banner

বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 238 বার পঠিত

 

স্বাতীর রঙধনু…৬

স্বাতীর রঙধনু…৬


আফরোজা হাসান


বাচ্চা পালন নয়তো সহজ। এই বিষয়বস্তু কে কেন্দ্র করে একটা ধারাবাহিক আলোচনা সভার আয়োজন করা উচিত।
বাচ্চাদের জ্যুস বানানোর জন্য বাগান থেকে কমলা নিতে এসেছিল স্বাতী। পেছন থেকে বাক্যটা ভেসে এলে ঘুরে তাকিয়ে ননদ আজরা কে দেখতে পেয়ে হেসে বলল, হঠাৎ এমন ইচ্ছে উদ্রেক হবার পেছনে কারণ কি?
স্বাতীর পাশে এসে দাঁড়িয়ে আজরা বলল, তুমি তো জানোই আমার ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময়ই যা হয় তা হচ্ছে, চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। নতুন কোন পরিস্থিতি যখন সম্মুখে এসে দাঁড়ায় আমি হিমশিম খাই সেটা সামলাতে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে সেই পরিস্থিতিটা কত সুন্দর ভাবে হান্ডেল করা যেত তার শত শত আইডিয়া মাথায় কিলবিল করতে শুরু করে। এরচেয়েও বড় একটা সমস্যা হচ্ছে, কোন সংজ্ঞা বা উদাহরণের ভুল প্রয়োগ। এই যেমন একদিন খেলতে গিয়ে মুয়াজ প্রচন্ড জোরে আছড়ে পড়লো। আমি বিকট এক চিৎকার দিয়ে ছুটে যাচ্ছিলাম আরভ ভাইয়া আমাকে ধরে ফেলে বললেন, ওকে একাই উঠতে দে। জীবনের উত্থান পতনে সর্বদা যেহেতু তুই ওর সাথে সাথে থাকতে পারবি না। সেহেতু এখন থেকেই একা একা উঠে দাঁড়ানোর অভ্যাস হয়ে যাক।
স্বাতী হেসে বলল, এই কথাটা উনি বাচ্চাদেরকেও বলেন। বলেন, তোমরা যখন আছড়ে পরবে আমিও তোমাদের সাথে পরবো। কিন্তু উঠে তোমাদেরকে একাই দাঁড়াতে হবে। বাচ্চাদেরকে স্বনির্ভর বানানোর ব্যাপারে একদম হামাগুড়ি দেয়া যখন শুরু করে তখন থেকেই উনি ট্রেনিং দেয়ানো শুরু করেন। একটা ঘটনা মনে পরলে এখনো হাসি পায়। নাযীব তখন মাত্র নড়াচড়া শুরু করে। হাত বাড়িয়ে এটা সেটা ধরতে চেষ্টা করতো। একদিন ওর হাত থেকে খেলনা ছুটে দূরে গিয়ে পরেছিল। নাযীব হাত বাড়িয়ে ধরার চেষ্টা করছিল কিন্তু পারছিল না। উনি পাশেই বসেছিলেন কিন্তু খেলনাটা এগিয়ে দিচ্ছিলেন না। কত রকমের কসরত করে সাড়ে সাত মিনিট লাগিয়ে নাযীব শেষ পর্যন্ত ওর খেলনাটা ধরতে পেরেছিল।
আজরা হেসে বলল, আমিও তো ভাইয়ার মতোই করতে চাই সবকিছু কিন্তু হয়ে যায় সব উল্টাপাল্টা। এই যেমন পরশু বিকেলে মুয়াজ কমলা গাছ থেকে কমলা পারার চেষ্টা করছিল। দেখছোই তো এই গাছের কমলাগুলো বেশ নিচুতেই ঝুলছে। কিন্তু তবুও মুয়াজের ধরাছোঁয়ার একটু বাইরেই। মুয়াজ বার বার লাফ দিয়ে চেষ্টা করছিল ধরার। আমিও পাশে বসে মনে মনে বলছিলাম, চেষ্টা চালিয়ে যাও সোনা আমার। কিন্তু অনেকবার চেষ্টা করার পরেও যখন ধরতে পারছিল না ধীরে ধীরে আঁধারে