banner

শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 896 বার পঠিত

 

জেদ, প্রতিশোধ পরায়ণতা ও প্যারেন্টিং

জেদ, প্রতিশোধ পরায়ণতা ও প্যারেন্টিং


কানিজ ফাতিমা


জেদি ও প্রতিশোধ পরায়ণ ব্যক্তিরা ভালো বাবা-মায়ের ভূমিকা পালন করতে পারে না। সাধারণত দেখা যায় জেদি ও প্রতিশোধ পরায়ণ ব্যক্তিরা নিজেদের সন্তানদেরকে অন্যদের থেকে এগিয়ে রাখতে অনেকটা সময় ও শ্রম ব্যবহার করেন। ফলে জীবনের প্রথমভাগে এই সন্তানরা লেখাপড়ায় সাধারণত এগিয়ে থাকে। ধীরে ধীরে তারা নিজেদের মধ্যেও এই জেদ ও প্রতিদ্বন্ধীতা আয়ত্ব করে নেয়। এই জেদ তাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার একধরণের (নেগেটিভ) মোটিভেশন হিসাবে কাজ করে। নিজেদের কাজিন এবং সহপাঠিদের সঙ্গে মনে মনে তারা তীব্র প্রতিদ্বন্ধীতা অনুভব করে ও লেখাপড়ায় এগিয়ে থাকতে চায় – ফলে অনেক ক্ষেত্রে তারা অন্যদের থেকে এগিয়েও থাকে। আর এই সুফলকে জেদি বাবা-মায়েরা নিজেদের সফলতা হিসাবে নেন ও আত্মতৃপ্তি পান।
কিন্তু তারা জানেননা যে তারা তাদের সন্তানদের কত বড় ক্ষতি করে ফেলছেন। এটা অনেকটা এমন পেসক্রিপশন করার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে যেখানে ঔষধে রোগীর আপাত একটা উপকার হবে কিন্তু ভবিষ্যতে জীবন হুমকির মুখে ফেলবে। এধরণের বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের দু’টো বড় ক্ষতি করেন। অনেকটা বলতে গেলে তারা ছোট একটা পাওনার জন্য অনেক বড় আর মূল্যবান দু’টো জিনিসকে বিসর্জন দেন। এটা সত্যি যে তাদের ভালোবাসা আর ত্যাগে কোনো কমতি থাকে না – কিন্তু নিজেদের জেদ আর ইগো তাদের অজান্তেই সন্তানদের থেকেও তাদের জন্য বড় হয়ে দাঁড়ায়। নিজের সন্তানদের ক্ষতি করেও তারা নিজেদের ভেতরের এই মানসিক রোগকে বিসর্জন দিতে পারেন না। সন্তানদের সারা জীবনের জন্য ক্ষতি করে ফেলেন –
এক্ষত্রে যে দু’ইটা বিশাল ক্ষতি সন্তানদের হয় তাহলো –
১. সন্তানরাও এই একই মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে পরে এবং কঠিন মানসিক কষ্টের শৃঙ্খলে আজীবনের জন্য বন্দী হয়ে যায়। আপনাকে যদি বলা হয় – আপনি কি চান আপনার সন্তানের দেহে ক্যান্সার হোক? আল্লাহ মাফ করুন, কোনো বাবা -মা স্বপ্নেও একথা ভাবতে পারেনা। অথচ অবলীলায় জেদী-অহংকারী বাবা-মায়েরা নিজের মনের ক্যান্সার নিজের মন থেকে সন্তানদের মনে পুঁতে দেন, তাতে পানি- আলো-বাতাস দিয়ে অতিযত্নে বড় করে তোলেন শুধু মাত্র সন্তানদের ক্যারিয়ার গড়ে দেবার নাম করে। জেদ, হিংসা আর প্রতিশোধ পরায়ণতা হলো মনের ক্যান্সার। এটি একটা যন্ত্রণাদায়ক ব্যাধি – যা মানুষকে সারাক্ষন যন্ত্রনা দেয়। নিজে ক্যারিয়ারে সফলতা পেলেও শান্তি মেলে না, ভেতরে থাকা জেদ, হিংসা আর প্রতিশোধ পরায়ণতা আগুনের মতো ভেতর পোড়াতেই থাকে। কাজেই সচেতন হোন – আপনার জেদ ও হিংসা যেন আপনার প্যারেন্টিং এর অন্তরায় না হয়। তাতে আপনি যত ভালো প্যারেন্টিংই করুননা কেন আপনি আপনার সন্তানকে সারা জীবনের জন্য অশান্তির এক আগুনে ফেলে দিলেন। মনের এক ভয়ংকর রোগে আক্রান্ত করে দিলেন।
বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় শুশুড়বাড়ীর মানুষের সঙ্গে হওয়া জেদ আর কাজিনদের মধ্যে তৈরী হওয়া প্রতিদ্বন্ধীতা এই রোগের উৎস – আর এর বলি আপনার নিজের সন্তান। হয়তো কারো কোনো কাজে আপনি কষ্ট পেয়েছেন, বা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে অমনি আপনার জেদ সেটাকে বড় করে ফেলবে, সেখান থেকে প্রতিদ্বন্ধিতা – অন্যকে একহাত দেখিয়ে দেবার মানসিকতা, তারপর শত্রুতা, আর অবশেষে প্রতিশোধপরায়ণতা আর মানসিক অশান্তি। এই শৃঙ্খলে মন একবারবন্দী হয়ে পড়লে, তা থেকে মুক্তি কঠিন। কারণ প্রতিদ্বন্ধী বদলাবে, শত্রু বদলাতে থাকবে, কিন্তু মানসিক চক্র চলতেই থাকবে মৃত্যু অবধি।
২. দ্বিতীয় যে ক্ষতিটা আপনি আপনার সন্তানের করেন তাহলো আপনি নিশ্চিত করে দেন যে আপনার সন্তান তার পারিবারিক জীবনে কোনোভাবেই সুখী হবে না। আপনি যে জেদ, হিংসা আর প্রতিশোধের বীজ আপনার সন্তানের মনে ঢুকিয়ে দিয়েছেন তা ডাল -পালা মেলবই। ইসলামের মানবতার অংশটা যারা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারে একমাত্র তারাই এই বিষকে নিষ্ক্রিয় করতে পারে, যা সুলভ না। এমনকি ইসলামের অনুশাসন পালনকারী মানুষদের মধ্যেও ইসলামের এই অংশটি আসতে অনেক সময় লাগে, অনেক ক্ষেত্রে আবার কখনোই আসেনা। কাজেই মূলত আপনি আপনার সন্তানের এমন এক রোগের কারণ যার ঔষধ অতিশয় দুর্লভ।
এই রোগটি আপনার সন্তানের ভেতর ধীরে ধীরে তার নিজের স্পাউজের প্রতি প্রতিদ্বন্দ্বীতা মূলক মানসিকতা তৈরী করবে, সবসময় সে তার স্পাউজকে সন্দেহ করবে এবং সেটা গিয়ে পড়বে তার শশুড়বাড়ির মানুষদের ওপরে। সবকিছুকেই সে প্রতিযোগীতা হিসাবে নেবে – সবশেষে সে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে পড়বে। সে সচেতনভাবে তাদের ক্ষতি হয় এমন আচরণে জড়িয়ে পড়বে যা তার সঙ্গে তার স্পাউজের সম্পর্ককে কোনোভাবেই মধুর আর শান্তিপূর্ণ করবে না। একসময় সে তার নিজের সন্তানকেও এই দ্বন্ধে ব্যবহার করবে তার নিজের জেদ আর প্রতিশোধের নেশায় – আর এভাবে শুরু হবে পরবর্তী চক্রের।
কাজেই প্যারেন্টিংএ সচেতন হন – আপনার ভেতরের জেদ, হিংসা, প্রতিশোধপরায়ণতা থাকলে তা কমিয়ে আনুন। এগুলো অনেক পুরানো রোগ তাই কমিয়ে আনা সহজ কথা না। কিন্তু এগুলো আপনার সন্তানের থেকে বড় নয়, তাই নিজের সন্তানের জীবনের সুখের কথা চিন্তা করে নিজেকে পরিবর্তন করুন।
অনেককে দেখেছি স্বামীর উপর জেদ করে সেই প্রতিশোধ নেবার জন্য সন্তানকে ব্যবহার করে, আবার অনেককে দেখেছি স্কুলের শিক্ষকদের ওপর জেদ করে তার প্রতিশোধের জন্য নিজের সন্তানকে ব্যবহার করে – এভাবে দ্বন্ধে সন্তানকে ব্যবহার করে ছোট কোনো সফলতা পেলেও পাওয়া যেতে পারে, প্রতিশোধ নিতে পেরে কিছুটা মানসিক সুখ হয়তো তাৎক্ষণিক পাওয়া যায় কিন্তু এই বোকামীর ফলে নিজের ও নিজের সন্তানের জন্য যে বিশাল ক্ষতি হয়ে যায় তা কি আর পূরণ হয় ?

Facebook Comments