মিথিলা ফেরদৌস
বাবা দিবস মাথায় রেখেই আব্বাকে ফোন করলাম।আমার বাবার অবশ্য দিবস নিয়া তেমন কোনও মাথা ব্যথা কখনওই ছিলনা।এমনকি সে আমার জন্মদিবসও মনে রাখতে পারেনা।কিন্তু আজ ফোন করার পর মনে হলো,সে অপেক্ষাই করছিল,আমার ফোনের জন্যে।
ঃআজ বাবা দিবস!
ঃহ্যা জানি তো!
ঃতুমি “বাবা দিবস” জানো!!
ঃবাবা হিসেবে কোনও দায়িত্ব তোমার জন্যে কখনও পালন করিনি।
ঃকথা সত্য।পালন করা উচিৎ ছিল।এখন আর কি করবা?
ওপাশে মন খারাপের নিঃশব্দতা।আমি বলতে থাকি।
ঃযা করোনি, করোনি,এখন করা শুরু করো।ঠিকঠাক মতো ঔষধ খেতে হবে,সুস্থ হতে হবে আরও বহুদিন দায়িত্ব নিয়ে সুস্থ থাকতে হবে,তোমার নাতির মানুষ হওয়া দেখতে হবে।আপাতত সুস্থ থাকাটাই আমার জন্যে তোমার দায়িত্ব।যেহেতু আগে দায়িত্ব পালনে অবহেলা করছো।ঠিক আছে?
ঃঠিক আছে।
ঃতুমি কি কখনও আমাকে আদর করোনি?
ঃআদরই করছি,আর কিছু তো করিনি।
ঃবাবারা আদর ছাড়া আর কি কি দায়িত্ব পালন করে?
ঃতোমার মা তোমার জন্যে যে কষ্ট করছে তার একটুও আমি করিনি মা।
ঃতাও ঠিক।কিন্তু তুমি কি আমাকে খাওয়াওনি,পড়াওনি?
ঃকরছি।সেইটা খুব ভালভাবে করতে পারিনি।
ঃআমারতো কখনও এমন মনে হয় নাই।কারো চেয়ে কম আয়েশ করে আমি মানুষ হইছি! আমার কোনও আবদার অপূর্ন ছিল বলে আমার তো মনে পরেনা।বরং অনেকের চেয়ে অনেক কিছুই আমাদের ছিল,যা অন্যদের ছিল না, সেই আমলে।তুমি খেয়ালি ছিলে।আমার খেয়ালি বাবাই পছন্দ।হুট করে ভাল চাকরী ছেড়ে দিলে।বাপের টাকায় বানিজ্যে মনোনিবেশ করলে।সেইটায় মাঝে মাঝে চাংগা ভাব আবার মাঝে মাঝে অভাব।মোটকথা ধনী, গরীবি সব কিছুর সাথেই আমাকে অভ্যস্ত করেছো।তাহলে শুধু একসাইড ভাবো কেন?আমাকে সময় দিয়েছো।পরিক্ষার আগে বসে,তোমার ফাকিবাজ মেয়েকে রচনা,চিঠি সব ছোট করে দিতে,গ্রামার পড়াতে।ইংলিশে খুব ভাল মার্কস পেতাম তোমার জন্যে।এই যে বই পড়া অভ্যাস তা গড়ে উঠার পিছনে তোমার আর আম্মার দুইজনের অবদান ছিল।বই পড়ার অভ্যাসটাই আমার বেজ দাড় করিয়ে দিয়েছে।পড়াশুনায় ভাল হতে গেলে শুধু পাঠ্য পুস্তক বেশি পড়তে হয় না।আনন্দের মাধ্যমে অন্য বই পড়লেও সেইসব বুদ্ধিমত্তা তীক্ষ্ণ করে।তুমি সেই বেজ দাড় করিয়ে দিয়েছো।
আব্বা কথা বলতে পারেনা,শুধু বলে,
ঃআশু(তার গুনধর নাতি) কি করে?
