তাহেরা সুলতানা
মালয় ভাষায় ‘ঈদ মুবারাক’ কে বলে ‘সালামাত হারি রাইয়া’ যার অর্থ ‘রোজা ভাংগার শুভ উৎযাপন’ অথবা ‘রোজা ভাংগার উৎসব’।
আমি প্রায় ৬ বছর যাবত মালয়েশিয়াতে অবস্থান করছি। আমার অভিজ্ঞতা থেকে ঈদকে ঘিরে মালয়েশিয়ার সংস্কৃতির কিছুটা অংশ আমি এখানে শেয়ার করার চেষ্টা করছি। যেহেতু আমার বিদেশে ঈদ উৎযাপন ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভারসিটি থেকেই শুরু হয়েছিল, তাই আমি সেখান থেকেই শুরু করছি।
মালয়েশিয়াতে আমার প্রথম ঈদ উৎযাপন ২০১১ সালে। তখন আমার স্বামী ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভারসিটিতে মাস্টার্স করছিল। আমি কোনদিন ঈদের নামাজ পড়তে মসজিদে যাইনি। এমনকি দেশে থাকতে জুম্মার নামাজ পড়তেও কখনো যাওয়া হয়নি। আসলে মেয়েরা মসজিদে নামাজ পড়তে যেতে পারে, এরকম কোন ধারনাই আমার ছিল না! সে যাই হোক, সেবার ইসলামিক ইউনিভারসিটির মসজিদে ঈদের নামাজ পড়তে আসলাম। অনেকটা দ্যোদুল্যমান মনেই আসলাম। এখানে বলে রাখি, এই ইউনিভারসিটিতে প্রায় ১৩৫ টি দেশের মুসলিম ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করে। মসজিদের প্রতিটি ফ্লোরে ২ টি ইউনিট। একটি ছেলেদের, আর একটি মেয়েদের। ঈদের নামাজ পড়তে এসে আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো সবার দিকে তাকিয়েছিলাম! নানান দেশের ছেলেমেয়েরা নানান রঙে আর ডিজাইনে সুসজ্জিত হয়ে মসজিদ প্রাঙ্গণকে আলোকিত করে রেখেছে। অপরূপ সে দৃশ্য! নামাজ শেষে আমরা মেয়েরা একে অপরের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে, হাতে চুমু খেয়ে অথবা কারো কারো সাথে কোলাকুলি করে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করলাম। একবারের জন্যও মনে হয়নি, আমি এদের চিনি না! যেন আত্মার গভীর থেকে টান অনুভব করেছিলাম! অনেক নতুন নতুন বাংলাদেশী মেয়ে, আপু এবং ভাবীর সাথেও সেদিন পরিচয় হয়েছিল। দেশে ফেলে আসা বাবা-মা, ভাই-বোন আর আত্নীয় স্বজনদের বাদ দিয়ে বিদেশের মাটিতে ঈদ করার কষ্টটা কিছুটা হলেও লাঘব হয়েছিল।
ইসলামিক ইউনিভারসিটি হলেও এখানকার রেক্টর (এখানে ভিসিকে রেক্টর বলে) কিন্তু একজন মহিলা, যার নাম ড. জালেহা কামারুদ্দিন। ঈদের দিন ইউনিভারসিটি ক্যাম্পাসে উনি নিজে হাতে সৌজন্যমূলকভাবে স্টুডেন্ট দের খাবার সার্ভ করেন এবং সবার সাথে একসাথে বসে, খেয়ে, ঈদ উৎযাপন করেন। ইউনিভারসিটি ছাড়াও বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে সারাদিন ব্যাপী নানান পদের মুখরোচক খাবার সরবরাহ করা হয়। বাংলা কমিউনিটি থেকেও আলাদাভাবে ঈদ উৎযাপন করা হয়।
