banner

রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 808 বার পঠিত

 

প্রতিবেশিনী……১


আফরোজা হাসান


দরজায় চাবি ঢুকিয়ে মোচড় দিতেই এতক্ষণের ধরে রাখা উত্তেজনা ক্লান্তির কণিকা রূপে সারা শরীর জুড়ে প্রবাহিত হয়ে গেলো মাহামের। উফ…শুধু শুধুই সে রেসের ঘোড়ার মত ছুটেছে এতক্ষণ। বাইরে থেকে ফিরে তাকে বাসায় না দেখলে ভীষণ বিরক্ত হয় আয়ান। সুপার মার্কেটে এক পরিচিত অ্যান্টির সাথে দেখা হয়ে গেলো হঠাৎ। এমন গল্প জুড়ে দিলেন ভদ্রমহিলা যে থামারই নাম নিচ্ছিলেন না। মাহাম কয়েকবার বলেছেও অ্যান্টি আমার একটু তাড়া আছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। তাড়ার কথা শুনে উনি বরং লাফ দিয়ে দু’কদম এগিয়ে এসে খপ করে মাহামের হাত চেপে ধরলেন।

বাধ্য হয়ে মাহাম জানালো যে তার স্বামীর বাসায় ফেরার সময় হয়ে গিয়েছে। এই কথা শুনে ভদ্রমহিলা একরকম ঝাড়িই দিলেন মাহামকে। বললেন, সেজন্য তুমি এমন দৌড়াবা নাকি? তুমি সারাদিন একা একা অপেক্ষা করো না বাসায় জামাইয়ের জন্য? এখন তারে একটু অপেক্ষা করতে দাও। পুরুষ মানুষেরও বোঝা উচিত সারাদিন বাসায় বসে অপেক্ষা করতে কেমন লাগে। এরপর দেয়া শুরু করলেন সাংসারিক পরামর্শ। যার সারমর্ম হচ্ছে স্বামীদের কখনোই বিড়াল মারতে দেয়া ঠিক না। না বাসর রাতে না অন্য কোন রাতে। সংসারে বিড়ালকে জীবন্ত রাখতে হবে। বিড়ালের মিউ মিউ ছাড়া সংসার পানসা।

ভদ্রমহিলার সাংসারিক ক্লাস থেকে ছুটি পেয়ে একরকম দৌড়েই বাসায় এসেছে মাহাম। কিন্তু দরজার চাবি দিয়ে লক খোলা দেখে বুঝতে পারলো আয়ান চলে এসেছে বাসায়। মনটা অনেক বেশি খারাপ হয়ে গেলো মাহামের। অল্প যে কয়েকটা আবদার আয়ান তার কাছে করেছে, বাসায় ঢুকেই তার হাসিমুখ দেখা সেগুলোর মধ্যে একটি। কয়েকদিন আগে নাস্তার টেবিলে একটা ব্যাপারে দুইজনের কিছুটা মত পার্থক্য হয়েছিলো। কিছুটা বিরক্তি নিয়েই বাসা থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিল আয়ান। কিন্তু বাসায় ফেরার আগে মোবাইলে ম্যাসেজ পাঠালো জানি যে আমাদের মনোমালিন্য চলছে। সেজন্য কথা বলা আমাদের। দয়া করে বাসায় ঢুকে যেন তোমার হাসি মুখ দেখি। তা না হলে কথা বলতেই ইচ্ছাই করবে না আমার।

ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকলো মাহাম। কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগছে তার। আয়ান প্রশ্ন করলে কি জবাব দেবে? এইসময় তো সুপার মার্কেটে না গেলেও হতো তার। পুরো বাসায় চোখ বুলিয়ে বুঝলো আয়ান ওয়াশরুমে। কিনে আনা জিনিসপত্র গুলো গুছিয়ে শোবার ঘরে ঢুকলো মাহাম। ড্রেসিংটেবিলের উপর একটা প্যাকেট দেখে হাতে তুলে নিলো। প্রতিমাসে আয়ান তার জন্য একটা করে লাভস্টোরি নিয়ে আসে। আয়ানের মতে মাহাম হচ্ছে এই নোবেল প্রাইজ পাবার মত আনরোম্যান্টিক মেয়ে। পৃথিবীর বিখ্যাত সব লাভস্টোরি পড়িয়ে তাই মাহামকে রোম্যান্টিক বানানোর চেষ্টা করছে সে।

আয়ানকে রুমে ঢুকতে দেখে সালাম দিয়ে আনিকা বলল, তুমি আবারো আমার জন্য ইয়াকি একটা লাভ স্টোরি নিয়ে এসেছো?

সালামের জবাব দিয়ে হাসতে হাসতে আয়ান বলল, হ্যা বেছে বেছে স্টোরের সবচেয়ে ইয়াকি লাভ স্টোরিটা নিয়ে এসেছি তোমার জন্য।

আয়ানের হাসিমুখ দেখে মাহামের মনের ভুবনে আনন্দধারা বইতে শুরু করলো। যাক তাহলে খুব বেশি বিরক্ত হয়নি আয়ান। আলাহামদুলিল্লাহ! আলহামদুলিল্লাহ্‌! মাহাম কখনোই চায় না আয়ানের আবদারের জিনিস গুলোতে কোন ঘাটতি রাখতে। যে মানুষটা তাকে এত ভালোবাসে এইটুকু দাবী সে অন্তত রাখে যে মাহাম তার ইচ্ছে গুলোকে মূল্য দেবে। আর এভাবেই তো একে অন্যের প্রতি আস্থা বাড়তে থাকে ধীরে ধীরে।

দেড় মাসের সংসার জীবনের প্রতিটি দিনকেই ভালোবাসার এক একটি মহাকাব্য মনেহয় মাহামের কাছে। সে শুধু পাশে থেকেছে কিন্তু মহাকাব্য রচনার কাজ আয়ানই করেছে, করে। শ্বাশুড়ির প্রতি আবারো কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠলো মাহামের মনটা। তাদের বিয়ের রিসিবশনের পর একরকম জোর করেই দুজনকে এই ফ্ল্যাটে উঠতে বাধ্য করেছেন তিনি। উনার যুক্তি ছিল সারাজীবন পরিবারের সাথেই থাকতে হবে তোমাদেরকে। কিন্তু সংসার শুরুর এই প্রথম দিনগুলি যদি সুযোগ থাকে তাহলে শুধু একাকী নিভৃতে কাটানো উচিত দুজনার। তোমাদের যখন সেই সুযোগ আছে সুতরাং কাজে লাগাও। যদিও পরিবারের সবার জন্য খুব খারাপ লাগে মাহামের। রোজই চলে যায় শ্বশুরবাড়ি আর বাবার বাড়িতে। আয়ান ফিরে আসার আগেই আবার চলে আসে।

