banner

মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 376 বার পঠিত

 

সমুদ্রের টানে নদীর ছুটে চলা- ৯



আফরোজা হাসান


ফজরের নামাজের পর না কান পেতে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলো মাহাম কিন্তু বাতাস আজ কোন শব্দই নিয়ে এলো না তার কাছে। কিন্তু এমন তো হবার কথা ছিলো না! আজ তো এই বাড়ির আকাশে সূর্যোদয় হবার কথা ছিলো পবিত্র বাণীর সুরলিত স্বাগত ধ্বনিতে। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর বাইরে বেড়িয়ে দেখবে কিনা ভাবছিল তখন রুমে ঢুকল মিসেস জাহিদ। মাহামকে বসে থাকতে দেখে হেসে বললেন, ওহ তুই জেগেই আছিস! আমার সাথে একটু চল তো মা নাস্তা বানাতে সাহায্য করবি। শাবাবকে ডাক।

মাহাম হেসে বলল, শাবাব ঘুমোচ্ছে ঘুমোক মামণি। চল আমি যাচ্ছি তোমার সাথে।

মা-মেয়ে গল্প করতে করতে নাস্তা বানানোতে মন দিলো। যদিও কখনো মুখে বলে না কিন্তু মেয়েরা যখন কাজে সাহায্য করতে আসে ভীষণ ভালো লাগে সাবিহার। কাজের ফাঁকে ফাঁকে নানা ধরণের গল্প করেন তখন মা-মেয়েরা মিলে। নিজের জীবনের জটিল কঠিন অভিজ্ঞতাগুলো ইতিবাচক হিসেবে শেয়ার করেন মেয়েদের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করার জন্য। এক মনে ছিটারুটি বানাচ্ছে মাহাম। মেয়ের চেহারার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন সাবিহা। শুকিয়ে কালো হয়ে কেমন হয়ে গিয়েছে মাহামের চেহারা। নানা ধরণের শারীরিক অসুস্থতার কারণে দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে তার চাঁদের মত মেয়েটি।

মাহামের মাথায় হাত বুলিয়ে সাবিহা বললেন, তোকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। তুই বরং গিয়ে বিশ্রাম কর। শাবাবকে পাঠিয়ে দে আমাকে সাহায্য করবে।

মাহাম হেসে বলল, আমি ঠিক আছি মামণি।

কিন্তু তোকে অসুস্থ্য দেখাচ্ছে। আমি নিশ্চিত তোর মাথা ব্যথা করছে।

হুম করছে। তবে যতটুকু ব্যথা করছে তা নিয়ে রান্না করতে পারবো। তাছাড়া বসে থাকলে ব্যথা বেশি করে। কাজে থাকলে মনেই থাকে না ব্যথার কথা। তারচেয়েও গুরুত্বপুর্ণ কথা হচ্ছে, ব্যথা-কষ্ট-দুঃখ-হতাশা-দুরাশা-নিরাশা তাদের জীবনের গতিকে থামিয়ে দেয় যারা অকর্মণ্য। কিন্তু আপনার মেয়ে দুনিয়াতে কাজ করতে এসেছে।

সাবিহা হেসে বললেন, আমার তো ধারণা শুধু পটপট আর ঝামেলা পাকাতে এসেছে।

আপনার ধারণার সংস্কার প্রয়োজন মাতাজ্বী।

মেয়ের কান ধরে ঝাঁকিয়ে সাবিহা বললেন, বেশি বেশি দুষ্টু হয়েছিস তোরা দুইটাই। দেখ তো তোর বাবা, আয়ান ওরা ফিরছে কিনা মসজিদ থেকে। তাহলে চা দিয়ে আয়।
মাহাম বলল, ও সবাই তাহলে নামাজ আদায় করতে মসজিদে গিয়েছিল! সেজন্যই তো বলি!

সেজন্যই তো কি? জানতে চাইলেন সাবিহা।
না কিছু না।

হাসলেন সাবিহা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, এমনিতে তোকে দেখলে বোঝাই যায় না যে তুই এত দুষ্টুমি করতে পারিস। কি মনেহয় জানিস?

কি?

সুপার রসকষহীন মেয়ে। যার দুনিয়া বইয়ের মধ্যে শুরু হয়ে বইয়ের মধ্যেই শেষ। কিন্তু যখন আয়ান আশেপাশে থাকে একদম বদলে যাস তুই। তখন তোকে শাবাবের চেয়েও ফাজিল মনেহয়। এর রহস্য কি?

