banner

মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 593 বার পঠিত

 

শিশু শরণার্থী থেকে দেশের প্রেসিডেন্ট

শিশু শরণার্থী থেকে দেশের প্রেসিডেন্ট


নারী সংবাদ


যুদ্ধের মধ্যে থাকা লাটভিয়া থেকে পালিয়ে গিয়েছিল ছোট্ট মেয়েটি। এরপর ৫০ বছর তাকে নির্বাসনে কাটাতে হয়। তবে দেশে ফেরার পরে ভাইরা ভাইক-ফ্রাইবার্গা হলেন দেশটির প্রেসিডেন্ট। শুধু তাই নয়, তিনি হলেন সাবেক সোভিয়েত ব্লকভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে প্রথম নারী প্রেসিডেন্টও।

তিনি বলেন, ”আমার বাবা-মা কখনোই আমাকে ভুলতে দেননি যে, আমি একজন লাটভিয়ান।”

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাল্টিক সাগরের তীরের এই দেশটিতে অভিযান চালায় নাৎসি জার্মানি এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন। সেই ১৯৪৪ সালের টুকরো টুকরো স্মৃতি মনে আছে তার, যখন রাশিয়ার কম্যুনিস্ট রেড আর্মি লাটভিয়ায় ঢুকে পড়ে।

”তাদের লাল পতাকা আর মুষ্টিবদ্ধ হাত দেখে আমি খুবই অভিভূত হয়ে ছিলাম। একপর্যায়ে তারা যখন মার্চ করে যাচ্ছে, আমিও আমার মুষ্টিবদ্ধ হাত তাদের উদ্দেশ্যে নেড়ে বললাম ‘হুররা”’, তিনি বলেন।

”একসময় আমি তাকিয়ে দেখলাম একটি ল্যাম্পপোস্টের আড়ালে দাঁড়িয়ে রয়েছে আমার মা, পুরোপুরি বিধ্বস্ত লাগছিল তাকে। তার গাল বেয়ে চোখের পানি পড়তে শুরু করেছিল। তিনি আমাকে বলছেন, ”এরকম করো না। আজ লাটভিয়ার জন্য খুব দুঃখের একটা দিন।”

নিষ্ঠুর শিক্ষা

যখন ভাইরার বয়স সাত বছর, তখন তারা প্রথমে লাটভিয়া ছেড়ে বিধ্বস্ত জার্মানিতে যায়। এরপর তারা ফরাসি নিয়ন্ত্রিত মরক্কোয় যায়, তারপরে কানাডায়। ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত সে আর লাটভিয়ায় ফিরতে পারেনি। তবে ৬০ বছর বয়সে তিনি যখন ফিরলেন, তার আট মাসের মাথায় তিনি দেশটির প্রেসিডেন্ট হন।

ভাইরা স্মৃতিচারণ করেন, ১৯৪৪ সালের দিকে তারা বাবা বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস শুনতেন, বোঝার চেষ্টা করতেন যে যুদ্ধ কোন দিকে গড়াচ্ছে। পরের বছর তাদের পরিবার লাটভিয়া ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

”১৯৪৫ সালের নববর্ষের রাতে আমরা একটি জাহাজে উঠে বসলাম। এটা ছিল সৈন্যদের পারাপার করার জাহাজ, সেই সঙ্গে অস্ত্রপাতিও থাকতো। যদি কোন টর্পেডো জাহাজটিতে আঘাত করতো, তাহলে পুরো জাহাজটি বিস্ফোরিত হয়ে যেতো।”

”তারা বেশ কিছু বেসামরিক লোকজনকেও জাহাজে নিতো, যারা কম্যুনিজম থেকে যেকোনো মূল্যে পালাতে চাইতো। জাহাজে থাকা লাটভিয়ানরা ডেকে জড়ো হয়ে লাটভিয়ার জাতীয় সঙ্গীত গাইতো।”

জার্মানি জুড়ে যেসব শরণার্থী ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছিল, সেখানে এসে পৌঁছায় পরিবারটি। সেখানকার পরিবেশ ছিল খুবই দুর্দশাজনক। তাঁর ১০ মাস বয়সী শিশু বোনটি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। একবছরের মধ্যে ভাইরার আরেকটি ভাই আসে পৃথিবীতে। তবে সেই আনন্দের ঘটনা ছাপিয়ে জীবনের একটি কর্কশ শিক্ষা পান সেদিন।

”আমার মায়ের সঙ্গে সেই রুমে আঠারো বছরের এক তরুণী একটি মেয়ে সন্তান জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু সে শিশুটিকে নিতে চায়নি। এমনকি সে তার কোন নামও রাখতে চায়নি, শিশুটির কোন ব্যাপারেই সে আর জড়াতে চায়নি, কারণ রাশিয়ার সৈন্যদের গণ ধর্ষণের ফলে ওই শিশুটির জন্ম হয়েছিল।”

