banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 324 বার পঠিত

 

স্বাতীর রঙধনু…৫

স্বাতীর রঙধনু…পর্ব-৫


আফরোজা হাসান


হাসলো আরভও। বাচ্চাদের যাতে ঘুমে ব্যাঘাত না ঘটে তাই দুজন ওদের রুমের কাছ থেকে সরে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। চেয়ার টেনে বসতে বসতে আরভ প্রশ্ন করলো, কি লেখা হচ্ছিলো এত মনোযোগের সাথে?
স্বাতী হেসে বলল, আগামী বুধবার আমাদের মহিলা প্রোগ্রামে আলোচনার বিষয়বস্তু রাখা হয়েছে শিশুদের গড়ে তোলাকে কেন্দ্র করে। নিজের কিছু অভিজ্ঞতার কথা লিখছিলাম বোনেদের জন্য। বোনেরা নিজ নিজ বাচ্চাদের জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের বিশাল এক লিস্ট ধরিয়ে দিয়েছে। প্রশ্নগুলো দেখলে চোখ কপালে উঠে যাবার দশা হয়। এক ছোট ছোট বাচ্চারা এমন জটিল জটিল অদ্ভুত প্রশ্ন কিভাবে করে চিন্তা করে অবাক হই। তবে প্রশ্নের চেয়েও কঠিন উত্তর দেয়াটা। বাচ্চারা খুব সহজেই বুঝে যাবে এমন উদাহরণ সাজিয়ে বলাটা সত্যিই বেশ কঠিন লাগে। এই যেমন এক বোনের সাত বছর বয়সী মেয়ে প্রশ্ন করেছে, নামাজ না পড়লে কেন আল্লাহ গোনাহ দেবেন? সে যদি নামাজ তাহলে আল্লাহর কি উপকার হবে?
আরভ হেসে ফেললে স্বাতীও হাসতে হাসতে বলল, বেচারি মেয়ের প্রশ্ন শুনে খুবই ঘাবড়ে গিয়েছে। এই বয়সেই এমন প্রশ্ন করছে মেয়ে। বড় হলে না জানি কি করবে ভেবে ভেবে অস্থির। এখন বোঝে না বলেই এমন প্রশ্ন করছে। বড় হলে যখন বুঝবে তখন আর এমন প্রশ্ন করবে না। ইত্যাদি ইত্যাদি বলে বোনটিকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু মনেহলো উনার অস্থিরতা মোটেই কমেনি। আরেক বোন উনার মেয়েকে নিয়ে খুব সমস্যাতে আছেন। কিছুদিন আগে অসাবধানতায় গরম তেল পড়ে উনার মেয়ের হাত অনেকখানি পুড়ে গিয়েছে। স্কুলের সবাই দাগের কথা জিজ্ঞেস করে বলে বাচ্চা এখন স্কুলেই যেতে চায়না। স্কুলে যাবার সময় হলেই কান্নাকাটি শুরু করে। আমার নিজেরও এমন তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। তাই বাচ্চাটার ভীতি , কষ্ট অনুভব করতে পেরেছি। তোমার মনেআছে নিশ্চয়ই আমার বয়স যখন আট বছর ছিল বোনেদের সাথে দুষ্টুমি করতে করতে পড়ে গিয়ে চোখের একপাশে অনেকখানি কেটে গিয়েছিল।
হ্যা মনেআছে।