ঢেকে যাচ্ছিলো মুয়াজের চেহারা। এমন সময় ভাইয়া এসে পেছন থেকে মুয়াজকে ধরে সামান্য উঁচু করে ধরতেই মুয়াজ দুহাতে টেনে দুটা কমলা ছিঁড়ে নিলো। উফফ, সেকি খুশি বাচ্চার। আনন্দে লাফাতে লাফাতে ছুটে গেলো ভাইবোনদেরকে তার নিজ হাতে ছেঁড়া কমলা দেখাতে। ভাইয়া তখন আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই বাচ্চাকে সাহায্য না করে চুপচাপ বসে আছিস কেন? দেখতেই তো পাচ্ছিলি মুয়াজ ধরতে পারছে না কমলা। এবং যতটূকুন উঁচুতে রয়েছে ওর পক্ষে ধরা সম্ভবও ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে বাচ্চারা কয়েকবার চেষ্টা করার পর ওদেরকে সাহায্য করতে হয়। তা না হলে চেষ্টা করে নিরাশ হবার কারণে চেষ্টা করার প্রতিই অনীহা চলে আসে মনে। আমি বললাম, তুমিই তো বলো বাচ্চাদেরকে শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করতে দেয়া উচিত। ভাইয়া তখন হাসতে হাসতে বললেন, কিন্তু বাচ্চা কোন একটা কিছু করার চেষ্টা করছে। বেশ খানিকটা সফলও হয়েছে। কিন্তু তারপক্ষে একা সফল হওয়া সম্ভব নয় এমন পরিস্থিতিতে বাচ্চাকে সাহায্য করতে হবে যাতে সে কাজটা করতে পারে। তা না হলে এমন ধরণের ব্যর্থতা বাচ্চার মনে চেষ্টা করার ব্যাপারে উৎসাহকে হ্রাস করে দেয়। কথা শেষ করে ভাইজান হাসতে হাসতে চলে গেলেন। আমি আর কি বলবো তখন। বোকার মতো দাঁড়িয়ে নিজের বোকামোর কথা ভাবতে লাগলাম। এখন তুমি হেসে আর আহত করো না আমাকে। পরামর্শ দাও কিভাবে তোমার মতো মা হবো।
কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে যাচ্ছিলো স্বাতী মাহিরাকে ছুটে আসতে দেখে বলল, কি হয়েছে? তুমি এমন করে ছুটছো কেন?
তোমরা এখানে দাঁড়িয়ে গল্প করছো? ঐদিকে তো বিরাট কান্ড ঘটে গিয়েছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো মাহিরা।
কি কান্ড ঘটেছে? প্রশ্ন করলো আজরা।
মাহিরা বলল,বাচ্চারা যাতে খাবার নিয়ে ঝামেলা করতে না পারে সেজন্য ওদেরকে সাথে নিয়েই তো ওদের প্রতি বেলার খাবারের মেন্যু ঠিক করে দিয়েছিলেন আরভ ভাইয়া। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হলো না। আজ লেগে গিয়েছে যুদ্ধ।
এত ভূমিকা কেন দিচ্ছো? কি হয়েছে বলে দিলেই তো পারছো। বললো স্বাতী।
আচ্ছা বলছি শোনো। বড় খালামণি চার্ট অনুযায়ী ই বাচ্চাদের সবাইকে নাস্তা দিয়েছিল। আজ সকালের নাস্তার মেন্যু ছিল ব্রেড, জেলি, মিল্ক, কলা আর ডিম বয়েল্ড। কিন্তু নাস্তার টেবিলে এসে বসেই নাযীব ঘোষণা দিলো আজ সে চকলেট ফ্লেক্স। নুবাইদ, নুসাইব, নাযীব, রিদান ওরা চারজন নাস্তা করতে আসার কিছুক্ষণ আগে মুসআব, নাহিব, উমায়ের আর মহিমা নাস্তা করে গিয়েছিল। নাহিব চকোফ্লেক্স খেয়েছিল সেই প্যাকেট টেবিলেই রয়ে গিয়েছিল।
