ডা. ফাতিমা খান
অফিসের পাশে সুপার শপে বাজার করছি, হঠাতই সাওসান এর সাথে দেখা। আমি খেয়াল না করলেও সে ঠিকই আমার কাছে অনেকটা ছুটে এসেই সালাম দিল। এখানকার রেওয়াজ অনুযায়ী পরিচিত কারো সাথে সাক্ষাৎ হলে সালাম বিনিময়ের পর কোলাকুলি করা হয়, যেমনটা আমরা ঈদের দিনে করে থাকি।
– কেমন আছ তুমি ডক্টর? কত্তদিন পর!
– সাওসান! কেমন আছ তুমি?
– খুব ভাল আছি আমি, আল্লাহ আমাকে অনেক ভাল রেখেছেন। তোমাকে একটা ভাল খবর দিতে চাই ডিয়ার; guess what?… আচ্ছা বলেই ফেলি। আমি সিগারেট, সিসা আর ওই যে বাকী ওইসব… সব ছেড়ে দিয়েছি। তোমার কথা গুলো আমার বারবার মনে পড়ে, সম্ভবত এজন্যই নিজেকে বদলাতে পেরেছি। ঐ যে বলেছিলে না Almighty created you with divine beauty and strength not to chase for the empty things that harm you, but to find your ownself and realize that you belong to Him only! “.
হুম, একবার বলেছিলাম বটে, অনেক কথাই তো বলতাম। ওকে কাউন্সিলিং করতাম মাঝে মাঝে। ওরাল থেরাপি হল সর্বোত্তম থেরাপি। আমার উদ্দেশ্য ছিল ফুলের মত মেয়েটা যেন অকালে ঝরে না পড়ে। বললাম,
– আচ্ছা, বেশতো! আজকে আমার সারাদিনের সবচেয়ে ভাল খবরটা তুমি আমাকে দিলে সাওসান। হ্যাপি টু হিয়ার দা বেস্ট নিউজ অফ দা ডে!
মেয়েটা কথায় কথায় অনেক কথাই মনে করিয়ে দিল। আমার খুব সাধারন উপদেশগুলোকে সে যে কত দামী উক্তি ভেবে যত্ন করে মনে রেখেছে তা ও না বললে হয়ত জানতাম না।
সাওসান ফিলিস্তিনি মেয়ে। “ফিলিস্তিন” নাম শুনলে যেমন একটা বিদ্ধস্ত দেশ, বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত পরিবার আর গোলা বারুদের ধোয়ায় ঝাপসা একটা ছবি ভেসে ওঠে, এখানে ফিলিস্তিনিদের অবস্থা কিন্তু সেরকম নয়। সৌদিআরবে প্রচুর ফিলিস্তিনিদের বসবাস, তাদের বাপ দাদাদের আমল থেকে। বেশীরভাগই ব্যবসায়ী। স্বভাবগত ভাবে তাদের মধ্যে একতা অনেক বেশী। সম্ভবত ‘একতার বল’ এর জন্যই তারা এদেশে অর্থনৈতিক আর সামাজিক খুটি মজবুত করে নিয়েছে। ফিলিস্তিনি মেয়েরা দেখতে সুন্দর আর তুলনামূলক ভাবে সৌদি মেয়েদের থেকে নমনীয় বলে পাত্রী হিসেবে এখানে তাদের চাহিদা আছে বেশ।
একুশ কি বাইশ বছরের উচ্ছল, চপল তরুণী সাওসান। খুব সাধারণ কিন্তু শিক্ষিত মেয়ে সে। এখনো তার মাঝে শিশুসুলভ কিছু স্বভাব রয়ে গিয়েছে। বছর পাচেক আগে বিয়ে হয়েছে এক ফিলিস্তিনি ধনকুবেরের ছেলের সাথে। যৌথ পরিবার, লোকজনে জমজমাট শ্বশুরবাড়ি। বাসায় বড় থেকে ছোট মোটামুটি সবাই ধুমপায়ী, অবসরে মজলিশে বসে সবাই একসাথে ধোয়া ছাড়ে, সিসা টানে। এমনকি ষাটোর্ধ শাশুড়িও তার কুঞ্চিত চামড়ার সরু দুই ঠোঁটের মাঝখানে সিগারেট সেটে লম্বা টান দেয়। শ্বশুরমশাই দেখতে কিছুটা Anthony Bardain এর মত, আমি যখন দেখেছি তখন তিনি তার টোবাকো পাইপ খানা দুই ঠোটের মাঝ খানটায় ধরে ছিলেন। মাথায় কাওবয় হ্যাট, ব্ল্যাক স্যুটে নিজেই তার হলুদ ‘হামার’ হাকিয়ে পুত্রবধূকে নিয়ে ক্লিনিকে এসেছিলেন। আমার ক্লিনিক থেকে মাইল খানেক দূরেই তদের ডুপ্লেক্স বাসা। অনেকবার তার বাসায় আমন্ত্রণ জানালেও সময়ের অভাবে যাওয়া হয়নি। তার সাথে আমার দেখা হত আমার ডেন্টাল অফিসে। যেদিন আমার ব্যস্ততা কম থাকত সেদিন তার রাজ্যের গল্প শুনতাম ।