ঃসে প্লান করছে তোমার সাদা চুল সেলুনে গিয়ে রঙ করে আনবে।সে যখন বড় হয়ে গাড়ি কিনবে,সেই গাড়ি তোমাকেই চালাতে হবে আব্বা।তোমাকে ওর গাড়ি চালানো পর্যন্ত সুস্থ থাকতে হবে।
ঃআচ্ছা মা ফোন রাখি।
ঃফোন রাখবা কেন?তুমি কেমন করে খারাপ বাবা হইলা,সেই হিসাবটা তো হওয়া দরকার তাই না?আমার দৃষ্টিতে যে বাবা তার ছেলে মেয়ে রেখে আরেকটা বিয়ে করে,সেই খারাপ বাবা!আমার বাবা সেই কষ্ট তো আমাকে দেয় নাই।তাহলে সে খারাপ বাবা হয় কি ভাবে !
ঃতোমার মত মেয়ে রেখে কোনও বাবা কি এমন করতে পারে মা?
ঃপারে আব্বা,অনেক বাবাই করে।ছেলে মেয়ে দেখে না।তোমাকে কখনও নিজের শখের কিছুই কিনতে দেখিনি।একটা ঈদ যায় নাই,আমি জামা নিই নাই এমন।অথচ তোমাকে কখনও ঈদে কিছুই নিতে দেখিনি।সেই না দেখা আমার প্রতি ঈদ আমি তোমার জন্যে ঈদে তোমার জামা কিনে কি শান্তি পাই তোমাকে কখনও বোঝাতে পারবো না।আমার ছেলে যখন তোমার জন্যে জুতা পছন্দ করে,তোমার মেয়েজামাই যখন পাঞ্জাবি কোনটা কিনবে কোনটা কিনবে না কুলকিনারা পায় না।সেই সুখগুলা আমি কখনও তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না।তুমি শুধু সুস্থ থাকো আব্বা,এর চেয়ে বড় দায়িত্ব একটা বাবার জন্যে একটা সন্তানের আর দরকার নাই।
ঃমা রাখি!
আব্বা ফোন রেখে দেয়।
যার বাবা নাই,পৃথিবীতে সেই জানে বাবা শব্দটার আসল অর্থ।তুমি অন্তত আমাকে সেই কষ্ট কখনও দিও না আব্বা।তুমি সুস্থ থাকো শুধু আমার দিকে চেয়ে।তোমার প্রতিটা অসুস্থতার সংবাদ আমাকে কি অসহায় করে দেয় কিভাবে তোমাকে বুঝাবো!প্রতি রাতে হুট করে কোনও ফোন আসলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে,আল্লাহ আমাকে এমন কষ্ট কখনওই দিও না,আমার যে কোন ভাল কাজের বিনিময়ে আমার প্রিয় মুখগুলিকে সুস্থ রেখো। শেষের কথাগুলি একাই মনে মনে বলতে বলতে ফোনটা শক্ত করে ধরে থাকি।বাবার প্রতি দায়িত্ব আমার নিজেরও পালন করা হয় না।অসুস্থ বাবাকে দূরে রেখেই আমাকে থাকতে হয়।তার অসুস্থতায় অনেক সময় যেতে পারিনা,অফিসে জানিয়ে গেলেও এসে দেখি খাতায় বড় করে লাল দাগ কাটা।যারা দাগ কাটে তারা কি কখনও বাবার মিথ্যা অসুস্থতার কথা বলে ছুটি নিয়েছিলো?কেন তাহলে অবিশ্বাস করে! আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে।বাবা দিবসে কর্তৃপক্ষের কাছে অন্তত একটা অনুরোধ থাকবে,আপনার কোনও সহকর্মীর সাথে এতটা নির্দয় হবেন না।পরিস্থিতি একদিন আপনাকেও এমন কষ্টের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে পারে।