banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 742 বার পঠিত

 

সুস্থতার যাদুর বাক্সঃ ইতিবাচক চিন্তন (Positive Thinking)

ড. লিপি গ্লোরিয়া রোজারিও (সিস্টার গ্লোরিয়া), জেমস্ শিমন দাস


প্রাচীণগুহাবাসী মানুষ থেকে শুরু করে আজকের উন্নত, সভ্য গ্রহান্তরিত মানুষ পর্যন্ত নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য আজীবন লড়াই করে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত মানুষ ও সমাজ ব্যবস্থা বিবর্তিত, রূপান্তরিত ও পরিবর্তিত হচ্ছে। যে মানুষ সুস্থতার জন্য লতা গুল্ম দিয়ে চিকিৎসা শুরু করেছিল আজকে সে রোগের জীবাণুর জিনোম পর্যন্ত আবিষ্কার ও রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা করছে। চিকিৎসকদের সংগে সমান্তরালভাবে মানসিক সুস্থতা আনয়ন ও রক্ষার উদ্দেশ্যে মনোবিজ্ঞানীগণও আপ্রান প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে সময় এসেছে “আমরা কি অনুভব করছি” তা না ভেবে “আমরা কিভাবে চিন্তা করছি” তা নিয়ে চিন্তা করার। মানুষের সুস্থতার যাবতীয় রহস্য এই চিন্তন প্রক্রিয়ার মধ্যে নিহিত। নিচের গল্প থেকে আমরা ইতিবাচক চিন্তন প্রক্রিয়া সমন্ধে শিক্ষা নিতে পারি।

ইতিবাচক চেষ্টা বা ইতিবাচক চিন্তন প্রক্রিয়া সম্পর্কে অধিকাংশ সময়ে লোকজন ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে থাকে। তারা ভাবে যে, ইতিবাচক চিন্তন মানে স্বপ্নের এক জগৎ, সেখানে মেঘে ভাসা যায়, অসাধারণ কিছু স্বপ্নের ছোঁয়া পাওয়া যায়, সকলকিছুই কাল্পনিক বাস্তবতাবিবর্জিত, জীবনের সকল কিছুই সুন্দর, সকল কিছুই রঙিন। তারা এর মধ্যে এতোটায় বিভোর থাকে যে, সাদাসিধা সাধারণ ঘটনাকেও তারা বাস্তবতার প্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা করতে পারে না।

ইতিবাচক চিন্তন অর্থ এমন নয় যে, শুধু ভালো কিছু আপনার জীবনে ঘটবে বা এর মানে এমন নয় যে আপনি অসুস্থ হবেন না, কিংবা আপনার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার মধ্যে এমন নেতিবাচক কিছু ঘটবে না যেটা আপনাকে সমস্যাগ্রস্থ করে তুলে বা এমন কিছু ঘটবে না যার জন্য আপনি কষ্ট পান। এর অর্থ আবার এমনও নয় যে সবাই আপনাকে ভালোবাসবে, যার জন্য আপনি কখনোই কষ্ট পাবেন না এবং সব সময় আপনি জয়ী হবেন। ইতিবাচক হওয়ার অর্থ এমন নয় যে, আপনি সবসময়ই হাসবেন এবং আনন্দ, প্রেম, শান্তি ছাড়া আর অন্য কোন আবেগ অনুভব করবেন না বা কখনোই আপনি কোন বিপদের সম্মুখীন হবেন না।

কিন্তু ইতিবাচক চিন্তনের অর্থ এমনই যে, কোন একটি খারাপ/বিপরীত/বিপদসংকুল পরিস্থিতি/ঘটনা/ব্যক্তিকে একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকেই একটি আশীর্বাদ হিসেবে দেখা, জীবন চলার পথে সকল বাঁধা বিপত্তিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহন করা, সেগুলোর মুখোমুখি হওয়া যা আপনাকে সামনে এগুতে এবং জীবনের বৃদ্ধি ও উন্নতিতে সহায়তা করবে। সহজভাষায়, ইতিবাচক চিন্তন প্রক্রিয়া হচ্ছে একটা মনোভাব। শুধুমাত্র আপনার মনোভাব পরিবর্তন করুন পৃথিবীর সকল কিছুই পরিবর্তিত হয়ে যাবে। দেখবেন, মনোভাবের পরিবর্তনের সাথে সাথে আপনার মন্দভাগ্য ও অপকারিতাসমূহ উপকারীতায় রূপান্তরিত হয়েছে, নেতিবাচক যাবতীয় কিছু ইতিবাচক ও গঠনমূলক কিছুতে পরিবর্তিত হবে। রুশদেশের একটি প্রবাদ বাক্য এইরকম যে, “যখন তোমাকে লেবু দেওয়া হয়, তখন সেটাকে লেবুর রস বানিয়ে খাও।” অর্থাৎ জীবন যতক্ষণ আছে ততক্ষণ এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে এটাকে উপভোগ এবং এটার ভালো,মন্দ,টক, মিষ্টি সকল স্বাদই গ্রহণ কর। ইতিবাচক চিন্তনের ফলে ব্যক্তি ও সমাজের অভূতপূর্ব কল্যাণ সাধিত হয় এবং অনেক অসাধ্য ও অসম্ভব কাজও সম্ভব হয়ে উঠে। ইতিবাচক চিন্তনের ফলে ব্যক্তি জীবনে নিম্নরূপ উপকারীতাসমূহ পরিলক্ষিত হয়। যেমনঃ দৈনন্দিন জীবনের মানসিক চাপ ও ভুলের সংখ্যা হ্রাস, সুস্বাস্থ্য অর্জন, আত্মবিশ্বাস গঠন ও বৃদ্ধি , সুখী জীবন যাপন, জীবনের দীর্ঘায়ূ , দ্রুত ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজকরণ এবং বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।

