banner

মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 1211 বার পঠিত

 

মালয়েশিয়াতে বিবাহবিচ্ছেদ সমস্যা


রেহনুমা বিনত আনিস


সুপ্রিয়া,

আপনি জানতে চেয়েছেন মালয়দের মাঝে বিবাহবিচ্ছেদ এবং পরকীয়া এত বেশি কেন। নারীপুরুষের শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং কর্মক্ষেত্রে বিচরণের ক্ষেত্রে এত তারতম্য কেন। আমি ঘরকুনো মানুষ। ঘরের বাইরে দুরে থাক, নিজের রুমের বাইরেই যাই কম। তবে যখন বেরোতে বাধ্য হই, প্রচুর মানুষের সাথে কথা বলি, তাঁদের পর্যবেক্ষণ করি, ফলে কিছু বিষয় জানার সুযোগ হয়। তার ওপর ভিত্তি করে যতটুকু উপলব্ধি হয়েছে সেটা আপনার সাথে শেয়ার করছি।

মালয়শিয়ার ব্যপারে আমাদের মাঝে একটা ভুল ধারণা প্রচলিত রয়েছে। এটি মুসলিম দেশ নয়। এমনকি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বলাও কঠিন। এখানে মাত্র ৬১% মুসলিমের বসবাস যেখানে বাংলাদেশে এই অনুপাত ৯০%। মালয়রা দেশটিকে মুসলিমদের জন্য অনুকূল বাসস্থান হিসেবে গড়ে নিয়েছে, কিন্তু মূলত এটি ফার্স্ট ওয়ার্ল্ডের অন্তর্ভুক্ত এবং এদের চালচলন তেমনই।

এখানকার মুসলিম বাবামায়েরা ইসলামে প্রদত্ত তিনটি দায়িত্বের মাঝে একটি খুব ভালভাবে পালন করে, একটি আধাআধি পালন করে, আরেকটি করেনা। ওরা সন্তানের সুন্দর নাম রাখে, ইসলামের বেসিকটুকু শেখায়, কিন্তু সন্তানের বিয়ের ব্যপারে কোন দায়িত্ব গ্রহণ করেনা। মালয় ছেলেমেয়েরা অল্প বয়সে বিয়ে করে থাকে, নিজের পছন্দে। প্যারেন্টাল গাইডেন্স ব্যতীত গৃহীত এই সিদ্ধান্ত কতটুকু বাস্তবতার ওপর প্রতিষ্ঠিত আন্দাজ করতে পারছেন নিশ্চয়ই। ফলে গোঁড়াতেই গলদ রয়ে যায়।

ওরা সাধারনত সমবয়সী বিয়ে করে। একটি বৈবাহিক সম্পর্কে অন্তত একজন ম্যচিউর চিন্তাভাবনাসম্বৃদ্ধ হলে বিয়েটাকে ফলপ্রসূ করা সহজ হয়। কিন্তু দুজনই যদি অপরিপক্ব হয় তাহলে কেউই বিয়ের তাৎপর্য, দায়বদ্ধতা কিংবা দায়িত্ব সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে পারেনা। ফলে বিবাহবিচ্ছেদের বীজ প্রোথিত হয়ে যায়।

ওদের পুরুষরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে অলস এবং অকর্মন্য হয়ে থাকে। ফলে নারীদের এগিয়ে আসা ব্যতীত উপায় থাকেনা। লেখাপড়ায় এগিয়ে থাকার ফলে চাকরীর ক্ষেত্রেও স্বাভাবিকভাবেই নারীরা এগিয়ে থাকে। ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড কান্ট্রিগুলোতে বিয়ের ক্ষেত্রে সমযোগ্যতা ফ্যাক্টর নয়। তাই শিক্ষাগত যোগ্যতার পার্থক্য বিয়ের জন্য প্রতিবন্ধক নয়। উপরন্তু পুরুষদের সংখ্যাস্বল্পতা খুব একটা বাছাবাছি করার সুযোগ রাখেনা। ক্যানাডাতেও একই চিত্র দেখেছি।

এখানে বিয়ের সময় থেকেই দুজনে মিলে স্থির করা হয় সংসারের কোন খরচ কে দেবে। ফলে নারীদের কাজ না করে উপায় থাকেনা। নারীরা ঘরে বাইরে সবদিকে কাজে ব্যস্ত থাকে। সে সুযোগে অনেক পুরুষ নতুন নতুন গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কয়েকবার ধরা পড়ার পর নারীরা বিরক্ত হয়ে যায়। ফলে পরিস্থিতি দুটি বাজে দিকের মাঝে আবর্তিত হতে থাকে – একটি পরকীয়া, আরেকটি বিবাহবিচ্ছেদ।