মাহাম হেসে বলল, রহস্য হচ্ছে আমার দুষ্টুমি, চঞ্চলতা, অস্থিরতা শুধু আয়ানের জন্য। আমার এইসব রূপ পৃথিবীর আর কাউকে দেখাতে চাই না আমি। মাহামের মধ্যে গুটিসুটি মেরে যে ছোট্ট মাহাম বসে আছে, সে নিজকে ছাড়া শুধু আয়ানের কাছেই বাঁধনহারা। এই রহস্য তোমাকে অন্য কোন দিন বলবো। যাই সবাইকে চা দিয়ে আসি।

বাবা ও ভাইয়াদের সবাইকে চা দিয়ে আয়ানের সন্ধানে বের হলো মাহাম। বারান্দায় এসে ফাইলপত্র নিয়ে আয়ানকে বসে থাকতে দেখে সামনে চা রাখলো। তারপর কিছুই না বলে মুখ ভার করে গিয়ে আয়ানের পাশে বসলো মাহাম। আয়ান হেসে বলল, আমার জানা মতে সুবেহ সাদিক তো অন্ধকারের সমাপ্তি ঘোষণা করে, আলোর পথে যাত্রা শুরুর র্বাতা বহন করে। তাহলে সুবাহ সাদিকের আগমনের পরেও আমার পৃথিবীর চেহারা আঁধারে ঢাকা কেন?

আমি কখন থেকে অপেক্ষা করছি তোমার তিলাওয়াত শোনার জন্য। অভিমানী কণ্ঠে বলল মাহাম।

আমিও তো সেই কখন থেকে অপেক্ষায় ছিলাম ঊষার লগ্নের। রাত্রির সুচীভেদ্য অন্ধকারকে ভেদ করতে যে হাজির হবে প্রথম আলোক রশ্মী হয়ে আমার ভুবনকে আলোকিত করতে।

হেসে ফেললো মাহাম! বলল, আমি তোমার তিলাওয়াত শুনবো।

অবশ্যই শুনবে। তার আগে বলো শরীর কেমন আজ? ঘুম কেমন হয়েছে?

আলহামদুলিল্লাহ্‌ অনেক ভালো ফিল করছি আজ। ঘুমও অনেক ভালো হয়েছে। এক ঘুমে রাত সাবাড়। তোমার কি অবস্থা?

হেসে, তোমার মত সাবাড় করতে পারিনি রাতকে। তবে টেনেটুনে কাভার করেছি।

মাহাম হেসে বলল, ঠিকআছে আমি এখন যাই। মামণিকে সাহায্য করছি নাস্তা বানাতে।

রান্নাঘরে যাবার আগে শাবাবকে ডাকার জন্য রুমে রওনা করলো মাহাম। দরজার কাছে আরিফীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মাহাম হেসে বলল, সাহস পাচ্ছো না ভেতরে ঢোকার?
সাহস দেখানোটা দুঃসাহস হয়ে যাবে কিনা সেটা ভাবছি। হেসে জবাব দিলো আরিফী।

কামঅন ভাইয়া এতটাও ভয়ংকর না আমার বোন। উপর দিয়েই একটু হৈচৈ করে।

তোর বোনকে দেখে আমি বিয়ের একটা সংজ্ঞা লিখেছি।
তাই? শোনাও দেখি তোমার সংজ্ঞা।

বিবাহ একটি যুদ্ধক্ষেত্র। স্বামী-স্ত্রী হচ্ছে যোদ্ধা। আর জিহ্বা হচ্ছে বহুরূপী গিরগিটি। যা কখনো হাতুড়ি হয়ে একে অন্যকে আঘাত করে, কখনো তরবারি হয়ে রক্তাক্ত করে, কখন বরষার জল হয়ে ভাসায় আনন্দধারায়, কখন কালবৈশাখী হয়ে মটমট করে ভাঙ্গে মনের কচি ডালপালা, কখন শ্রুতিমধুর শব্দ হয়ে দোলা দিয়ে যায় প্রাণে। যার মোহনীয় সুরে পাগল হয়ে মন গেয়ে ওঠে, প্রানো সখী রে ঐ শোন কদম্ব তলে বংশী বাজায় কে? ঠিক পরক্ষনেই ভেসে আসে সাবধানী বানী, বাঁশী শুনে আর কাজ নাই সে যে ডাকাতিয়া বাঁশী।

মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসি আটকালো মাহাম। আরিফীকে রুমে ঢুকতে বলে হাসতে হাসতে চলে গেলো রান্নাঘরে।

পর্ব- ৮

Facebook Comments