খাবার দেবার জন্য মাহাম রান্নাঘরে ঢুকলে আয়ানও এলো পেছন পেছন। বাসায় থাকলে কখনোই কোন কাজ মাহামকে একা করতে দিতে চায় না আয়ান। কিন্তু মাহামই আপত্তি করে আয়ান কাজ করতে এলে। এরও অবশ্য একটা কারণ আছে। গত কয়েকদিন আগে শীল-পাটায় তাকে ভর্তা করতে দেখে, পাটায় বাটতে কেমন লাগে সেটা ট্রাই করে দেখতে চাইলো আয়ান। শীল-পাটার সাথে আয়ানকে যুদ্ধ করতে দেখে খুব হাসছিলো মাহাম। ছোট ননদ বেড়াতে এসেছিল সেদিন তাদের বাসায়। হঠাৎ খেয়াল করলো পর্দার ফাঁক দিয়ে ছোট ননদ দন্ত বিকশিত করে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। দুষ্টু প্লাস ফাজিলের চূড়ান্ত একটা মেয়ে তার ননদটি। আর বিবিসি-সিএনএন তো দুধের শিশু ওর কাছে। তাই কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিবারের সবার ঘরে ঘরে পৌছে গেলো এই সংবাদ।
ছোট খালামণি ফোন দিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, শুনলাম আয়ান নাকি তোকে মসলাও বেটে দেয়? হিহিহি…হাহাহা…! মামণি কল দিয়ে বলল, এইসব কি শুনছি জামাইকে দিয়ে তুই মসলা বাটাবি কেন? সবকিছুর তো একটা শোভন অশোভন বলেও কিছু আছে নাকি? বাবা ফোন করে বললেন, কি রে মা জামাইয়ের হাতে আবার ফোসকা পরেনি তো? বাবার কণ্ঠ শুনেই শুনেই মাহাম বুঝতে পারছিলো বহু কষ্টে হাসি চেপে ধরে কথা বলছেন। দেবর ম্যাসেজ পাঠালো, ভাবী প্লিজ মানুষকে গৃহপালিত বানানোর টিপস গুলা দাও তো আমাকে। তোমার দেবরাণীর উপর এপ্লাই করতে চাই। তারও কিছুক্ষণ পর দরজার নীচ দিয়ে ঢুকলো একটা চিরকুট। তাতে লেখা ছিল, এক ছিল বেচারা তাকে নিয়ে লিখছি ছড়া, সিংহ সেজে ঘুরতো সে বিয়ে করেই খাইলো ধরা।

একদিন সকালে উঠে দেখে তাদের পাশের ফ্ল্যাটে নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। কিছুক্ষণ পর ডোর বেল বাজলে মাহাম দরজা খুলে দেখে প্রতিবেশিনী দাঁড়িয়ে আছে। তাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই প্রতিবেশিনী বলল, প্রতিবেশীর হক সম্পর্কে নিশ্চয়ই জানা আছে আপনার? রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘জিবরাঈল (আ.) আমাকে প্রতিবেশী সম্পর্কে এত বেশি অসিয়ত করছিলেন, একপর্যায়ে আমার ধারণা হয়েছিল যে, আল্লাহ তাআলা মনে হয় প্রতিবেশীকে উত্তরাধিকারী করে দেবেন।’ তিনি আরো বলেছেন- -‘ যে আল্লাহর প্রতি এবং পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে সে যেন প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়।’ এবং একথাও বলেছেন- ‘সে ব্যক্তি মুমিন নয় যে পেট ভরে খায়, অথচ তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে’।

সুতরাং আজ দুপুরে আপনাদের বাসায় আমাদের দাওয়াত। তাড়াতাড়ি রান্না শেষ করে আমার ফ্ল্যাটে আসেন। গোছগাছ করতে সাহায্য করবেন আমাকে। বলেই সে তার ফ্ল্যাটে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো। সাথে সাথেই আবার খুলে বলল, দুই কাপ চা পাঠিয়ে দেন তো। কাজ করতে করতে মাথা ধরে গিয়েছে। এই প্রতিবেশিনী আসার পর থেকে মাহামের জীবনের শান্তি শেষ। দিনের মধ্যে দশ-বারোবার হানা দেয় সে মাহামের ঘরে। কখনো কাপ নিয়ে এসে বলে একটু চিনি দেন, কখনো বলে চা পাতা দেন, কখনো বলে প্লিজ আপনার ঘর মোছার সময় আমার ঘরটাও একটু মুছে দিয়ে যাবেন। আর প্রতিদিনই তিন বেলার যে কোন একবেলা সে দাওয়াত খায় মাহামের বাসায়।

ডোর বেলের শব্দ কানে যেতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো মাহাম। ঐ যে আবারো এসে হাজির তার প্রতিবেশিনী……

চলবে…

Facebook Comments