পরকীয়ার পেছনে মূলত দুটি ফ্যাক্টর কাজ করে। একটি বিবাহের ক্ষেত্রে অপরিপূর্ণতা, অপরটি বিপরীত জেন্ডারের সাথে মেলামেশার সুযোগের সহজলভ্যতা। পুরুষদের অকর্মন্যতা, উপরন্তু বিশ্বাসঘাতকতার কথা তো বললাম। এখানকার নারীরা ঘরেবাইরে এত কাজ করে যে বাইরে বেরোনো, পুরুষদের সাথে ওঠাবসা ওদের জন্য ডালভাতে পরিণত হয়। আমি দেখে অবাক হয়েছি ওরা নারীপুরুষের মাঝে মিনিমাম ডিস্টেন্স বজায় রাখেনা। পাশে বসা, গা ঘেঁষে চলাফেরা, গায়ে হাত দিয়ে কথা বলা এমন অকল্পনীয় ব্যপারগুলো ওদের কাছে খুব স্বাভাবিক, এমনকি আপাতদৃষ্টে পর্দানশীন মেয়েদের মাঝেও।

অধিকাংশ নারীপুরুষ মিনিমাম লেভেলে ইসলাম মেনে চলে। টাইটফিটিং প্যন্টশার্টের সাথে মাথায় একটা হিজাব বেঁধে খুশি হয়ে যায়। আবার মসজিদে গেলে পর্দার অভাব ঢাকতে আলাদা পোশাক পরে নামাজ পড়ে। এভাবে ছাড় দিতে দিতে আল্লাহর প্রতি দায়বদ্ধতা যে পর্যায়ে পৌঁছয় সেটা তখন আর অন্যায়ের পথে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে যথেষ্ট মজবুত সাপোর্ট দিতে পারেনা।

সাংসারিক দায়িত্বের পরিমাণ যত বাড়তে থাকে গান বাজনা নাটক সিনেমার মোহময় আবেশে নিমজ্জিত মানুষগুলোর কাছে বাস্তবতা বড় কঠিন মনে হতে থাকে। এক পর্যায়ে কেউ কেউ পুরাতন স্বপ্ন ফেলে রেখে নতুন স্বপ্নের উদ্দেশ্যে উড়াল দেয়। ফলে আমি এমন নারী দেখেছি যে প্রাক্তন স্বামীর কাছে থেকে একটি ফুটো পয়সা সাহায্য ব্যতিরেকে সন্তানদের প্রতিপালন করছে। এমন পুরুষও দেখেছি যারা মায়ের কাছ থেকে এক বিন্দু স্নেহ ব্যতিরেকে সন্তানদের মানুষ করছে।

তবে এই অবস্থা মনে হয় এখন মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র। গতকাল একজন গবেষকের সাথে দীর্ঘ আলোচনা হল। তাঁর বাবা মালয়শিয়ার আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, তিনি নিজে পি এইচ ডি। বর্তমানে ভারতীয় মুসলিম জনগোষ্ঠীর মাঝে ডিভোর্সের আশঙ্কাজনকভাবে ক্রমবর্ধমান হার নিয়ে কাজ করছেন। কিন্তু ডিভোর্সের কারণগুলো মোটামুটি একই – বৈবাহিক জীবনের তাৎপর্য উপলব্ধি করার ব্যর্থতা, পারস্পরিক সম্মানবোধ এবং বিশ্বস্ততার অভাব, দায়বদ্ধতার অভাব, দায়িত্বানুভূতির অভাব, অর্থনৈতিক চাপ, কোন কোন ক্ষেত্রে আত্মীয়স্বজনদের দ্বারা সৃষ্ট চাপ, চারিত্রিক দৃঢ়তার অভাব এবং সর্বোপরি আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার অনুভূতির অভাব।

আল্লাহ ক্কুরআনে বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, তাঁর রাহমাত এবং বারাকাহ তাদের জন্যই নির্ধারিত যারা তাঁর পথকে আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করে, এই পথে অবিচল থাকার সংকল্প রাখে এবং তাঁর জন্য ত্যাগ স্বীকার করে। সত্যি কথা বলতে আমরা একটি জ্ঞানবিমুখ, আমলবিহীন, গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যাওয়া নামসর্বস্ব এবং কেবল বাহ্যিকভাবে মুসলিম জাতিতে পরিণত হয়েছি। আল্লাহর সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দুর্বলতা আমাদের অন্যান্য সম্পর্কগুলোকেও অস্থায়ী করে ফেলছে। কারণ প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও পাশে থাকা একমাত্র আল্লাহর প্রতি দায়বদ্ধতার কারণেই সম্ভব। নইলে এই কষ্ট মানুষ কাঁধে তুলে নিতে পারেনা। ঝড়ের প্রথম আভাসেই পালিয়ে যায়।

আমার স্বল্প জ্ঞান এবং অল্প অভিজ্ঞতায় এগুলোই কারণ হিসেবে চিহ্নিত করতে পেরেছি। আপনার মতামতের অপেক্ষায় রইলাম।

Facebook Comments