ইতিবাচক চিন্তন যেহেতু ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে সুখ, শান্তি ও সাফল্য বয়ে আনে, সেহেতু ইতিবাচক চিন্তা করার জন্য কতগুলো ছোট ছোট টিপস্ আমরা আপনাকে জানাতে চাই।

১. ঘুম থেকে উঠেই একটি আয়নার সামনে দাঁড়ান এবং আয়নার দিকে হাঁসিমুখে তাকিয়ে বলুন,“মি: সাইমন,আমি জানি তুমি সকল কিছু করতে পারবে। আজকের দিনটা তোমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন। আজকে তুমি একটা অসাধারণ ব্যস্ত দিন কাটাবে। তোমার জন্য শুভ কামনা রইল”। যদিও এইসব আপনার কাছে মনে হয় একটু বোকা বোকা কথা-বার্তা কিন্তু এক সপ্তাহ চেষ্টা করুন তারপর ফলাফল আপনি নিজেই মূল্যায়ণ করতে পারবেন।

২. আপনি আপনার ছোটবেলার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক এ্যালবাম ঘেঁটে দেখতে পারেন যেন ছোটবেলার আনন্দ পুনরায় উপভোগ করতে পারেন।

৩. অতীতের কোন ঘটনার কথা যেটা আপনাকে সুখ দেয়, যেটাতে আপনি স্বস্তিবোধ করেন এমন স্মৃতির কথা স্মরণ করতে পারেন।

৪. ছোট ছোট ভালো কাজের প্রতি মনোযোগ দিন। সফলতা ও সুখ যেমনই হোক না কেন সেগুলোকে গ্রহণ করুন এবং সেগুলোর প্রতি সচেতন হোন।

৫. আপনি অফিসে যাচ্ছেন, এমন সময় যানজটে আটকা পড়েছেন, আপনি ভীষণ রকম অস্বস্তিবোধ করছেন। সেই সময় আপনি গান শুনতে পারেন। এটা আপনার জন্য একটা সুযোগ কারণ গান শুনার মতো সময় আপনার নাই। তাই বিরক্ত হয়ে বসে না থেকে গান শুনুন।

৬. প্রতিটি ভুল থেকে কী শিক্ষা নিতে পারেন তা খুঁজে বের করুন। কথায় বলে, যে নিজের ভুল থেকে শিখে সে বুদ্ধিমান আর যে অন্যের ভুল থেকে শিখে সে আরো বেশী বুদ্ধিমান।

৭. যারা ইতিবাচক পরামর্শদাতা, বন্ধুবান্ধব তাদের সাথে চলাফেরা করুন। যারা নেতিবাচক কথাবার্তা বলে তাদের কাছ থেকে দুরে থাকুন।

৮. খারাপ ঘটনা থেকেও কৌতুকরস বা মজা খোঁজার চেষ্টা করুন।

সুতরাং আমরা দেখছি যে, ইতিবাচক চিন্তনের ফলে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার পাশাপাশি একটি সফল ও সুখী জীবন এবং এমন কি আমরা সমাজ গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবো। আসুন আমরা যা করতে পারবো না তা নিয়ে চিন্তা করে সময় ও অর্থ অপচয় না করে, আমরা যা সৃষ্টি করতে পারবো তাতে সময় ব্যয় করি এবং জীবনে সফল হই। কারণ জগৎবিখ্যাত নাট্যকার ও সাহিত্যক স্যার উইলিয়াম শেকস্ পিয়ারের ভাষায়,
“পৃথিবীতে ভালো বা মন্দ কিছুই নাই কিন্তু আমাদের চিন্তন প্রক্রিয়ায় সেগুলো নির্ধারণ করে।”
সমস্ত পৃথিবীতে পরিবর্তন আনয়নের জন্য একটি ইতিবাচক চিন্তাই যথেষ্ট। চিন্তার ধরণ পরিবর্তন করুন, পৃথিবীই পরিবর্তন হয়ে যাবে।

Facebook Comments