banner

মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 376 বার পঠিত

 

রূপান্তরের যাত্রা – পর্ব ৯


তাহনিয়া খান


Bismillahir Rahmanir Rahim

Rabbish rahli sadri wa yas-sir li amri wahloul uqdatam mil-lisaani yafqahu qawli.
O my Lord! expand me my breast; Ease my task for me; And remove the impediment from my speech, So they may understand what I say[20:25-28]

দু’এক দিনের মাঝেই হারাম শরীফে নামায পড়ায় অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। প্রতিটা নামাযের পর একটা করে জানাজার নামায থাকতোই। প্রথমবার বুঝিনি সবাই কি নামায পড়ছে। পরে ভাইয়ের কাছে জেনেছিলাম। কীভাবে পড়তে হয় সে নিয়মটাও শিখে নিয়েছিলাম । নীচে ভিড়ের কারণে ছাদে তাওয়াফ করতাম প্রায়ই। পায়ে ব্যথা হতো। আলহামদুলিল্লাহ্‌, তারপরেও থেমে ছিলাম না। আমাদের গ্রুপে এক ভদ্রলোক ছিলেন, উনি প্রতিদিন ৬/৭ বার তাওয়াফ করতেন। আমরা নাম দিয়েছিলাম তাওয়াফ চাচা।

আমরা দু’ভাই বোন কোন ছবি তুলিনি হজ্জে গিয়ে। আমার ভাই বলেছিল ইবাদতের চেয়ে ছবি তোলার দিকে বেশী মনোযোগ চলে যাবে। সব ছবি হৃদয়ে গেথে রেখেছি। তাই হজ্জের কোন ছবি দেখলে খুব আগ্রহ নিয়ে দেখি। মনে হয় এই জায়গা দিয়ে তো আমিও হেঁটেছিলাম। কিন্তু আমার ভাই অনেক মানুষের ছবি উঠিয়ে দিয়েছিল। কাবা ঘরের সামনে মোনাজাতের ভঙ্গিতে ফটো তোলা সহ বিভন্ন এঙ্গেলের হাস্যকর ছবি মানুষের অনুরোধে সে তুলে দিয়েছিল। মার্কেটে বেশী ঘুরতাম না। আমার ভাইয়ের কথা ছিল দুনিয়ার চাকচিক্য দেখে ইবাদতের যেন কোন ঘাটতি না হয়।

মক্কার মানুষের কিছু জিনিস খুব ভালো লেগেছে। যে কয়টা দোকানে গিয়েছিলাম, বেশীরভাগই ছিল বাংলাদেশীদের দোকান বা সেখানে বাংলাদেশীরা কাজ করতো। তাদের অমায়িক ব্যবহার খুব ভালো লেগেছিল। শুধু বাংলাদেশী না, সব দোকানদারই ছিল অমায়িক। খেজুর কিনতে গিয়েছি, জোর করে খেজুর খাইয়েছে। ভালো লাগলে যেন কিনে নেই। নতুন কোন খাবার দেখলে কিনবো নাকি কিনবো না দ্বিধায় ছিলাম, জোর করে টেস্ট করিয়েছিল সেটা। খেয়ে ভাল লাগেনি, তো কিনিনি। তাতে দোকানী মন খারাপ করেনি।

একদিন রাস্তায় নামায পড়ার জন্য দাঁড়িয়েছি। ভিড়ের কারণে মসজিদের ভিতর ঢুকতে পারিনি। আমার ভাই বললো, পাশের মার্কেটের চার তালার উপরে নামায পড়ার জায়গা আছে সেখানে গিয়ে জামাত ধরতে পারবো। রাস্তা থেকে মার্কেটের ভিতর ঢুকে গেলাম। পুরো মার্কেট ফাঁকা। দোকানদারও নেই। সবাই দোকান খোলা রেখেই নামাযে চলে গিয়েছে। দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কোন কিছু টুপ করে নিয়ে নেওয়া যাবে সহজেই। কিন্তু কেউ নিবে না বা নেয় না। কারণ ধরা পরলেই হাতের কব্জি কেটে ফেলবে। এই আইন এবং আইনের প্রয়োগ আছে বলেই মানুষ নিশ্চিন্তে থাকে।

