অসহ্য রকম সুন্দর একটি জীবন
ফারহানা আমাতুল্লাহ শৌখিন
و خلقنكم ازوخا
And we created you in pairs.
জান্নাত; যেখানে নেই কোনো কষ্ট, নেই পীড়াদায়ক কোনো অনুভূতি। ইচ্ছের লাগামের বাঁধ থাকতে পারে কিন্তু দেওয়ার ভান্ডারের কোনো শেষ নেই। কোনো কিছুর শূন্যতা যেখানে নেই। তারপরেও কেন আদম(আঃ) সেখানে থেকেও শূন্যতা অনুভব করলেন? কেন একজন সঙ্গীর অভাব অনুভব করলেন?
//অসহ্য রকম সুন্দর একটি জীবন
চারদিকে ছড়ানো চিত্তানন্দের অজস্র উপকরণ
তবুও কেন জীবন ছেড়ে পালাতে চায় মন
কেন আঁতিপাঁতি করে খোঁজে অন্য কোনো ভুবন?//
আর আল্লাহতা’আলা কেনই বা বাবা-মা, ভাইবোন, পরিবারের অন্য কোনো সদস্য রেখে, একজন স্ত্রী হাওয়া(আঃ) কেই জুড়ে দিলেন তার সাথে?
বললেন, হে আদম! তুমি এবং তোমার স্ত্রী জান্নাতে অবস্থান করো এবং সেখান থেকে যা চাও খুশিমনে খাও। (বাক্বারহঃ৩৫)
আল্লাহতা’আলার প্রজ্ঞা সবকিছুর উর্ধ্বে।
প্রথম পরিবার গড়ে উঠেছিল প্রথম মানব মানবীর মাধ্যমে। একটা পরিবার বহু হৃদয়ের সমষ্টি। যেখানে আছে জীবনের প্রবাহ, আছে মায়া-মমতা, স্নেহ-ভালোবাসা, মিলেমিশে থাকার প্রবল বাসনা, আছে নিরাপত্তা, সহনশীলতা এবং পরস্পরকে গ্রহণ করার মানসিকতা।
সম্পর্কের বন্ধনগুলোর ক্ষেত্রে আমরা খুব বেশি আটপৌরে। কারও সাথে কথা বলার সময়, ভাব বিনিময়ের সময় মনোযোগ দেই না ঠিকমতো। সতর্কতা থাকেনা আমাদের। কাছের মানুষ বলেই বুঝি যথাযথ মূল্যায়ন না করলেও চলে? অথচ এই কাছের মানুষগুলোর জন্যই তো জীবন আমাদের কাছে রঙধনু হয়ে ধরা দেয়। সুহাসিনী ভোর হয়ে হাজির হয়। ঘোর অমানিশার দিনে একমুঠো রোদ নিয়ে হাজির হয়। কুয়াশার ঘনকালো মেঘের বুকে উন্মুক্ত করে আলোকিত বাতায়ন। রাহবার হয়ে দেখিয়ে দেয় সুখের কিনারা। আর তাদের ক্ষেত্রে আমরা কতটা সতর্ক থাকি প্রশ্ন করে দেখেছি কি নিজেকে?