”প্রত্যেকবার যখন সেবিকারা অসহায় শিশুটিকে তার কাছে নিয়ে আসছিল, সে তার চেহারা দেয়ালের দিকে নিয়ে কাঁদছিল আর কোন কথা বলতেও অস্বীকৃতি জানাচ্ছিল। সেবিকারা শিশুটির নাম দেয় মারা, আমার বোনের নামও ছিল তাই।”

তিনি বলছেন, ”আমার মনে হলো, এটা সত্যিই অন্যায়। এখানে একজন মারার জন্ম হয়েছে যাকে এই পৃথিবীতে কেউ চায় না। আর আমাদের মারাকে আমরা এতো বেশি চাইতাম, কিন্তু তাকে আমাদের কাছ থেকে নিয়ে নেয়া হয়েছে। আমি বুঝতে শুরু করলাম, জীবন আসলেই খুবই রহস্যময় এবং পুরোপুরি ন্যায্য নয়।”

বাল্যবিয়ে ভীতি

১১ বছর বয়সের সময় ভাইরাকে আবার স্থানান্তরিত হতে হয়। এবার জার্মানি থেকে ফরাসি নিয়ন্ত্রিত মরক্কোর কাসাব্লাঙ্কায়।

”মধ্যরাতে ট্রাক থেকে আমাদের যেখানে নামিয়ে দেয়া হলো, সেটা ছিল ছোট একটি অস্থায়ী গ্রাম। কিন্তু সেটা ছিল যেন পুরো বিশ্বের একটা সংক্ষিপ্ত রূপ। সেখানে ফরাসি লোকজন ছিল, বিশ্বের সবদেশের মানুষ ছিল। গৃহযুদ্ধের সময় থেকে থাকা স্প্যানিশ লোকজন, ইটালিয়ান এবং রাশিয়ান, সব ধরণের মানুষ ছিল।”

তার পিতার একজন সহকর্মী বললেন, তিনি ভাইরাকে বিয়ে করতে চান, যদিও ভাইরা তখন শিশু।

”বাবা একদিন বাসায় ফিরে বললেন, সে আমাকে ১৫ হাজার ফ্রাঙ্ক যৌতুক দিকে চায়। সে আমাকে প্রথম দুইটা গাধা আর গরুও দিতে চেয়েছে। কিন্তু বাবা তাকে বলেছেন, সে একটি শিশু এবং তার স্কুলে যেতে হবে। তখন ওই ব্যক্তি বলছেন, ঠিক আছে, তাকে আমরা স্কুলে যেতে দেবো।”

তার বাবা-মা দুজনে হেসে উঠলেন। কিন্তু ভাইরা সতর্ক হয়ে উঠলেন।

লিঙ্গ বৈষম্যের অধ্যাপক

এর কিছুদিন পরে ভাইরার পরিবার কানাডায় চলে যায়। ষোল বছর বয়সে ভাইরা একটি ব্যাংকে চাকরি পেলেন। সেই সঙ্গে তিনি নাইট স্কুলে যেতে শুরু করলেন। এরপরে তিনি ইউনিভার্সিটি অফ টরন্টোতে পড়ার সুযোগ পেলেন।

সেখানে তার সঙ্গে পরিচয় হলো এমন একজন ব্যক্তির সঙ্গে, যাকে পরবর্তীতে তিনি বিয়ে করেন। ইমান্টস ফ্রাইবার্গা লাটভিয়া থেকে পালিয়ে আসা আরেকজন। মনোবিজ্ঞানে পড়াশোনা করে ১৯৬৫ সালে পিএইচডি করতে শুরু করেন ভাইরা। কিন্তু ভাইরা বলেন, তার বেছে নেয়া বিষয়টি ছিল যেন ভাগ্যের অঙ্গুলি হেলনে নির্ধারিত একটি বিষয়।

”সম্ভাব্য বিষয়গুলোর একটি তালিকা ছিল রেজিস্টারের কাছে। আমি সেটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ে দেখলাম এবং একটি লম্বা শব্দ দেখতে পেলাম যেটা শুরু হয়েছে পি দিয়ে এবং শেষ হয়েছে ওয়াই দিয়ে। আমি বললাম, এই বিষয়টি আমি নিতে চাই।”

কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি তিনি বুঝতে পারলেন, নারীদের এখনো পুরোপুরি স্বাগত জানানো হয় না।

”একদিন আমাদের অধ্যাপক একটি সেমিনারে বললেন, আমাদের এখানে তিনজন বিবাহিত নারী রয়েছেন যারা পিএইচডি করছেন। এটা আসলে পুরোপুরি অপচয়, কারণ যারা বিয়ে করবে, সন্তান জন্ম দেবে তারা এমন একটি জায়গা দখল করে আছে যেটি একটি ছেলে পেতে পারতো যে হয়তো সত্যিকারের একজন বিজ্ঞানী হতে পারতো। ওই সেমিনারে থাকা আমরা সব মেয়েরাই সারা জীবন ধরে সেই কথাগুলো মনে রেখেছি।”