এখন তেমন একটা বোঝা না গেলেও ছোটবেলায় দাগটা বেশ দৃষ্টিকটু ছিল। আমি মনখারাপ করতাম দাগের কারণে তাই বাবা বলেছিলেন ‘তুমি স্পেশাল তো তাই আল্লাহ তোমাকে চিহ্ন দিয়ে দিয়েছেন। যাতে যখনই কারো স্পেশাল মানুষের প্রয়োজন পড়বে তোমাকে সহজে খুঁজে নিতে পারবে।’ দাগের কারনে নিজেকে স্পেশাল ভাবা আমি যখন সহপাঠীদেরকে আমার সেই স্পেশাল দাগটার দিকে অবাক চোখে তাকাতে দেখলাম, প্রশ্ন করতে দেখলাম, খুব ইতিবাচক পরিবেশে বড় হওয়া আমি সেটা মেনে নিতে পারলাম না কিছুতেই। কোন ভাবেই কেউ আমাকে রাজী করাতে পারছিলো না স্কুলে যাবার জন্য। এখনো মনে আছে বাবার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে কান্না করতে করতে বলেছিলাম, সবাই আমার দাগকে কেন দেখে বাবা? আমাকে স্পেশাল কেন ভাবে না? ‘সত্যিই তো দাগ কেন? স্পেশাল নয় কেন?’ বাবা তখন আমাকে কোলে করে বাগানে নিয়ে গিয়ে বসে বলেছিলেন, মানুষের স্বভাব হচ্ছে চাঁদকে দেখার আগে তার দাগকে দেখা। প্রশ্ন করেছিলাম, কেন বাবা? বাবা হেসে জবাব দিয়েছিলেন, কারণ তাদেরকে দাগকে এড়িয়ে যেতে শেখানো হয়নি। যদি শেখানো হতো তাহলে মানুষ চাঁদকেই দেখতো দাগকে নয়। একটা কথা তুমি সবসময় মনে রাখবে মা এই পৃথিবীর বেশীর ভাগ মানুষগুলোই খুব ভালো। হ্যা কিছু খারাপ মানুষ আছে কিন্তু তাদের সংখ্যা খুবই নগন্য। আর তারা আছে বলেই তো আমরা বুঝতে পারি ভালোর মর্ম। মানুষের আরেকটা স্বভাব কি জানো মা? নতুন কিছু দেখলে মানুষ অবাক হয়। তোমার সামনে যদি একটা চড়ুই পাখি আসে যার মাথায় দুটা শিং আছে তুমি অবাক হবে না? চোখ বন্ধ করে চিন্তা করো তো একটু। আমি চিন্তা করে হেসে ফেলেছিলাম। সাথে সাথে অর্জন করেছিলাম নতুন এক শিক্ষা –“নতুন কিছু দেখলে মানুষ অবাক হতেই পারে, হাসতেই পারে এতে কষ্ট পাবার কিছু নেই। আমরা কষ্ট পাই নিজেকে দিয়ে চিন্তা করতে পারিনা বলে। মানুষ দাগ দেখে কারন তাদেরকে দাগকে এড়িয়ে যেতে শেখানো হয়নি বলে। আর এই পৃথিবীতে ভালো মানুষের সংখ্যাই বেশি।”
এখানে আরেকটা লক্ষণীয় বিষয় কি জানো স্বাতী? বাচ্চার মধ্যে যদি কোন খুঁত থাকে বা দোষ থাকে বাবা-মার কখনোই উচিত না কোন উপমা ব্যবহার করে তাকে সেটা বলা বা বোঝানো। বাচ্চাকে খুশি করতে গিয়ে তারা যে ভুল তথ্যটা বাচ্চাকে দেয় এক কারনে বাইরের জগতে বাচ্চা পড়তে পারে চাপের মুখে এবং তার মধ্যে জন্ম নিতে পারে হীনমন্যতা। আর হীনমন্যতা এমন এক কীট যার ফলে ধ্বসে যেতে পারে আত্মবিশ্বাস। অথচ আত্মবিশ্বাস বা আত্মমর্যাদা বোধই একজন মানুষকে মানুষ হিসেবে সুস্থ ও সুন্দর ভাবে বাচতে শেখায় এবং এটাই মানুষের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। তাই বাচ্চা যাতে নিজের সম্পর্কে কোন ভুল ধারণা বা ভ্রান্ত বিশ্বাস মনের মধ্যে লালন করতে না পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে বাবা-মাকে।