পারিবারিক উপাখ্যান নিয়ে লেখিকা আফরোজা হাসানের ছয় কলামের একটি পেসক্রিপশন হাতে পেলাম। অবশ্য লেখিকা হিসেবে অপরিচিত কেউ নন। যদি জিজ্ঞেস করেন, আপনার পছন্দের লেখিকা কে? চোখ বন্ধ করে বলব, আফরোজা আপু। শব্দশৈলীর গঠন। কথার প্রজাপতি কিভাবে এক ডাল থেকে অপর ডালে অবগাহন করে নিয়ে চলে, তার পূর্ণ প্রশান্ত আবেশ লেখিকার লিখাতে খুঁজে পাই। শুধুমাত্র একটা বই পড়েই তার প্রতি বুঁদ হয়ে গেলাম ব্যাপারটা এমন নয়। সতেরো সাল থেকেই অপেক্ষার প্রহর গুনতাম কখন আনন্দবাড়ির আনন্দকথনের পরের পর্ব এসে হাজির হবে। গল্পে গল্পে খুঁজি জীবনের প্রতিচ্ছবিতে কতবার যে উঁকি দেওয়া হতো। এভাবে তার সব পান্ডুলিপিতে সাঁতরে বেড়িয়েছি। যদিও জীবনের পাণ্ডুলিপিগুলো গল্পের মতো সহজ নয়। এ পান্ডুলিপিতে থাকে কয়েক মনের বসবাস। যাদের চিন্তাচেতনা অনেক সময়ই অন্যের সাথে মিলেনা। থাকে বৈরিতা আবার কখনো থাকে আনন্দের মিশেল।
#গল্পের_ঝুড়ি_থেকে
//একটা মেয়ে যখন বউ হয়ে পরিবারে প্রবেশ করে। তখন পরিবারের সদস্যরা ভাবে বড় হয়েছে বলেই বিয়ে হয়েছে। আর বিয়ে হয়েছে মানেই তুমি এখন বিশাল সব দায়িত্বে বোঝা মাথায় নিতে প্রস্তুত। অথচ, একটা মেয়ে হিসেবে সে বড় হয়েছে; কিন্তু একজন বধূ হিসেবে মাত্রই তার জন্ম হয়েছে।// সুখের নাটাই
মানুষের সমস্যা হচ্ছে বাইরের মানুষকে বুঝিয়ে বললেও কাছের মানুষকে বুঝিয়ে বলতে চায় না। বুঝিয়ে বলার চাইতে হুকুম করতে বেশি পছন্দ করে। এভাবে বলার চাইতে করতে হবে বলে অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। অথচ কাছের মানুষকে একটু সময় দিলে। আন্তরিকতার সাথে বুঝালে তারা নিজেদের অভিভাবকহীন মনে করে না।
//অভিমানী মনের আত্মদহন গল্পে, নাফিসা সদ্য বিবাহিত নতুন বধূ মুনিরাকে জীবনের উপাখ্যান বুঝিয়ে দিচ্ছে সাবলীলভাবে, জানো মুনিরা এমন কতবার হয়েছে, বাবা কোথায়ও বেড়াতে নিয়ে যাবার কথা বলে নিয়ে যাননি। ভাইয়ারা পছন্দের মূল্য না দিয়ে জোর করে অপছন্দনীয় কিছু চাপিয়ে দিয়েছে। বোনেরা নষ্ট করে ফেলেছে খুব প্রিয় কিছু। মা অকারণে বকাঝকা করেছেন। সেসব কি মেনে নিইনি আমি? ভুলে যাইনি কি? অন্যায় আচরণের জন্য ছেড়ে চলে গিয়েছি কি? না। এর কারণ কি বাবা-মা-ভাই-বোনকে ডিভোর্স দেওয়া যায় না, এটা? নাকি অকৃত্রিম ভালোবাসা? তাহলে স্বামী/স্ত্রীর ভুল কথা বা ভুল কাজ মেনে নিতে সমস্যা কোথায়? যেখানে সেই মানুষটাকে জড়িয়েই আমার জীবনের সবকিছু। //
সম্পর্কগুলো অনেক স্পর্শকাতর। আর তারমধ্য সবচেয়ে বেশি স্পর্শকাতর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। একবার বিচ্ছেদ হলে আর দেখা নেই। দেখার জন্য, কাছে পাবার জন্য হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়ে যাবে অথচ বৈধতার দেয়াল আটকে যাবে। এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে সম্যক সচেতন থাকা তাই খুব বেশি জরুরী। সংসারে সুখী হতে চাইলে নিজ নিজ প্রাপ্তির হিসেব করা ছাড়তে হবে৷ ভালোবাসা মানে আমি তোমাকে কী দিলাম এবং বদলে কী পেলাম তার যাচাই করা নয়৷ বরং একে অন্যের ঘাটতিগুলো পূরণ করতে করতে দুজন মিলে একই গন্তব্য পানে ছুটে চলা।
//”অন্তরালের ছায়া” গল্পে ইলমা আর নুরির কথায় কথায় উঠে এসেছে জীবনের কিছু সহজ চিন্তাধারা।
“এত ভালোবাসাবাসি, এত টান, এত আকর্ষণ থাকার পরও সম্পর্কগুলো ভেঙে যায় কেন? জীবন দিয়ে দেবার দাবিদারেরা একে অন্যের জন্য নিজেদের ছোট্ট ছোট ইচ্ছা-অনিচ্ছা, পছন্দ-অপছন্দের ত্যাগ স্বীকার করতে পারে না কেন? কোনো ব্যক্তিই যেখানে ভুলের উর্ধ্বে নয়, সেখানে ক্ষমা করে দিতে পারে না কেন একে অন্যের ভুলগুলো? কেন সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার চেয়ে ভেঙে ফেলাকেই পছন্দ করতে শুরু করেছে মানুষ? কেন ঘৃণার আঁধারে ঢেকে যায় ভালোবাসার সূর্য?