মালয়েশিয়ায় সংস্কৃতির একটা বিশেষ অংশ হলো, ঈদের দিন সব বাচ্চাদের হাতে ‘ডুয়েট রাইয়া’ (একই মানের ২ টি রিংগিটের ২ টি মূদ্রা একটি খামে ভরে প্রতিটি বাচ্চাকে দেয়া) একটি তুলে দেয়া। এমনকি প্রতিটি মালয় স্কুল থেকেও বাচ্চাদের এই ‘ডুয়েট রাইয়া’ দেয়া হয়। এখানে ছেলেরা ঈদের দিন যে ড্রেস পরে, তাকে বলে ‘বাজু মেলাউ’ (উপরের অংশটা ফতুয়া আর নিচেরটা পায়জামা আর তার উপরে লুঙ্গীর মতো) এবং মেয়েরা যে ড্রেস পরে, তাকে বলে ‘বাজু কুরুং’ (উপরের অংশটা কামিজ আর নিচেরটা স্কার্ট)। প্রায় সব মুসলিম মালয় মেয়েরা মাথায় হিজাব ব্যবহার করে। ঈদের দিনও এর ব্যতিক্রম দেখা যায় না।
অধিকাংশ মালয় ঈদের দিন খাবার সার্ভ করার ক্ষেত্রে পরিবার, আত্নীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব আর প্রতিবেশীর জন্য ‘ওপেন হাউস’ প্রোগ্রাম করে। এইদিন সবাই ইচ্ছেমতো সবার বাড়িতে গিয়ে খেতে পারে। ঈদের দিন মালয়েশিয়ানদের সবচেয়ে পরিচিত এবং সবচেয়ে পছন্দনীয় খাবার হচ্ছে ‘কেতুপাত’ (Ketupat)। এক ধরনের আঠালো ভাতের ভর্তা পরিমস একটা কলাপাতা বর্গাকারে কেটে এর মধ্যে রেখে চারপাশ থেকে মুড়িয়ে দেয়া হয়। এই ‘কেতুপাত’ ২/৩ ধরনের সস আর তরকারীর সাথে সার্ভ করা হয়। আর একটি বিখ্যাত খাবার হলো ‘নাসি পান্দাং’ ( Nasi Pandang)। এই রেসিপিতে ভাতের সাথে নানান ধরনের তরকারী পরিবেশন করা হয়। এছাড়া নানা ধরনের কেক, পেস্ট্রি আর স্নাক্সও সার্ভ করা হয়। সেইসাথে থাকে বিভিন্ন রংগ আর বিভিন্ন ফ্লেভারের সিরাপ, যেটাকে মালায় ভাষায় ‘মিনুম’ বলে, যার অর্থ হচ্ছে পানীয়। মালয়েশিয়ানরা ‘তেও পানাস’ (গরম চা) বা ‘কপি পানাস’ (গরম কফি) এর পরিবর্তে ‘তেও আইস’ (ঠান্ডা চা) কিংবা ‘আইস কপি’ (ঠান্ডা কফি) বেশী পছন্দ করে, যেটার চল ঈদের দিনও দেখা যায়।
বাংলাদেশীদের মতো মালয়েশিয়ারাও ‘কাম্পুং’ (গ্রাম) এগিয়ে আত্নীয় স্বজনদের সাথে ঈদ উৎযাপন করতেই বেশী পছন্দ করে। সবার সাথে একত্রিত হয়ে বার বি কিউ পার্টি করা আর ‘হারি রাইয়া’ গান শোনা এদের সংস্কৃতিরই অংশ।
যেহেতু মালয়েশিয়ানরা জাতিগতভাবেই খাদ্যপ্রেমী, তাই তারা যেকোন উৎসবে খাবারে ভিন্নতা আনতে এতোটুকু কার্পণ্য করে না। তাছাড়া এখানে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষাভাষী এবং নানান সংস্কৃতির লোকের বসবাস। তাই এখানে সবসময় একটা মিশ্র সংস্কৃতি বিরাজ করে, যার সবচেয়ে বেশি প্রভাব খাবারে গিয়ে পড়ে।
সালামাত হারি রাইয়া!