মূল
আব্দুল হামিদ আবুসুলাইমান
অনুবাদ
কানিজ ফাতিমা
একজন কর্তৃক অন্য একজনের প্রতি শক্তি প্রদর্শনের প্রশ্ন তখনই আসে যখন একজনকে অন্যের উপর ক্ষমতাবান মনে করা হয়। অর্থাৎ একজন ক্ষমতাবান ব্যক্তিই (Powerful) তার থেকে কম ক্ষমতাসম্পন্ন কোন ব্যক্তির উপর তার শক্তি বা ক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারে। কিন্তু‘ একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি তার দায়িত্বে থাকা অন্যান্য ব্যক্তিদের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকে, তাদের প্রতি ক্ষমতা প্রদর্শন করে না। কাজেই দায়িত্বশীল (Responsible) ও ক্ষমতাশীল (Powerful) শব্দ দুটির মধ্যে সুস্পষ্ট ও গভীর পার্থক্য রয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন দাঁড়ায় স্বামী-স্ত্রীর অবস্থান ইসলামের দৃষ্টিতে ক্ষমতাবান ও অধঃ¯তনের সম্পর্ক নাকি দায়িত্বশীল ও দায়িত্বের আওতাধীন ব্যাক্তির সম্পর্ক? ক্ষমতার সঙ্গে শ্রেণী বিন্যাসের কথাটিও চলে আসে। সমাজে ক্ষমতাশীল কর্তৃত্বশীল ব্যক্তিরা উঁচুশ্রেণীর বা উঁচু¯স্তরের Status পায় আর ক্ষমতাহীনরা নিম্নশ্রেণীভুক্ত হয়। সে হিসেবে পুরুষরা বা স্বামীরা যদি ক্ষমতাশীল বা কর্তৃত্বশীল হন তবে স্বাভাবিকই এই চিত্র ফুটে উঠে যে, মানবজাতি দু’টি ¯তরে বিভক্ত- ক্ষমতাসম্পন্ন পুরুষ ও ক্ষমতাধীন নারী। কিন্তু‘ প্রশ্ন দাঁড়ায়-ইসলাম কি এরূপ ¯তর বিন্যাস সমর্থন করে? শুধুমাত্র পুরুষ হবার কারণে কেউ উত্তম এবং নারী হবার কারণে কেউ উত্তম শ্রেণীভুক্ত নয় বা দ্বিতীয় শ্রেণীর স্তরভুক্ত-ইসলাম এরূপ কোন কিছুকে সমর্থন করে কি?
ইসলামী চিšতাবিদগণ এ ব্যাপারে একমত যে, নারী ও পুরুষ মানুষ হিসেবে সমান। কেউ উত্তম বা কেউ অধম নয় (৪:১; ৭:১৮৯; ৩৩:৩৫; ৯:৭১) । শুধুমাত্র নারী বা পুরুষ হবার কারণে কেউ শ্রেষ্ঠত্ব দাবী করতে পারেনা। বরং যে যত বেশি আল্লাহর আদেশ নিষেধ পালনের ক্ষেত্রে সচেতন সেই তত উত্তম। আল্লাহ বলেন: “তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম যে তাকওয়ার দিক দিয়ে উত্তম ” (কোরআন)। তাছাড়া ক্ষমতাশীল শব্দটির সঙ্গে নির্যাতন শব্দটির একটি সংযোগ রয়েছে, অপরপক্ষে, দায়িত্বশীল শব্দটির সঙ্গে রয়েছে সহানুভূতি শব্দটির সংযোগ। দায়িত্বশীল শব্দটির মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের ¯তর বিন্যাসও নেই। যেমন একজন প্রেসিডেন্টের দেহরক্ষী তার নিরাপত্তার ব্যাপারে দায়িত্বশীল। এক্ষেত্রে দেহরক্ষীর দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রকাশ পেয়েছে, প্রেসিডেন্টের তুলনায় তার শ্রেষ্ঠত্ব নয়। ইসলাম প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার স্বস্থানের দায়িত্ব দান করেছে। ইসলাম (তাকওয়া ব্যতীত অন্য কোন কারণে) কাউকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেনি। দায়িত্ব ও ক্ষমতার আলোচনা এই জন্য করলাম যে, পেটানো বা নির্যাতনের সাথে এ শব্দ দু’টির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। স্বামী নিজেকে ক্ষমতাবান মনে করলে তার মধ্যে পেটানো বা নির্যাতনের স্পৃহা তৈরি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু‘ স্বামী নিজেকে দায়িত্বশীল মনে করলে তার মধ্যে এ ধরণের মনোভাব তৈরি তো হবেই না বরং স্ত্রীর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তার মধ্যে তাগিদ তৈরি হবে। ইসলাম মূলত: স্বামীকে তার স্ত্রী ও সন্তান সন্ততির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব প্রদান করেছে। স্বামীকে স্ত্রীর উপরে ক্ষমতা প্রদর্শন বা স্ত্রীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান কোরআনের অন্যান্য আয়াত ও মেজাজের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন দাঁড়ায় সূরা নিসার ৩৪ নং আয়াতের ‘কাওয়াম’ শব্দটির সঠিক ব্যাখ্যা কি হবে? আমাদের মনে রাখতে হবে সূরা নিসার ৩৪ নং আয়াতের শেষাংশেই দরাবার কথা এসেছে। যে ‘কাওয়াম’ শব্দটি এখানে এসেছে তার ব্যাখ্যার সঙ্গে দরাবার সঠিক ব্যাখ্যা অনেকাংশে নির্ভরশীল। আব্দুল হামিদ আবু সুলেমান এ আয়তটির অর্থ করেছেন এভাবে:
