টিলার ওপরে নিভৃত ত্রিপুরা গ্রাম সুধীর মেম্বারপাড়া। এই গ্রামেই লুনা ত্রিপুরার (২৫) বাড়ি। গ্রামে এমনিতেই সবাই সবাইকে চেনেন। তার ওপর কোমরতাঁতে লুনার সাফল্য বাড়তি পরিচিতিও এনে দিয়েছে। বাড়ি খুঁজে পেতে সমস্যা হলো না। মাটির দেয়াল আর টিনের চালাঘর। উঠানে আম-কাঁঠালগাছের ছায়ায় বসে কোমরতাঁতে কাজ করছিলেন লুনা ত্রিপুরা। অতিথির আগমনে পাশের একজনকে কোমরতাঁতটি বুঝিয়ে দিয়ে কথা বলতে এলেন তিনি।
খাগড়াছড়ির দীঘিনালার সুধীর মেম্বারপাড়ার বাসিন্দা লুনা ত্রিপুরা নিজের তৈরি ত্রিপুরা নারীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক রিনাই ও রিসা অনলাইনে বিক্রির ব্যবসা শুরু করেছেন। ফেসবুকে লুনার রিনাই-রিসার বিক্রির পাতাটি আগেই দেখা হয়েছিল। যে খবরের জন্য তাঁর বাড়িতে যাওয়া তা হলো, লুনা সম্প্রতি ভারত থেকেও রিনাই-রিসা তৈরির ফরমাশ পাচ্ছেন। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা থেকে একজন অনলাইন দেখে ইতিমধ্যে সাতটি রিনাই-রিসার ফরমাশ দিয়েছেন। রিসা হলো ওড়নার মতো পোশাক। আর রিনাই হলো নিচের অংশ, যা শাড়ির মতো পেঁচিয়ে পরতে হয়।
বিজ্ঞাপন
লুনা ত্রিপুরা প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্রামের শিবমন্দিরে মন্দিরভিত্তিক প্রকল্পে সাড়ে চার হাজার টাকা বেতনে শিক্ষকতা করছিলেন। স্বামী ইরিন ত্রিপুরা বেকার। এ টাকায় সংসার চলছিল না। ছোটকাল থেকে কোমরতাঁতের ওপর আমার অন্য রকম দক্ষতা ছিল। একদিন ছোট ভাই দিগন্ত ত্রিপুরা পরামর্শ দিলেন, বাড়িতে বসে না থেকে রিনাই-রিসা তৈরি করে অনলাইনে বিক্রি করলে ভালো হবে।’ যেই ভাবা, সেই শুরু। মার্চের শেষ সপ্তাহে রিনাই-রিসা ফেসবুক পেজ খুলে অনলাইনে পোশাকের ব্যবসা শুরু করেন। সাড়াও পান ভালো। এখন খরচ বাদে প্রতি মাসেই লুনার ১০-১২ হাজার টাকা আয় হচ্ছে, যাতে সংসারটা মোটামুটি চলে যাচ্ছে। এ জন্য অবশ্য সংসারের কাজ সামলে গভীর রাত পর্যন্ত তাঁত চালাতে হয়।
লুনা জানান, সম্প্রতি কোমরতাঁতে তৈরি করা রিনাই-রিসার কারুকাজ দেখে ভারতের আগরতলা থেকে একজন ১০ হাজার টাকায় দুটি রিনাই-রিসা কেনেন। সেটি তাঁদের ভালো লাগায় আরও সাতটির ফরমাশ দিয়েছেন। ভবিষ্যতে আরও ফরমাশ বাড়বে বলে তিনি মনে করছেন। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থান থেকেও চাহিদা আসছে। বর্তমানে ১০ জন নারীকে দিয়ে কমিশনে কোমরতাঁতে রিনাই তৈরি করাচ্ছেন। আর তিনি নিজে মাসে চারটি রিসা তৈরি করছেন।
লুনার কাজে সাহায্য করছেন ছোট ভাই দিগন্ত ত্রিপুরা। তিনি বলেন, ভারত থেকে ভবিষ্যতে আরও অর্ডার পাবেন বলে সেখানকার ক্রেতারা তাঁদের জানিয়েছেন।
টতবে তাঁরা জানান, কেবল কোনো আত্মীয় ভারতে বেড়াতে গেলে তাঁদের মাধ্যমে তাঁরা রিনাই-রিসা পাঠাতে পারেন। এর বাইরে তাঁদের লেনদেনের অন্য কোনো মাধ্যম নেই।
লুনার কাছ থেকে অনলাইনে রিনাই-রিসা কিনেছিলেন খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার মধুপুর এলাকার কোয়েলি ত্রিপুরা (২২)। তিনি বলেন, অনলাইনে কেনাকাটা নিয়ে একটা ভয় বা সন্দেহ কাজ করে। কারুকাজে মুগ্ধ হয়ে সন্দেহ নিয়েই তিনি অর্ডার করেছিলেন। পণ্য হাতে পেয়ে মনে হয়েছে ঠকেননি। লুনার কারুকাজ খুবই চমৎকার।
লুনার সঙ্গে ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন স্থানীয় কয়েকজন নারীও। তাঁদের একজন চরণ দেবী ত্রিপুরা (২৪) বলেন, তিনি নয়টি রিনাই-রিসা তৈরি করে চারটি নিজে বিক্রি করেন। বাকি পাঁচটি অনলাইনে বিক্রির জন্য লুনাকে দিয়েছেন।
বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদের দীঘিনালা উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদকœহাশীষ ত্রিপুরা প্রথম আলোকে বলেন, ত্রিপুরা নারীরা এমনিতেই অনেক পরিশ্রমী। সাধারণ পরিবারের অধিকাংশ নারী নিজেদের পোশাক (রিনাই-রিসা) নিজেরাই তৈরি করেন। লুনা ত্রিপুরা সংসারের কাজকর্ম সামলে কোমরতাঁতে রিনাই-রিসা তৈরি করে তা অনলাইনে বিক্রি করে এখানকার সবার কাছে অনুকরণীয় হয়ে উঠেছেন। আর পুঁজি গঠনে সরকারিভাবে সহায়তা পেলে তা এখানকার নারীদের খুবই উপকার হয়।