সেটা দেখেই মূলত নাযীবের রুটিন ব্রেক করার ইচ্ছে জেগেছিল। কিন্তু নাযীবের ঘোষণা শুনে নুসাইব বলল, আজ আমাদের নাস্তার মেন্যুতে চকোফ্লেক্স নেই। তাই তুমি চকোফ্লেক্স খেতে পারবে না। নাযীব বলল, আমি চকোফ্লেক্সই খাবো। দাদুমণিকে বললেই আমাকে দেবে। নুবাইদ হিহি করে উঠে বলল, দাদুমণি কক্ষনো দেবে না রুটিনের বাইরের খাবার। দিলে পাপা রাগ করবে। তোমাকে তাই খেতে হবে যা আমাদের চার্টে আছে। রিদান বলল, বড়রা রাগ করবে এমন কাজ করতে হয়না। বড়দের বিরক্ত করা খুব খারাপ। দুষ্টু ছেলেরা এমন করে। তুমি কি দুষ্টু ছেলে হতে চাও নাযীব ভাইয়া? বড় দুই ভাইয়ের সাথে কন্ঠ মিলিয়ে ছোটভাই ওরফে নিজের শিষ্যকেও তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কথা বলতে দেখে নাযীবের মাইন্ডে লেগে গেলো। চোখ বড় বড় করে বলল, আমি চকোফ্লেক্সই খাবো। দাদুমণি আমাকে দেবে। পাপা আমার উপর রাগ করবে না। নুবাইদ, নুসাইব আর রিদান তিনজনই তখন খুকখুক করে হাসতে শুরু করলো।
বাচ্চাদের কান্ড শুনে হেসে ফেললো স্বাতী আড় আজরা। মাহিরাও হাসতে হাসতে বলল, কিছুক্ষণ তো নাযীব মহা বিরক্তি নিয়ে তিন ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। এমন সময় বড় খালামণি চারজনের জন্য নাস্তা নিয়ে ঢুকলেন। বড় খালামণি সামনে নাস্তার প্লেট রাখলে নাযীব বলল, দাদুমণি এটা খাবো না। আমাকে চকোফ্লেক্স দাও। বড় খালামণি নাযীবের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, আজকের রুটিনে এগুলোই তোমাদের নাস্তা। এসবই খেতে হবে। গুড বয়ের মতো খেয়ে নাও দাদুভাই। নাযীব আর কিছু না বলে চুপ করে রইলো। সবাইকে নাস্তা দিয়ে বড় খালামণি চলে যেতেই নুবাইদ দুষ্টুমি করে ভারিক্কি চালে বলল, কি বলেছিলাম না দাদুমণি কক্ষনো রুটিনের বাইরে নাস্তা দেবে না। এবার বুঝেছো তো? নুসাইব আর রিদান মুখে কিছু না বললেও নুবাইদের সাথে হাসিতে যোগ দিলো। একে তো নিজের ইচ্ছে পূরণ না হওয়া তারউপর ভাইদের খুনসুটি! এত লোড আমাদের ছোট্ট একটু নাযীব সোনা নিতে পারলো না। অনেক রাগ হয়ে গিয়েছিল সোনা বাচ্চাটার। তাই পাশ থেকে চকোফ্লেক্সের প্যাকেট টেনে নিয়ে এক মুঠ ফ্লেক্স নিয়ে নুবাইদের গায়ে ছুঁড়ে মারলো। নুসাইব প্রায় চিৎকার করে উঠে বলল, নাযীব তুমি এসব কি করছো? তোমাকে না পাপা মানা করেছে খাবার নষ্ট করতে? নাযীব তখন আরেক মুঠ ফ্লেক্স নিয়ে অর্ধেক নুসাইবের দিকে আর অর্ধেক রিদানের দিকে ছুঁড়ে দিলো। ব্যাস মূহুর্তেই পরিস্থিতি পাল্টে গেলো। রিদান সাথে সাথে উঠে ভোঁ দৌড় লাগালো। এদিকে নুবাইদ আর নাযীব একে অন্যের দিকে ফ্লেক্স ছুড়াছুঁড়ি শুরু করলো। নুসাইব দুই