banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 457 বার পঠিত

 

মোরা জোনাকি হতে চাই – ৪

মোরা জোনাকি হতে চাই – ৪


আফরোজা হাসান


তা হয়তো কঠিন কিন্তু যা করণীয় তা তো আমাদেরকে করতেই হবে। আর যা করতেই হবে তাকে কঠিন ভাবতে আমি নারাজ। কারণ আমরা যখন উত্তম হবার পথে চলতে শুরু করবো তখন আল্লাহ আমাদের পাশে থাকবেন এবং আর সেই সত্ত্বার সহায়তায় দূর হয়ে যাবে সকল প্রতিকূলতা। আর আমি বিশ্বাস করি যে আল্লাহ আমাদেরকে সাহায্য করার জন্যই বসে আছেন। আমরাই সাহায্য পাবার মত করে চেষ্টা করতে পারি না। সামান্য বাঁধা পেলেই থামকে যাই, প্রতিকূলতায় ঘাবড়ে গিয়ে হাল ছেড়ে দেই। এই যে তুমি পরীক্ষায় পাশের জন্য উঠে পড়ে লেগেছো। কল্যাণময়ী, মঙ্গলময়ী হবার জন্যও তো এমন চেষ্টা করতে হবে। তাই না?

তুই চেষ্টা করিস?

হুমম…চেষ্টা করি। আমার মতে প্রতিটা মেয়েরই এমন চেষ্টা করা উচিত। আমি কেমন মেয়ে হতে চাই জানো? প্রতিটা সম্পর্কের কাছে যে হবে আল্লাহর দেয়া উপহার। যে বাবা-মার জন্য হবে সাদাকায়ে জারিয়া, স্বামীর জন্য হবে পরিচ্ছদ, সন্তানের জন্য হবে জান্নাত।

আজ থেকে আমার চাওয়াও এটাই থাকবে। তুই আমাকে সাহায্য করবি তো?

ইনশাআল্লাহ! সবসময় আমরা দুজন একে অন্যেকে সাহায্য করবো। পথ চলতে গিয়ে যেই থমকে যাবো অন্যজন হাত বাড়িয়ে দেবো। এবং এখন থেকেই সাহায্যের সেই কার্যক্রম শুরু হবে। সকালে পরীক্ষা এখন তুমি পড়তে বোস। চল আমি সাহায্য করছি তোমাকে। দুজন মিলে আলোচনা করলে তাড়াতাড়ি বুঝতে সহায়তা হবে তোমার। তার আগে একটা প্রশ্নের জবাব দাও।

কি প্রশ্ন?

আগামীকাল পরীক্ষার পর আমার সাথে হসপিটালে যেতে পারবে?

হসপিটালে? হসপিটালে কেন? বেশ অবাক কন্ঠে জানতে চাইলো রুহি।

কিছুক্ষণ আগে জানতে পারলাম আমাদের ক্লাস ফ্রেন্ড সোনিয়ার আম্মুর গত তিনদিন ধরে হসপিটালে। মামণিকে বলেছিলাম আন্টিকে দেখতে যাবার কথা। কিন্তু মামণির নাকি সময় হবে না আগামীকাল। তবে বলেছেন খাবার রান্না করে আমাদেরকে কলেজ থেকে আনতে যাবার সময় ড্রাইভার চাচার কাছে দিয়ে দেবেন। আমরা যেন পরীক্ষা শেষে ফেরার পথে আন্টিকে দেখে আসার সাথে সাথে খাবারও দিয়ে আসি।

এমন একটা ব্যাপার আর তুই প্রশ্ন করছিস যাবো কিনা? অবশ্যই যাবো ইনশাআল্লাহ। কিন্তু কি হয়েছে আন্টির?

সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিলেন। মাথায়, কোমরে, পায়ে খুব ব্যথা পেয়েছেন। কান্নার জন্য ঠিকমতো কথাই বলতে পারেনি সোনিয়া। আগামীকাল তো যাচ্ছিই ইনশাআল্লাহ তখন জেনে নেয়া যাবে।

হুম! ঠিকআছে। তাহলে চল এখন আমাকে পড়তে সাহায্য করবি।

হাসিমুখে দুইবোন তখন বইপত্র নিয়ে বসলো।

@

গাড়ি থেকে বের হতেই তীব্র গতিতে এক ইন্টার্নকে তার দিকে ছুটে আসতে দেখে থমকে গেলো যায়েদ। কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে মাশরুফ সালাম দিয়ে বলল, স্যার আপনার জন্যই অপেক্ষা করছি আমি। অনেকবার ফোন দিয়েছি আপনাকে।

সালামের জবাব দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যায়েদ বলল, ড্রাউভ করছিলাম তাই ফোন রিসিভ করতে পারিনি। কি সমস্যা তোমার?

