banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 842 বার পঠিত

 

কিসের ব্যর্থতায় খুন হচ্ছে নিষ্পাপ শিশুরা

কিসের ব্যর্থতায় খুন হচ্ছে নিষ্পাপ শিশুরা


ফাতিমা খান


এস এস সি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে আত্নহত্যা করেছে আটজন শিক্ষার্থী। আমি মনে করি আজকের দিনের সবচেয়ে খারাপ খবর এইটি।

এই শিক্ষার্থীদের মানসিক ভাবে অসুস্থ দাবী করবেন অনেকেই, হয়ত আমিও তাই বলব। কিন্তু ওরা কি আজন্ম অসুস্থ ছিল? তা কিন্তু না। ওদের ফুলের মত মনকে দিনে দিনে অসুস্থ করেছে আমাদের সমাজ যেখানে ভাল রেজাল্ট, কেবলমাত্র ভাল রেজাল্টই গুণাগুণ ও যোগ্যতা যাচাই এর একমাত্র মানদন্ড। এর জন্য তারা প্রতিনিয়ত তিরষ্কৃত হয়, ‘তুলনা’র অসুস্থ প্রতিযোগিতার শিকার হয়। দূর্ভাগ্যবশত, আমরা এখনো সেই আদিম সমাজে বসবাস করি যেখানে মেয়েদের গুণাগুণ বিচার করা হয় এই দেখে যে মাটির চুলায় রান্না করার পর সিলভারের পাতিল ঘষে কে কত ঝা চকচকে করে ফেলতে পারে। ওরা ট্যালেন্ট / মেধার সংগা বুঝবে কেমন করে?
আফসোস যে কোমলপ্রাণ বাচ্চাগুলো এই সমাজেরই বলি।
আমার প্রোফাইলে কাল থেকে আজ পর্যন্ত কাউকেই পেলাম না যাদের পরিবারের কেউ জিপিএ ফাইভের কম স্কোর করেছে। এর তিনটি কারণ হতে পারে –

১. পরীক্ষার্থীদের বেশিরভাগই মানে প্রায় সবাই জিপিএ ফাইভ পেয়েছে।
২. আমার পরিচিত জনদের সবাই সেই লেভেলের ট্যালেন্ট ( Lucky me! 😎)
৩. জিপিএ ফাইভের এই যুগে এর চেয়ে কম স্কোরকারীদের বাবা মা বা অভিভাবকেরা লজ্জিত। সংকোচের কারণে তারা সন্তানদের বা পরিজনদের রেজাল্ট জানাচ্ছেন না।

আমার কাছে তৃতীয়টিই সম্ভাব্য কারণ মনে হচ্ছে।

কিন্তু এর কারণ কি?
পরীক্ষার রেজাল্টই কি মেধা যাচাই এর মানদন্ড?
তাহলে যে পরীক্ষার্থী দুই বছর ছয়জন প্রাইভেট টিউটার এর কোচিং করে ভাল রেজাল্ট করল আর যে কিনা অভাবে, আধপেট খেয়ে, টিউটার ছাড়াই ঘরের গুরুদায়িত্ব গুলো পালন করে কোনরকমে পরীক্ষার খাতায় কলম চালালো – দুজনকে কি এক পাল্লায় বিচার করা যাবে?
অথবা, কারো হয়ত ছবি আঁকার বা গান করার অথবা লেখালেখির যোগ্যতা অসাধারণ, অংক হয়ত তার মাথায় কুলোয় না, সে কি মেধাবী নয়?
আমি মনে করি যা নিজস্ব গূণ তা-ই মেধা, হোক তা স্পোর্টস, আর্ট বা অন্য কোন যোগ্যতা। একে লালন করতে পারলেই একদিন তা সাফল্য হয়ে ধরা দেয়। ঠেলে, ধাক্কায়,চাপ দিয়ে যে ভাল রেজাল্ট করানো হয়, তা নিতান্তই লোকদেখানোর জন্য।

কাল আমার বড় ছেলেকে পড়াতে বসেছি। আমি অবশ্য এই যুগের সবচেয়ে খারাপ মা। পড়াশোনা নিয়ে কখনই পীড়াপীড়ি, চাপাচাপি করিনা, এজন্য অনেক কথা, উপদেশ বাণী প্রতিনিয়ত শুনি। তো যাহোক, ছেলে পড়তে বসে বলছে –
– আম্মু আমি গ্রেইড এইটে, এখনই কেন সবাই ‘ও লেভেল’ এর রেজাল্টের চিন্তা করে?
– এজন্য করে যে তোমার রেজাল্টের উপর গ্রাজুয়েশন লেভেলে ভাল কোন সাবজেক্ট এ চান্স পাওয়া নির্ভর করে।
– ভাল সাবজেক্ট মানে কি?
– মানে ডিম্যান্ডিং সাবজেক্ট, যেটায় পড়লে তুমি লাইফে শাইন করবে, বেটার লাইফ পাবে।
– এই পৃথিবীতে কোনটা ডিম্যান্ডিং না আম্মু? লিটারেচার, হিস্ট্রি, আর্ট এগুলার কি কোন ভ্যালু নাই?
– আছে, তবে কম।
– তাহলে কেউ যদি এসব সাবজেক্টে হাইয়েস্ট ডিগ্রি নেয়, ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করে, ইউনিভার্সিটির টিচার হয়, তার ভ্যালু কি কম?
– না তা না, সেটাও অবশ্যই ভাল। তবে তুমি যদি মোস্ট ডিম্যান্ডিং সাবজেক্ট গুলোতে পড়, কম ইফোর্টে বেটার জব পাবে, ভাল স্যালারি পাবে।
– ব্যাস,এইটুকুই? তাহলে আমি জবই খুঁজব না। আমি আন্টাপ্রিনিওর হব, অন্যকে জব দিব।
– আচ্ছা বাবা। এখন পড়াটা শেষ কর। কাজ আছে আমার।
– এই যে আম্মু, আপনি ডেন্টিস্ট হলেন, লাইফের সব এক্সামেই ভাল স্কোর করলেন, ডিম্যান্ডিং জবই তো করছেন, কিন্তু আমি তো আপনার মত এরকম লাইফস্টাইল কখনো, কখনোই চাইব না। আমি এমন কিছু করব যাতে লাইফ আর প্রফেশান দুইটাই এঞ্জয় করতে পারি।

আমি জানি আমার ছেলের কথা অনেকাংশেই ঠিক। কিন্তু সেও তো এ সমাজেরই অংশ। শেষ পর্যন্ত আমি বা আমরা হয়ত তাকে সেই আখেরি ঠ্যালা মারবই।

বি: দ্র : আমার প্রোফাইলে বা বন্ধু মহলের পরিবারের কেউ যদি জিপিএ ৫ এর কম স্কোর করে থাকে, তাদের জন্য অভিনন্দন ও অনেক দোয়া। পরীক্ষার রেজাল্টই সব কিছু না। সবচেয়ে বড় ফেইলিউর হল নিজেকে হারিয়ে ফেলা, আত্নবিশ্বাস ও আত্নমর্যাদা হারিয়ে ফেলা।

Facebook Comments