আমি প্রায় প্রতিদিনই হারাম শরীফের একদম কাছের এক দোকান থেকে সফট আইসক্রিম কিনে খেতাম। একদিন দোকানীকে বললাম আমি সবগুলো ফ্লেভার একসাথে নিতে চাই। দোকানী আমাকে সব ফ্লেভার একটু একটু করে দিয়ে এত্ত বড় এক কোন আইসক্রিম বানিয়ে দিলেন, কিন্তু আগের দামটাই রাখলেন। এটা শুধু আমার জন্য না। সবার জন্যই এই নিয়ম। আরেকদিন নতুন আরেকটা আইসক্রিমের দোকান আবিষ্কার করলাম আমরা। সেখানে বেশ চড়া দামে আইসক্রিম বিক্রি হচ্ছে। দোকানদার একজন শ্রীলঙ্কান। আমরা দু’জনই দুটো করে ফ্লেভার অর্ডার দিলাম। আমি আগে আমারটা পেলাম। কিন্তু আমার ভাইকে উনি ভুল করে অন্য একটা ফ্লেভার দিয়ে দিয়েছিল। আমার ভাই যখন বললো সে সেটা চায়নি, ভদ্রলোক ‘সরি’ বলে সেই আইসক্রিমের সাথে মিলিয়ে অর্ডার দেওয়া আইসক্রিম দিয়ে দিলেন। আমার ভাই বলেছিল যে লাগবে না, কিন্তু তিনি শুনবেনই না, এতগুলো আইসক্রিম দিয়ে একটা বড় হাসি দিলেন। আমার ভাই মহা খুশী। তার হাতে তিনটা ফ্লেভারের আইসক্রিম। আমিও ভাগ বসিয়েছিলাম তারটায়।

একদিন নামায শেষে এমন ভিড়ের মাঝে পরেছি যে ধাক্কাধাক্কি অবস্থা। আমি ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ পড়া শুরু করলাম। কোথা থেকে তিনজন বাংলাদেশী লোক এসে আমাদের ঘিরে ফেললো। যাতে আমার কোন ধাক্কা না লাগে। আমার ভাইতো এমনিতেই সব সময় পিছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরে ধাক্কার হাত থেকে বাঁচাতো। কিন্তু তখন তার খুব কষ্ট হচ্ছিল। সেই লোকগুলো ঘিরে ধরে আমাদের ভিড় থেকে বের করে আনলেন। পরে জেনেছি, উনারা অনেকদিন ধরে সেখানে ব্যবসার কারণে বসবাস করেন।

কত বয়স্ক মানুষ এস্কেলেটরে উঠার সময় পরে যেতেন, আমাদের চোখের সামনে প্রায়ই এমন হতো। আমার ভাই দৌড়ে যেত। অনেক বাংলাদেশী ক্লিনারদের দেখেছি বয়স্কদের সাহায্য করতে। ছাদে নামায পড়তাম সবসময়। জমজমের পানি নেওয়ার জন্য ভিড় লেগেই থাকতো সেখানে। এক বাংলাদেশী ক্লিনার আমাকে প্রায়ই পানি এনে দিতেন। এত ভিড়ের মাঝে উঠে গিয়ে পানি আনতে গেলে জায়গা আর পাওয়া যাবে না। তাই উনাকে বলতাম পানি এনে দিতে। বাংলাদেশী টাকা দিয়ে দিলেই খুশী হয়ে যেতেন।

হজ্জের নবম শিক্ষা– ইহসান। মানুষের প্রতি মানুষের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, বিনিময়হীন এমন সদয় ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করেছে। একদিন, দু’দিন নয়, প্রতিদিন মানুষের এমন ব্যবহার দেখে নিজেকে বিচার করেছি । লজ্জিত হয়েছি । নিজের ক্ষুদ্রতাকে তখন বড় দৃষ্টিকটু মনে হয়েছে।

পর্ব ৮

Facebook Comments