স্যার আমার কাজিন। সুইসাইড করার চেষ্টা করেছিল। নাউ আউট অব ডেঞ্জার। কিন্তু সেন্স ফিরে আসার পর খুব চিৎকার করছিল কেন ওকে বাঁচানো হলো। ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে এখন। আপনি যদি একটু কথা বলতেন ওর সাথে।

কি হয়েছিল?

গতকাল ওর ডিভোর্স হয়েছে। বৌকে খুব ভালোবাসতো সেজন্য ইমোশনালি…!

আজব সব ছেলেমেয়েতে ভরে গেছে দুনিয়াটা। জীবনে আসা সুন্দর সুযোগ গুলোকে কাজে লাগানোর কোন ইচ্ছেই এদের ভেতর কাজ করে না। সারাদিন ঝগড়াঝাঁটি করে জীবন অতিষ্ট করা বৌয়ের সাথে ডিভোর্স হবার জন্য কোথায় আলহামদুলিল্লাহ বলবে। এরপর আরেকটা বিয়ে করে সেই বৌকে নতুন করে ভালোবাসতে চেষ্টা করবে। এখানে সুইসাইড করার কি হলো?

ভেতর থেকে উঠে আসা হাসিটা প্রাণপণে আঁটকে ফেললো মাশরুফ। মেডিক্যাল স্কুলে ভর্তি হবার পর থেকেই যায়েদ স্যারকে চেনে। সবচেয়ে ফেমাস নিউরো সাইকোলজিষ্টেদের একজন। প্রফেসর হিসেবেও অনন্য। মাশরুফ যদিও সরাসরি যায়েদ স্যারের সংস্পর্শে আসার সুযোগ তেমন একটা পায়নি কখনোই। তবে স্যার যেই হসপিটালে প্রাক্টিস করেন সেখানে ইন্টার্নী করার সুবাদে গত দেড় মাস উনাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাচ্ছে। এই হসপিটালের প্রতিজন ডক্টরই অসাধারণ একেকজন মানুষ মনে হয়েছে। প্রত্যেককেই মানুষের সেবায় নিবেদিত প্রাণ ডক্টর মনে হয়েছে। কিন্তু যায়েদ স্যার মাশরুফের মনে সবার উপরের স্থানটা দখল করে নিয়েছেন। যত ভয়াবহ সমস্যার কথাই বলা হোক না কেন স্যার অতি উন্নত এবং অসাধারণ সেন্স অব হিউমারের প্রভাবে সেটাকে মূহুর্তেই হালকা করে দেন। ব্যাপারটা এমন নয় যে স্যার কোন কিছুতেই সিরিয়াস নন। বরং যে কোন ধরণের বিপদ-আপদ, সমস্যাকে খুব স্বাভাবিক ভাবে মোকাবিলা করার বিশেষ ট্রেনিং উনি নিজেকে দিয়েছেন।

কথা বলতে বলতে হসপিতালের ভেতরে ঢুকলো দুইজন। রিসিবশন পেড়িয়ে ওয়েটিং হলের কাছে পৌছে একজন বৃদ্ধকে কান্নারত দেখে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে মাশরুফের দিকে তাকালো যায়েদ।

মাশরুফ বলল, আধঘন্টা আগে ভদ্রলোকের ওয়াইফ মারা গিয়েছেন স্যার। ক্যান্সারের পেশেন্ট ছিলেন উনার ওয়াইফ। খুব কষ্ট পেয়েছেন মৃত্যুর আগে।