জ্বি আমিও এই কথাটাই বলতে যাচ্ছিলাম। বাবা মায়েরা প্রায়ই সময় সন্তানকে আশ্বস্ত করতে গিয়ে, স্বান্ত্বনা দিতে গিয়ে এটা খেয়াল রাখতে ভুলে যান, বাইরের মানুষেরা তাদের মতো করে আগলে রাখবে না তাদের সন্তানদেরকে। মনে যাতে সামান্য ব্যথাও না পায় এই খেয়াল রেখে কথা বা আচরণ করবে না বাইরের মানুষেরা। তাই সন্তানের তরে আশ্রয় হবার সাথে সাথে তারা যাতে নিজেও নিজের আশ্রয় হতে পারে সে শিক্ষাটাও দিতে হবে। আমরা যখন ছোট ছিলাম মাসে একবার আমাদের পারিবারিক বৈঠক বসতো। সবাই সবার কাজের সমালোচনা করাই ছিল বৈঠকের উদ্দেশ্য। আমরা সবাই খোলামেলা আলোচনা করতাম কার কোন আচরণটা ঠিক হয়নি, কোন কথাটা এভাবে না বলে অন্য ভাবে বললে বেশি সুন্দর হতো। কার ব্যবহার কষ্ট দিয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। সাব্বিরের স্বভাব ছিল সারাক্ষণ সবার খুঁত ধরা। বাবা সবাইকে বোঝাতন, যাকে দরকার ধমকে দিতেন কিন্তু এই খুঁত বিশেষজ্ঞকে কখনোই কিছু বলতন না। প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে একদিন প্রশ্ন করেছিলাম, বাবা তুমি সাব্বিরকে কখনো কিছু কেন বলো না? বাবা হাসতে হাসতে জবাব দিয়েছিলেন, কারণ সাব্বিরের এই দোষটা তোমাদের বাকি সবাইকে সতর্ক হতে সহায়তা করছে খুব। সেদিন বাবার আলোচনা থেকে জেনেছিলাম-“সুন্দরের মাঝে যখন কোন দাগ থাকে মানুষ না চাইলেও সেদিকে নজর দিতে বাধ্য হয়। সাদার বুকে একফোঁটা কালো এমন ভাবে জ্বলজ্বল করে যে চোখে পড়েই যায়। সবসময় দাগকে দেখা মানেই সুন্দরকে অবমাননা করা নয়। তাই যারা সুন্দর মনের মানুষ তারা অন্যের দাগটাকে দেখে তাকে ছোট করার জন্য নয় বরং শুধরে দেবার জন্য। জীবনে এমন মানুষের জন্য মনের দরজা খুলে অপেক্ষা করা উচিত। কারন এরা আরো শুদ্ধ হতে আরো নিখুঁত হতে সহায়তা করে যাইহোক, এসব আলোচনা এখন থাক। এসব নিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে বসতে হবে তোমার সাথে। বোনেরা তাদের বাচ্চাদের যে প্রশ্নগুলো দিয়েছে সেগুলো নিয়েও আলোচনা করতে হবে তোমার সাথে। বাচ্চাদেরকে যে কোন কিছু সহজ ও সুন্দর করে বোঝানোতে তুমি আমার চেয়ে হাজার গুণ বেষ্ট, আলহামদুলিল্লাহ। অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। তুমি রুমে যাও। আমি তোমার বাসন্তী পরীর হাত থেকে গল্পের বই নিয়ে তাকে ঘুমের রাজ্যে পারসেল করে আসি।
আরভ হেসে বলল, চলো দুজন মিলেই বাসন্তী পরীকে ঘুমের রাজ্যে পারসেল করার আয়োজন করে আসি।
স্বাতী হেসে বলল, ঠিক আছে চলো।

চলবে…

 পর্ব-৪

Facebook Comments