা
কৃমি সংক্রমণ নির্মূল করা এমন কিছু বিশেষ সমস্যা নয়, চিকিৎসকের পরামর্শে কৃমির ওষুধ খাইয়ে তা সহজেই সম্ভব। শিশুদের কৃমিনাশক হিসেবে সবচেয়ে নিরাপদ হল কম মাত্রার অ্যালবেন্ডাজোল অথবা মেবেন্ডাজোল।
- মূলধারার ঔষধ ব্যবহার করার পাশাপাশি, বাবা–মায়েরা শিশুদের কৃমির জন্য ঘরোয়া প্রতিকারগুলি বিবেচনা করতে পারেন, নিম্নলিখিত উপাদানগুলি শিশুর খাদ্যে মন্ড আকারে মিশিয়ে দিয়ে:
- কাঁচা পেঁপে: এটির একটি এনজাইম আছে, পাপাইন, যেটি একটি কৃমিনাশক হিসাবে কাজ করে এবং অন্ত্রের মধ্যে কৃমিকে ধ্বংস করে।
- রসুন: এটি একটি প্রাকৃতিক কৃমিনাশক এজেন্ট এবং পরজীবী কৃমিনাশ করতে অত্যন্ত কার্যকর।
- ক্যারম বীজ: এই বীজ থাইমল সমৃদ্ধ, যা অন্ত্রের পরজীবী বৃদ্ধি প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। এগুলিকে গুড়ের সঙ্গে মিশ্রিত করে একটি শিশুকে দেওয়া হয়।
- কুমড়ো বীজ: এই বীজে কিউকারবিটাসিন আছে যেটি কৃমিদেরকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে তোলে এবং শরীরের মধ্যে তাদের বেঁচে থাকা প্রতিরোধ করতে পারে।
- কড়লা: এটি পেটের কৃমির সাথে যুদ্ধ করতে সহায়তা করে। জল এবং মধু দিয়ে মেশালে তিক্ত স্বাদ থাকে না।
- নিম: এটির একটি পরজীবী–বিরোধী বৈশিষ্ট্য আছে এবং বিভিন্ন অন্ত্রের কৃমি ধ্বংস করতে উপকারী।
- গাজর: গাজরে ভিটামিন এ থাকে যা শিশুর প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং অন্ত্রের পরজীবীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহায়তা করে। খালি পেটে গাজর খাওয়া কৃমি পরিষ্কার করতে সাহায্য করতে পারে।
- হলুদ: এটি একটি অভ্যন্তরীণ অ্যান্টিসেপটিক এবং এটি সমস্ত ধরনের কৃমি নির্মূল করার জন্য পরিচিত।
- নারকেল: এটির একটি শক্তিশালী পরজীবী বিরোধী বৈশিষ্ট্য আছে, এটি কৃমি চিকিত্সার জন্য উপকারী। এটিকে তেল হিসাবে সরাসরি খাওয়া যেতে পারে।
- লবঙ্গ: লবঙ্গ বিদ্যমান কৃমি এবং তাদের ডিম ধ্বংস করতে পারে এবং ভবিষ্যতে সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারে।
শিশুর বৃদ্ধির উপর কৃমির প্রভাব:
কৃমিগুলি পরজীবী এবং তাদের পালনকারীর শরীর থেকে পুষ্টি অর্জন করে। তারা নিম্নলিখিত উপায়ে সংক্রামিত হয়ে, শিশুদের পুষ্টির অবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে:
কৃমিগুলি ধারক কোষকলাতে বাস করে এবং সেগুলোকেই খায় এবং এমনকি রক্তেও থাকে এবং এভাবে লোহা ও প্রোটিন হ্রাস পায়, যা প্রায়শই রক্তাল্পতার দিকে নিয়ে যায়।
কিছু কৃমি যেমন গোলকৃমি অন্ত্রে কিছু ভিটামিনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, যার ফলে পুষ্টির শোষণ বিঘ্নিত হয়।
কৃমির কারণে ক্ষুধা হ্রাস, পুষ্টির অভাব এবং দুর্বলতা হয়।
ফলাফলস্বরূপ কৃমিগুলি ডায়রিয়ার সৃষ্টি করে এবং আমাশয় ঘটায় এইভাবে শরীর দুর্বল করে দেয়।
শিশুটির শারীরিক ও মানসিক বিকাশের উপর তাদের নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে, যার ফলে শিশুটির ওজন হ্রাস পায় বা বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
শিশুদের কৃমি সংক্রমণ প্রতিরোধ
স্বাস্থ্যবিধি একাই ভবিষ্যতে সংক্রমণ প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে যে কৃমি সংক্রমণের কারণে শিশুদের পেট ব্যথা হয়। বাচ্চারা হামাগুড়ি দিতে এবং হাঁটতে শুরু করলে তাদের কৃমি সংক্রমণের ঝুঁকি সবথেকে বেশী। সংক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি অনুশীলন করা গুরুত্বপূর্ণ:
নিয়মিত বাচ্চাদের ন্যাপিগুলি পরিবর্তন করুন এবং সাথে সাথে আপনার হাত ধুয়ে ফেলুন।
ঘর এবং আশপাশ পরিষ্কার রাখুন।
বাচ্চা যেন পা ঢাকা জুতো পরিধান করে বাইরে খেলতে যায় এবং বাড়ীতে ফিরে যেন হাত এবং পা ধুয়ে ফেলে তা নিশ্চিত করুন।
বাচ্চাদের জল জমা এলাকার কাছাকাছি খেলতে দেবেন না।
ঘন ঘন আপনার শিশুর নখ কেটে দিন।
আপনার শিশুকে ফোটানো এবং পরিশ্রুত জল পান করান।
বাচ্চাদের পাকস্থলীতে কৃমি প্রতিরোধের জন্য খাবার ভালভাবে রান্না করা উচিত এবং কাঁচা খাবার দেওয়া উচিত নয়।
ফল এবং সবজি পরিষ্কার জলে ভাল করে ধোওয়া উচিত।
গরম জল দিয়ে জামাকাপড় এবং বিছানার লিনেন কেচে দিন।
স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখলে কৃমি থেকে সংক্রমণ– যা শিশুদের মধ্যে সাধারণ– প্রতিরোধে দীর্ঘ পথে কাজে আসতে পারে। কিছু ডাক্তার সংক্রমণ প্রতিরোধ এবং শিশুদের মধ্যে সর্বোত্তম বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে প্রতি ৬ মাসে একবার করে কৃমিনাশক ওষুধ প্রদান করতে পরামর্শ দিচ্ছেন। যদি আপনি কোনও উপসর্গ সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হন তবে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন।