‘মা’ ভুমিকার সঠিক কদর আমরা করতে পারব না
মুদাব্বির হোসেন
আজ বিশ্ব মা দিবস। সারা পৃথিবীর কোটি কোটি সন্তানেরা তাদের মা কে খুশী করতে আজ আনন্দ-উচ্ছাস নিয়ে, উত্তেজনা নিয়ে কত কিছুই না করবে। কেউ কার্ড বানাবে, কেউ খাবার রান্না করবে, কেউ উপহার কিনবে, কেউ আবার মা কে জড়িয়ে ধরে বলবে ভালবাসি, কেউ হয়তো সামাজিক চাপে পরে মা দিবস পালন করবে। আবার যাদের মা নেই তারা গোপনে কেঁদে মা কে স্মরণ করবে। আমার মতে এই একটি দিবস উদযাপন নিয়ে পৃথিবীতে কারও আপত্তি থাকার কথা না। হয়তো আপনাদের কেউ কেউ বলবেন সবদিনই তো ভাই মা দিবস, এই একটা দিন নিয়ে এত বাড়াবাড়ি কেন? সবাই তো ভাই আপনার মতো বুঝদার না, এই পৃথিবীতে এখনো অনেক মানুষ আছে যাদের মুখে তুলে খাইয়ে দিতে হয়, তেমনি কিছু মানুষকে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে হয় যে গত এক বছরে কিন্তু একবারও মা এর খবর নেয়া হয়নি। এই দিবস নিয়ে কোন ওয়াজে কাউকে ফতোয়া দিতে দেখবেন না, কোন ডক্টর ইন সোশ্যাল নেটওয়ার্ককে নাক সিটকাতে দেখবেন না অথবা হাল আমলের কোন উঠতি সেলেব্রিটিকে আগের দিনের ফ্যাশন বলে অবহেলা করতে দেখবেন না। এই যে আমরা সবাই মা কে আজ খুশী করতে এত কিছু করবো, আমাদের কারও পক্ষেই আন্দাজ করা সম্ভব না যে ঠিক কতটুকু নিষ্ঠা নিয়ে তারা আমাদের বড় করেছেন অথবা আমাদের মানুষ করতে কত বিসর্জন আমাদের ‘মা’ রা দিয়েছেন।
আমার নিজের মায়ের কথা বলি।আমার বুঝ হবার পরে প্রথম হাসি, প্রথম কান্না, প্রথম রাগ, প্রথম অভিমান, সব আম্মার সাথে। প্রথম ফেল করে মাইর খাওয়াও আম্মার হাতে। কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করতো তুমি কাকে বেশী ভালোবাসো, মা কে নাকি বাবা কে? আমি বলতাম সমান সমান, খুবই ডিপলোম্যাটিক উত্তর, কিন্তু চোখ আর চাহনি ঠিকই বলে দিত কাকে বেশী ভালবাসি। আমার ছোটবেলাতে মা দিবস থাকলে হয়ত আমিও অনেকভাবে উদযাপন করতাম কিন্তু আম্মার আত্মত্যাগের সিকিভাগও হয়তো অ্যাপ্রেসিয়েট করা হতো না। আমার আম্মা ছিলেন সরকারি স্কুলের শিক্ষিকা। ছোট বেলায় আমি আম্মাকে যমের মতো ভয় পেতাম,যেমন ভালবাসতেন তেমনি কড়া শাসনে মানুষ করেছেন। সবসময় বলতেন তোদের জন্য আমি কোনদিন প্রমোশন নেই নাই , নিলে তোরা কেউ মানুষ হবি না। আমরাও ভাবতাম আসলেই তো কেন প্রমোশন নিয়ে ঢাকার বাইরে যাবে, আমাদের জন্য স্যাক্রিফাইস তো মা ই করবে, আর কে করবে? আমি জানি না বাংলাদেশে কিভাবে রত্নগর্ভা উপাধি নির্ধারিত হয়, কিন্তু আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে আমার আম্মা একজন রত্নগর্ভা। দুজন এম বি বি এস (একজন এম আর সি পি, ইউকে এবং আরেকজন এম পি এইচ, অস্ট্রেলিয়া), একজন এম বি এ (ঢাকা), একজন পি এইচ ডি (আমেরিকা) সন্তান মানুষ করেছেন, তার মধ্যে দুই বার ব্রেইন টিউমার অপারেশন হয়েছে, কিন্তু পরিবারের জন্য বার বার জীবনযুদ্ধে আরও শক্তি নিয়ে ফিরে এসেছেন।
আমার মেয়েকেও যদি আপনি জিজ্ঞেস করেন যে কাকে বেশী ভালোবাসো, সে একটা হাসি দিয়ে বলবে Both, কিন্তু প্রশ্নকর্তা তার চোখ ও চাহনি দেখে ঠিকই বুঝে যাবে কাকে সে বেশী ভালবাসে। আমার মেয়েও কালকে কার্ড বানাবে মা এর জন্য, হয়তো কোন সারপ্রাইজও দিবে, কিন্তু সেও তার মায়ের সব কষ্ট ও বিসর্জন পুরোপুরি কোনদিনই উপলব্ধি করতে পারবে না।আমাদের পরিবারের জন্য আমার বাচ্চাদের মা এর এই আত্মত্যাগ দেখে আমি আজ কিছুটা হলেও আমার মা এর আত্মত্যাগ উপলব্ধি করতে পারি। আমার কাছে মনে হয় বিশ্ব মা দিবস শুধু সকল সন্তানদের উদযাপনের জন্য নয়। এটা আসলে বাবাদেরও উপলব্ধির দিবস এবং তাদের বাচ্চার মা কে কদর করার দিবস। এখন জিজ্ঞেস করতে পারেন আমার নিজের এই উপলব্ধি লকডাউনের কারনে কিনা? একটা কথা বলতে পারি যে করোনা পরবর্তী স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেলে কোনদিন এই কথাটা বলব না যে “আমিও কিন্তু অনেক কাজ করি”। আমার বাচ্চাদের মা প্রতিদিন যেই কাজ করে আমি তার শতকরা আড়াই ভাগও করি কিনা সন্দেহ। তাই বলে ভাববেন না আমি বাসার কোন কাজই করি না, এই যে আপনি যে নাক সিটকাচ্ছেন আমি হলফ করে বলতে পারি আপনিও আপনার বাচ্চার মায়ের কাজের শতকরা ১২/১৩ ভাগের বেশী কাজ করেন না। আমি আজ পৃথিবীর সব বাবাকে বলব, লজ্জা লাগলেও, ইচ্ছে না করলেও, আদিখ্যেতা মনে হলেও, আনস্মার্ট-আনকুথ মনে হলেও একটি বারের জন্য আপনার বাচ্চার মা কে এই মা দিবসে ধন্যবাদ বলুন। ধন্যবাদ বলুন শুধু আজকের দিনের জন্য নয়, বিগত দিনের জন্য এবং অনাগত একটি বছরের জন্য। আমরা যদি সারা পৃথিবীর সকল এসেনশিয়াল ওয়ার্কারদের কে ফেসবুকে গলা ফাটিয়ে প্রশংসা করতে পারি তবে কেন আমাদের পরিবারের মোস্ট এসেনশিয়াল ওয়ার্কারকে একটু ধন্যবাদ জানিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারব না।
আমার মা কে, আমার বাচ্চাদের মা কে এবং পৃথিবীর সকল মা কে “মা দিবস” এর শুভেচ্ছা। পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিনতম কাজটি আপনারা বছরের পর বছর ধরে হাসিমুখে আনন্দের সাথে করে যাচ্ছেন। ৩৬৫ দিন একটানা ধন্যবাদ দিয়ে অথবা উপহার দিয়েও আপনাদের এই মা ভুমিকার সঠিক কদর আমরা করতে পারব না। আপনারা সবাই ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন এবং ক্লান্তিহীন ভাবে কঠিনতম কাজটি করে জান হাসিমুখে।