হাবিবা মৃধা
রমজান মাস এলেই ছোট্ট প্রানটা নেচে উঠত খুশিতে!আম্মুর সাথে তারাবী পড়ার সে কি আনন্দ!যদিও তখন নামাজের নিয়মকানুন কিছুই জানতাম না যতটুকু মনে পড়ে আম্মু কতবার সিজদায় যায় এটা দিয়ে রাকাত পূর্ণ করা হত!
আর এখন দেখি জেনেবুঝেও মানুষ শুধু রাকাত পূর্ণ করতে তারাবী পড়ে অথচ সময় নিয়ে নিষ্ঠার সাথে তারাবীতেই রয়েছে সফলতা রাকাত পূর্ণ এরপরেই গুরুত্বপূর্ণ!
সবচেয়ে প্রিয় সময় ছিল ভোর রাতের সেহরী!ভোর রাতে ইমাম সাহেব কাকার কুরআন তিলাওয়াত আর সেহরী আহব্বানেই আমাদের ঘুম ভাঙত!মনে পড়ে এখনো গ্রামের সেই রমজান মাসের বেহেশতি পরিবেশের কথা!
সবচেয়ে আনন্দের ছিল দিনে যে আমার দুই তিনটা রোজা হত!কিন্তু সে পনেরো দিনে ত্রিশ রোজা পূর্ণ হওয়ার খুশি আর বেশি দিন টিকেনি ছোটভাইয়ার জন্য!
ভোর রাতে বড়ভাইয়া,মেজোদাদা,মেজোআপু সবাইকে ডেকে ডেকে উঠানো হত আমাদের দুইভাইবোনের মনে হয় ঘুম পূর্ণ হতনা ভোর রাতে জাগার আশায়!
সবাই সেহরী খেয়ে আমাদের একটু শেষের দিকে খেতে ডাকত এখন মনে হচ্ছে সেটার কারণ ছিল দেরি করে খাবার খেয়ে যাতে দিন বারোটায় একটা রোজা হয়ে গেছে বলে খাবার খাই!
দ্বিতীয়ত আম্মু যাতে একটু শান্তি মত নামাজ পড়ে নিতে পারেন!আম্মু কাজের ফাঁকেই সবসময় নামাজ তিলাওয়াতের জন্য সময় নিতে চাইতেন!
আমরা দোতলার সিঁড়িতে বসে থাকতাম কখন আম্মু বলবে তোমরা হাতমুখ ধুয়ে খাবার খাও!কিন্তু তাদের খাবার শেষ হতে না হতেই ছোটভাইয়া বলত সেহরীর সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে এরপর রোজা হবেনা তুমি কান্না করে দাও।
যেইকথা সেইকাজ! কিন্তু খাবারের জায়গা থেকে আদেশ আসত ঠিক আছে হাত মুখ ধুয়ে এসো কাল ঠিক দশটার পরে ই খাবার খেতে হবে!
একদিন নিয়মের বিপরীত ঘটল,পাশাপাশি ঘুমিয়ে ছিলাম ছোটভাইয়া কে চুপি করে ডেকে নিয়ে এসেছে মেজো আপু,ঘুম ভেঙ্গে সে কি মনখারাপ!সেদিন সিঁড়িতে বসে কেদেছিল এই অবুঝ প্রাণীটি!
সকালে ছোটভাইয়ার সাথে অভিমান!কোন কথা নেই!অতঃপর তার সুন্দর বাণী ছিল এমন শোন!আমাকে এখন ডেকেই উঠানো হবে আমার পুরো রোজা থাকার বয়স হয়ে গেছে আর তুমি আরেক টু বড় হলে!আর দিনে যে দুইটা রোজা এগুলো কোন সত্যি রোজা নয় দিনে কিছু খেলেই রোজা হবেনা!
আম্মু কে একটু বেশি ই জ্বালিয়েছি এখন মনে পড়ে খুব মন খারাপ হয়!আম্মু চাইতেন ভোর রাত্রে একটু একা নিভৃতে নামাজ পড়তে আমরা ভাই বোন মিলে পুরো ঘরে বাইরে সেহরী আমেজ গড়ে তুলতাম!বড় ভাইয়া খেতে বসে কি মজার মজার ঘটনা ঘটাত আর সেই নিয়ে হাঁসি !!