ভাইকে শান্ত করার চেষ্টা করতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি ফ্লেক্সের ছিটা খেলো। আমাদের শান্ত নুসাইব বাবুটা বিরক্ত হয়ে চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ফ্লেক্সগুলোকে হাত দিয়ে জড়ো করে তুলে নিয়ে দুই ভাইয়ের দিকে ছুঁড়ে মারলো। রিদান ততক্ষণে যেয়ে আরভ ভাইয়া আর রিশান ভাইয়াকে খবর পৌঁছে দিয়েছিল। হৈচৈ শুনতে পেয়ে বড় খালামণিও কিচেন থেকে ছুটে এলেন। একদিক থেকে বড় খালামণি অন্যদিন থেকে ভাইয়ারা দুজন মোটামুটি একই সময়ে বাচ্চাদের ডাইনিং রুমে ঢুকলেন। এবং ভেতরের অবস্থা দেখে তিনজনই কয়েক মূহুর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন।
এইটুকু শুনে স্বাতী বাড়ির ভেতরে যাবার উদ্দেশ্যে ছুট লাগাতে যাচ্ছিলো কিন্তু মাহিরা স্বাতীর হাত টেনে ধরে বলল, বাকিটুকু শুনে যাও ভেতরে যাবার আগে। আরভ ভাইয়াকে দেখা মাত্রই নুসাইব ভ্যা করে কান্না করে দিয়ে বলল, পাপ্পা আমি কিছু করিনি। নুবাইদ আর নাযীব আমাকে মেরেছে চকোফ্লেক্স দিয়ে। আমি শুধু একবার মেরেছি। আই এম সরি পাপ্পা। আই এম সরি চাচ্চু। আই এম সরি দাদুমণি। আরভ ভাইয়া কাছে গিয়ে নুসাইবের মাথায় হাত বুলিয়ে হাসি মুখে বললেন, যা হবার তাতো হয়েই গিয়েছে। কান্না করে সোনা। নুবাইদ বলল, পাপা সব নাযীবের দোষ। নাযীবকে শাস্তি দাও। রিদান এক লাফে রিশান ভাইয়ার কোলে উঠে বলল, হ্যা নাযীব ভাইয়া দুষ্টু ছেলে। শাস্তি দাও। তিন ভাইয়ের কথাবার্তা শুনে নাযীব একদম চুপ হয়ে গিয়েছিল। সারাক্ষণ কটকট পটপট করতে থাকা আমাদের কামল বাবার মুখে কিছুই না বলে বড় বড় চোখ করে সবার দিকে ঘুরে ঘুরে তাকাতে লাগলো। আরভ ভাইয়া হাত বাড়িয়ে নাযীবকে কাছে টেনে নিয়ে বলল, আপনি এমন করেছেন বাবা? নাযীব মাথা নেড়ে বলল, হ্যা করেছি। আমাকে যে দুষ্টু কথা বলেছে সেজন্য করেছি। ভাইয়া তখন বললেন, আচ্ছা ঠিকআছে আগে তোমরা সবাই নিজ নিজ নাস্তা শেষ করো। এরপর সবাই মিলে এইসব কিছু পরিষ্কার করবে। তোমাদের ডাইনিং হল ঠিক যেরকম থাকে তেমন করে গুছিয়ে রেখে বাগানে আসবে। পাপা বাগানে তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছি। রিশান ভাইয়াও তখন রিদানকে কোল থেকে নামিয়ে দিলেন। এরপর ভাইয়ারা দুজনই বেরিয়ে গেলেন। বড় খালামণি নিঃশব্দে নাতীদের নাস্তা করার সময় পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। নাস্তা শেষ করার পর বড় খালামণির ডিরেকশনে নুবাইদ, নুসাইব, নাযীব আড় রিদান মিলে সবকিছু পরিষ্কার করে গুছিয়ে এতক্ষণে মনেহয় বাগানের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে দিয়েছে।

চলবে…

পর্ব-৫

Facebook Comments