মুখে কিছু না বলে ধীর পায়ে বৃদ্ধের দিকে এগিয়ে গেলো যায়েদ। ভদ্রলোকের পাশে বসে খুব নরম কন্ঠে বলল, প্রিয়জন হারানোর বেদনাকে বুকের মধ্যে বরফের মতো জমে যেতে না দিয়ে বরং অশ্রু হয়ে ঝরে যেতে দেয়াই উত্তম। কান্না করতে তাই আপনাকে আমি নিষেধ করবো না। কোন সান্ত্বনাও দিতে চাই না। কারণ কিছু কিছু ক্ষেত্রে সান্ত্বনা দেয়াটা এক ধরণের হঠকারিতা। তবে এটা অবশ্যই বলবো স্ত্রীর কথা ভাবলে উনার মৃত্যুতে খুশি হওয়া উচিত।

অশ্রুসিক্ত চোখে যায়েদের দিকে তাকালো বৃদ্ধ। কিছু বলার জন্য ঠোঁট নাড়াতে গিয়েও আবারো কান্নায় ভেঙে পড়লো।

যায়েদ বলল, মনে করে দেখুন কত কষ্ট পেয়েছেন আপনার স্ত্রী অসুস্থতার কারণে। ট্রিটমেন্ট, মেডিসিন উনাকে সাময়িক একটা স্বস্থি দিলেও কষ্টের হাত থেকে মুক্তি দিতে পারেনি কখনোই। কিন্তু মৃত্যুর ফলে অসহ্যকর সেই যাতনার হাত থেকে উনি মুক্তি পেয়েছেন। প্রিয়জনকে আমরা কেউই হারাতে চাই না। কারণ তাদেরকে আমরা ভালোবাসি। আবার ভালোবাসি বলেই প্রিয়জনকে আমরা কষ্ট দিতে চাই না। কিন্তু কোন প্রিয় মানুষ যদি আমাদের কাছে থেকে কষ্টে থাকে। সেক্ষেত্রে তার দূরে চলে যাওয়াটাকে খুশি মনে মেনে নেয়া উচিত। কেননা ভালোবাসার অর্থ একসাথে বা কাছাকাছি থাকা নয়। ভালোবাসার অর্থ দূরে থেকেও একে অন্যের কল্যাণ কামনা করা। একে অন্যের শান্তির মধ্যে আনন্দ খুঁজে নেয়া। গিয়ে দেখুন কি প্রশান্তিতে ঘুমোচ্ছেন আপনার স্ত্রী। গত কয়েক মাসে কি কখনো শান্তিতে দু’চোখ বুজতে দেখেছেন উনাকে? ঘুমের ভেতরেও ককিয়ে উঠতেন ব্যথায় তাই না?

অবাক চোখে যায়েদের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলো বৃদ্ধ। তারপর নিজের স্ত্রীর কষ্টের মূহুর্তগুলোর কথা বলতে শুরু করলেন আপন মনেই। এক সময় কিছুক্ষণের জন্য থেমে গেলেন। এরপর বললেন, ইয়েস ডক্টর ইউ আর রাইট। আজ আমার স্ত্রী ভয়াবহ এক কষ্টের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে। অনেকদিন পর আজ শান্তিতে ঘুমোচ্ছে। আমার ওর জন্য হ্যাপী হওয়া উচিত।

আরো কিছুক্ষণ বৃদ্ধের সাথে কাটিয়ে নিজের কেবিনের দিকে রওনা দিলো যায়েদ। মাশরুফ দন্ত বিকশিত করে বলল, স্যার আপনি সত্যিই অসাধারণ।

যায়েদ বলল, তোমার কি ধারণা মৃত্যুর পর প্রশান্তির জীবন শুরু হবার সম্ভাবনা কতটুকু একজন মানুষের?

মূহুর্তেই কবরের জীবন, পরকালের কথা স্মরণে হাসি মুছে গেলো মাশরুফের মুখ থেকে। আতঙ্কের ঢোঁক গিললো।

যায়েদ বলল, পেশেন্ট এবং তাদের রিলেটিভদেরকে সান্ত্বনা দেবার সময় অনেক কথাই বলতে হয়। কিন্তু সেই কথার প্রভাব যাতে নিজের উপর না পড়ে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখবে সবসময়।

জ্বি স্যার।

তোমার কাজিন উঠলে আমাকে খবর দিয়ো। নাউ লীভ।

হাসি মুখে ইয়েস স্যার বলে মাশরুফ ছুটলো নিজের কাজে।

চলবে
পর্ব-৫

Facebook Comments