অনেকদিন মেয়েটার চিকিৎসা করেছি। অতিরিক্ত ধুমপান আর অবহেলার জন্য তার সব দাঁতই প্রায় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ট্রিটমেন্ট চলাকালে সে তার জীবনের ভাল মন্দ অনেক গল্পই শেয়ার করত। আমি তার ধূসর নীল চোখের স্ফূর্ত চাহনীর দিকে তাকিয়ে শুনতাম আর ভাবতাম.. পরিবার বা পারিপার্শ্বিকতা মানুষের অভ্যাসকে কি ভীষণভাবেই না প্রভাবিত করে! কে বলবে এই মেয়ে টুয়েন্টি স্টিকস পার ডে স্মোক করে বা সিসাতে কয়েক টান না দিয়ে ঘুমুতে যেতে পারেনা! অথচ সতের বছর বয়সে হিশামের সাথে বিয়ের আগে পর্যন্ত কখনো নাকি সে সিগারেট ছুঁয়েও দেখেনি! প্রথমবার মদে চুমুক দিয়েছিল দুবাইয়ের এক হোটেলে হিশামের সাথে বসেই, শ্বশুরের এক বিজনেস পার্টনারের ডিনার পার্টিতে। তারপর ধীরে ধীরে সে অভ্যস্ত হয়ে যায়। হুইস্কি, বিয়ার, ভোদকার প্রথম স্বাদ গ্রহনের অভিজ্ঞতার গল্পগুলোও সে আমাকে শোনাতে বাদ দেয়নি। তবে আসক্তি ছিল শুধু সিগারেট আর সিসাতে। প্রেগ্ন্যান্সিতে অতিরিক্ত ধূমপানের কারণে তার একমাত্র ছেলেটা ক্রনিক লাং ইনফেকশনে ভুগছিল।
ডেন্টাল চেয়ারে তার সাথে শেষ সিটিং এর পর তাকে কিছু নাসীহা করেছিলাম।
– বুঝলে সাওসান, তোমার নামটা যেমন সুন্দর ( সাওসান অর্থ ফুল) , তুমি দেখতেও সেরকম অপরূপা। আচ্ছা বলতো কি লাভ এসব ছাইপাঁশ খেয়ে? মন্দ ছাড়া ভাল কি কিছু পেয়েছ এই ধোয়া ফুঁকে? তোমার বাবা মা যদি বেচে থাকতেন তাহলে তাদের ফুলের মত মেয়েটাকে আসক্ত দেখলে কি খুশী হতেন? আমি জানি তোমার একটা নিষ্পাপ অন্তর আছে। আমি চাই তুমি ভেতরে ও বাইরে অপরূপা হও, অদ্বিতীয়া হও। আমি তোমাকে আজই স্মোকিং ছেড়ে দিতে বলছিনা, বরং তুমি প্রতি সপ্তাহে একটা করে স্টিক কমিয়ে দাও। আগামী একবছর পর তোমার সাথে যদি আমার দেখা হয় তখন আমি তোমার মুখে শুনতে চাই.. বাহান্ন সপ্তাহে তুমি তোমার সব বাজে অভ্যাস ছেড়ে দিয়েছ। পারবে না ?
সাওসান কথা দিয়েছিল, কথা রেখেছেও। গত রমজান থেকে এই রমজান মাস, প্রায় একবছর পরই তার সাথে আমার এই সুপারশপে দেখা হল। সাওসান চলে যাচ্ছে জর্ডানে, তার চাচার কাছে যিনি ছোটকাল থেকে তার লালন পালন করেছেন। ” আই ওয়ান্ট টু টেইক আ টার্ন ইন মাই লাইফ । আই নিড আ চেইঞ্জ” – এরকম কিছু একটা বলল। ঠিক কি বোঝালো জানতে চাইনি। যেখানেই যাক ভাল থাকুক সওসান। নিজেকে গড়ে নিক। জীবনের পুরোটাই ওর এখনো বাকী প্রায়। শুদ্ধি আছে বলেই মানুষ ভুল করে, উপলব্ধি আত্নসংস্কারের মূল।
আলো, অন্ধকার , মেঘ, বৃষ্টি, রোদ, ছায়া, রংধনু – সবকিছুই মানুষের জীবনে একটু একটু চাই। পেইন্টিং এর প্যালেট এর মত জীবনটা, একেক খাপে একেক রঙ থাকতেই হয়। দুই তিন রঙ মিশে নতুন আরেকটা রঙ তৈরী না করলে যেমন ক্যানভাসের কিছু অংশ সাদাই থেকে যায়, আবার ভুল বাছাই করা রংগুলোর মিশ্রণে বেমানান রংটা ক্যানভাসের পুরো সৌন্দর্যটা নাশ করে ফেলে।। সবার জীবন রঙিন হোক, না হয় শুভ্রই থাকুক।