সম্পর্ক যত মধুরই হোক না কেন কিংবা একজন মানুষ যতই ভালো হোক না কেন, তার ভেতরে নেতিবাচক কিছু থাকতেই পারে! এই ভাবনাটা এবং এটা মেনে নেওয়ার উদারতাই ‘ভালোবাসার’ ক্ষেত্রে সবচেয়ে শক্তিশালী ভিত৷”
“কিছু কিছু মূহুর্ত ভীষণ রকম অসহায়ত্ব নিয়ে হাজির হয় আমাদের কাছে! পছন্দের মানুষরা খুব কাছে থাকার পরও অদ্ভূত এক একাকিত্ব ঘিরে ধরে মনকে৷ অকারণেই বারবার ভিজে ওঠে চোখ৷ চোখ বুজলেই দেখা যায় বুকের ভেতরে ভেসে বেড়াচ্ছে শূন্যতা৷ আকাশের বুকে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ উড়ে বেড়ানোর মতো৷ এই অনুভূতিগুলোর কাছে নিজেকে খুব অসহায় লাগে৷ তখন মন প্রশান্তি খুঁজে পায় একমাত্র রবের স্মরণে৷”
“ভালো লাগার জন্য মানুষ অন্যকে কষ্ট দিতে পারে, কিন্তু ভালোবাসার জন্য নিজে কষ্ট সহ্য করে৷”//
আমাদের দাম্পত্যজীবন যদি সুখের নাটাইয়ে বাঁধতে পারি। তবে অনাগত সব ঝড় ঝাপটা সামলে আমরাও তাতে রচনা করতে পারি সুখময় এক রঙিন অধ্যায়।
প্রতিটা গল্পতেই রয়েছে এভাবে আবেগমিশ্রিত বাণী। জীবনের পরতে পরতে যেমন আছে সমস্যা সেভাবেই রয়েছে তার সমাধান। আর কিছু লিখতে গেলে রিভিউ পাঠক বিরক্ত হয়ে পড়াই বন্ধ করে দিবেন। আর সব লিখলে হার্ডকপি পড়ার মজাই লুফে যাবে।
#সমালোচনা:
আফরোজা আপুর লিখাতে ভুল ধরার মতো শক্তিবান হয়ে উঠিনি। কিন্তু মাত্র ১০২ পৃষ্ঠার ছোট্ট এই চিরকুটে যারপরনাই ব্যথিত হয়েছি। ভেবেছিলাম জাওয়াদকে পাবো নূহাকে পাবো। থাকবে আনন্দবাড়ির সুখ এবং দুঃখের কথন। প্রচ্ছদ ভালো হয়েছে। যাইহোক, পরবর্তী নতুন বই এবং নতুন গল্পের অপেক্ষায় এই প্রহরের ক্ষান্ত দিলাম। পরের প্রহর যেন পাই ভারী মলাটে, যা পাঠকের চিত্তে আনন্দের প্রলেপ দিয়ে যাবে। বইয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেককে আল্লাহতা’আলা ফিদ্দুনইয়া ওয়াল আখিরহ এ জাযায়ে খইর দান করুন, আমীন ইয়া রব্ব!
বইঃ ”সুখের নাটাই”
লেখিকাঃ আফরোজা হাসান
প্রকাশনঃ সমকালীন প্রকাশন
প্রচ্ছদ মূল্য: ১৬০৳