“Men are the protectors and maintainers of women, because God has given the one more than the other, and because of the sustenance they provide from their own means” (4:34)
এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, “স্বামীটি রক্ষক” (Protector) অর্থ হল স্ত্রীকে সাহায্য করা ও তার ভরণপোষণ প্রদান করা তার দায়িত্ব (তাহসীব লিসান আল আরব, ইবনে মানযুর) । পরিবারে রক্ষণাবেক্ষণকারী “Maintainer” বলতে সেই ব্যক্তিকে বুঝায় যে দায়িত্বে রয়েছে (আল মুযাম আল ওয়াসিত)। কাওয়াম হচ্ছে সেই ব্যক্তি যে কার্যনির্বাহি করে (execute)(আল মুনযিদ ফী আল-লুঘাহ ওয়া আল আলাম)।
মুহাম্মদ আসাদ এ আয়তটির অর্থ করেছেন এভাবে:
“Men shall take full care of women with the bounties which God has bestowed more abundantly on the former than on the later” (4:34)
এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, ‘কাওয়াম’ শব্দটি ‘কিয়াম’ থেকে, এর অর্থ “যে দায়িত্বে থাকেন বা যিনি যতœ নেন” (“one who is responsible for or takes care of”)| (The Message of The Qur’an, p.109) যেহেতু কাওয়ামাহ অর্থ পরিবারের ভরণপোষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করা সেহেতু মনে রাখা জরুরী যে, একজন স্বামী যখন এই দায়িত্ব পালন করছেন তখন তিনি একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন। এবং এটি একজন নারীকে তার নিজের প্রতি ও সন্তানদের সঠিক পরিচর্যার প্রতি মনোযোগী হতে সুযোগ করে দেয়। মূলত: সন্তান ধারণ ও লালন পালনের কাজটি যেহেতু প্রাকৃতিক ভাবেই নারীর কাঁধে সেহেতু রক্ষণাবেক্ষণ ও ভরণপোষনের দায়িত্বটি আল্লাহ পুরুষের কাঁধে দিয়ে পারিবারিক দায়িত্বে একটি ভারসাম্য এনেছেন। এভাবেই আল্লাহ স্বামীকে স্ত্রীর রক্ষণাবেক্ষণ ও ভরণপোষণের দায়িত্ব দিয়েছেন, স্ত্রীকে শারীরিক বা মানসিক আঘাত করার ক্ষমতা প্রদান করেন নি।
আব্দুল হামিদ আবু সুলেমান তার Marital Discord: Recapturing the Full Islamic Spirit of Human Dignity বইতে এই গুরুত্বপূর্ন বিষয়টি তুলে এনেছেন। তার ব্যাখ্যাটি শিক্ষিতা সচেতন ও সম্মানবোধ সম্পন্না মুসলিম নারীদের মন ও মানসিকতার সঙ্গে সঙ্গতীপূর্ণ। এটি একদিকে যেমন সুযোগ সন্ধানী কিছু পুরুষের নির্যাতনের সব পথ বন্ধ করে দেয় তেমনি ইসলামের ছিদ্রান্বেষীদের ‘ইসলাম নারী নির্যাতন সমর্থন করে’ এই চিরায়ত অপবাদের পথও রুদ্ধ করে। কাজেই এটা সময়ের দাবী যে মুসলিমরা ‘দরাবার’ এই ব্যাখ্যাটি জানবেন ও বিবেচনায় আনবেন। সেই বিবেচনায় এই বইটির বাংলা অনুবাদ করার প্রয়াস পেয়েছি। সবাই হয়তো এ ব্যাখ্যার সাথে একমত হবেন না। কিন্তু‘ এ ব্যাখ্যাটি অবশ্যই অন্যান্য ব্যাখ্যা গুলোর পাশাপাশি তার শক্ত অবস্থান করে নেবে। এ ব্যাখ্যাটি নারীদের প্রতি ইসলামের সম্মান সূচক দৃষ্টিভঙ্গীর আরেকটি স্বাক্ষর বহন করবে।
এটা সর্বজনবিদিত যে একটি ভাষার শব্দের হুবহু অর্থ অনেক সময়ই অন্য ভাষার খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই আমি পরিস্কার ভাবে পাঠকদের বোঝার সুবিধার্থে কিছু শব্দের বাংলা অর্থের সাথে সাথে ইংরেজী শব্দটিও উল্লেখ করের্ছি। সর্বোপরি আমি পাঠকদের সুবিধার্থে প্রবন্ধটির হুবহু নয় বরং সরল অনুবাদ করেছি। সবাই উন্মুক্ত মন ও যুক্তিশীল দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে এই প্রবন্ধটি পাঠ করবেন- এমন আশা করি।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে কবুল করুন। আমীন।
চলবে…..