তিনি বলেন, তারা ওই লিঙ্গ বৈষম্য করা অধ্যাপককে দেখিয়ে দিতে চেয়েছেন যে, তার পছন্দের ছেলেদের তুলনায় নারীরা আরো ভালো কিছু করতে পারে।

ইউনিভার্সিটি অব মন্ট্রিয়লে ৩৫ বছর কাজ করেছেন ভাইরা। তিনি পাঁচটি ভাষায় কথা বলতে পারেন এবং ১০টি বই লিখেছেন।

বাড়িতে প্রত্যাবর্তন…চূড়ান্তভাবে

১৯৯৮ সালে যখন ভাইরার বয়স ৬০ বছর, তিনি প্রফেসর এমেরিটাস নির্বাচিত হলেন এবং অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু একদিন বিকালে তার টেলিফোন বেজে উঠলো। ফোনের অপর প্রান্তে ছিলেন লাটভিয়ার প্রধানমন্ত্রী। লাটভিয়ার একটি নতুন প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসাবে কাজ করার প্রস্তাব পেলেন ভাইরা।

তাকে বলা হলো, ”তারা বিদেশে থাকা এমন কাউকে খুঁজছে, যিনি অনেকগুলো ভাষায় কথা বলতে পারেন, পশ্চিমা মানসিকতা বুঝতে পারেন এবং সেই সঙ্গে লাটভিয়ার সংস্কৃতি সম্পর্কে ভালো ধারণা আছে।”

কিন্তু তখনই যেন দেখতে পেলেন যে, তিনি লাটভিয়ার প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ে গেছেন।

দেশে ফেরার আটমাস পরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য কানাডিয়ান পাসপোর্ট ত্যাগ করলেন ভাইরা। তিনি নির্বাচিত হলেন লাটভিয়ার প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসাবে।

একপর্যায়ে তার জনপ্রিয়তা গিয়ে ঠেকেছিল ৮৫ শতাংশে।

”আমি ছিলাম এমন কেউ, যিনি অর্থ রোজগার বা অন্য কিছুর জন্য নয়, বরং শুধুমাত্র দায়িত্ব পালন করার জন্য। এই পদে এসেছিল। তখন অনেক সংবাদ মাধ্যম আগ্রহের সঙ্গে সমালোচনা করার চেষ্টা করছিল যে, আমি হচ্ছি খরুচে স্বভাবের, পশ্চিমে বিলাসবহুল জীবনযাপন করেছি। কিন্তু এগুলো পুরোপুরি বানানো” তিনি বলেন।

”আমি আবিষ্কার করলাম, আপনি যদি গণমাধ্যমকে বিশ্বাস করতে না পারেন, তাহলে আপনাকে জনগণের কাছে সরাসরি গিয়ে কথা বলতে হবে।”

২০০৪ সালে নেটো আর ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে লাটভিয়ার যোগদানের পেছনে তিনি মূল ভূমিকা রেখেছেন।

ইস্তানবুলে নেটো সম্মেলনের সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের সঙ্গে ভাইরা ”নারী হওয়ার অনেক সুবিধা আছে। আমার মনে পড়ছে, ইস্তানবুলে নেটো সম্মেলনের সময় প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ আমার বাহু ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন, কারণ আমি হাই হিল পড়েছিলাম আর মেঝে ছিল পিচ্ছিল, আমরা আস্তে আস্তে হাঁটছিলাম। আমি সাধ্যমত সবকিছুই করেছিলাম। তাকে বলেছিলাম নেটোর বিস্তৃতি করা কতটা দরকার এবং লাটভিয়া যেন সেখানে থাকে।”

”আমরা আস্তে আস্তে হাঁটছিলাম এবং সময়টা উপভোগ করছিলাম এবং তার কানে লাটভিয়ার প্রপাগাণ্ডা দেয়ার জন্য সবকিছুই করছিলাম। আমার মনে হয়নি এতে তার খারাপ লেগেছে’,’ তিনি বলছেন।

ভাইরার দ্বিতীয় দফার মেয়াদ শেষ হয় ২০০৭ সালে, তার ৭০তম জন্মদিনের কয়েকমাস আগে।

তিনি ক্লাব ডি মাদ্রিদ নামের একটি সংগঠনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা, যেটি সাবেক নেতাদের নিয়ে গঠিত। এই সংগঠন গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব এবং গর্ভন্যান্স নিয়ে কাজ করে। নারীদের ক্ষমতায়ন নিয়েও তার বিশেষ নজর রয়েছে। সেই অধ্যাপকের মন্তব্য এখনো তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তিনি জানেন, যুদ্ধ শেষ হওয়ার এখনো অনেক বাকি আছে। সূত্র : বিবিসি।

Facebook Comments