ছোটভাইয়ার প্লেট থেকে মাছ ভাতের নিচে লুকিয়ে রেখে বলত বিড়াল নিয়ে গেছে আর সে সন্দেহ করতে নীরব চুপচাপ খেয়ে বাঁচতে চাওয়া মেজোদাদাকে!একটু পর প্লেটের ভাতে হাত দিয়ে মাছ পেতেই শুরু হত হাঁসি!
আম্মু বলতেন আশেপাশের মানুষেরা আগেই সেহরী খেয়ে ইবাদত বন্দেগী করছে তোমরা হইহুল্লোর করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলছ!
আম্মু কে সবচেয়ে বেশি জ্বালিয়েছি সেহরীর তরকারি নিয়ে!আমার একটা সাথী ছিল যার ঘরে রমজান মাসেও খুব একটা মাছ মাংস হতনা হয়ত বিশেষ উপলক্ষ ছাড়া!ও রাতে আমার কাছে ঘুমাতে আসত বেশিরভাগ সময় ই আমি জিজ্ঞেস করতাম আজ রাতে ওরা কি খেয়েছে ,ভোর রাত্রে কি খাবে??
কখনো ডিমরান্না,সবজি আর বেশিরভাগই আলুভর্তার কথা বলত!একদিন রাতে ও বলল আজ ওদের শুধু আলুভর্তা কিন্তু ওটা খুব মজা!! পেঁয়াজ তেলে নেড়ে বানিয়েছে ওর মা!আমার শুনে ই খেতে ইচ্ছে করল কিন্তু ওকে বলিনি সম্ভবত!
আমাদের ঘরে সেদিন ইলিশ মাছ কিন্তু একটাই মাছ যাতে ছটুকরো মাছ মাথা লেজ সহ আট পিচ হয়!আম্মুর হয়তো খেয়াল ছিল ওদের ঘরে দুই টুকরো রান্না করা মাছ পাঠিয়ে দিবে যেহেতু আমাদের ঘরে ছয়জন আমরা!
আমার এখনো মনে পড়ে আম্মু ওদের জন্য তরকারি দিতেই আমি বলি আম্মু দুই টুকরো মাছ পাঠালে ওর ছোট ভাইবোনদের জন্য ও খেতে পায়না আমার মাছ টুকরো আমি ওকে দিতে চাই আমাকে শুধু মাছের ডিম দিলেই হবে!আম্মু সহজ করে বললেন আজকে আশেপাশে সবাই মাছ এনেছে ওদের কে দিবে তো!
রাতে আবার সাথীকে জিজ্ঞেস করলাম কেউ তরকারি দিয়েছে ওর উত্তর নাতো!
আম্মু কে নামাজের ভিতরে গিয়ে আবার বলি আম্মু কেউ তরকারি দেয়নি ওদের ! আমার কথায় আম্মু সেদিন হয়ত বিরক্ত হয়েছেন কিন্তু রাগ করেন নি মোটেও তাছাড়া রাগমুখে আমি আম্মু কে দেখিনি!
এরপরে আম্মু নিজের টুকরো আমার সহ চারটুকরো মাছ দিয়ে আমতা আমতা করে কিছু একটা বলছিলেন শান্তি থাক এবার এমন!ভোর রাতে আম্মু আলুর ঝোল দিয়ে খেয়েছিলেন আর আমার জন্য ডিম রেখেছিলেন!
আজ খুব করে মনে পড়ছে সেই দিনটির কথা !আসলে নিজেরা মাছ গোশত দিয়ে পেটপুরে খেলেই বুঝি রোজা হয়!সমাজের মানুষের সেহরী আমেজ দেখে তাই মনে হয়!
তবে এর বিপরীতে ভালো মানুষ ও থাকেন সবসময় ই কম বেশি!আমাদের ইমাম সাহেব কাকার বাবা যাকে মাষ্টার দাদা ডাকি আমরা!এখনো পর্যন্ত রমজান মাসে তিনি ইফতারী নিয়ে সবার ঘরে ঘরে ঘুড়ে বেড়ান বিশেষ করে যাদের একটু আয়োজন কম হত তাদের জন্য!
প্রথম প্রথম যখন রোজা রাখতে শুরু করেছিলাম সেটাই বেশি মজার ছিল বার বার হাদীসে কুদসীর সেই হাদীস মনে পড়ত আল্লাহ্ নিজেই প্রতিদান দিবেন
তখন ভিতরে শুধু ভাইয়ার কাছে শোনা #বুখারী শরীফের হাদীসের কথা মনে পড়ে খুশি লাগত:রোজাদারের মুখের গন্ধ কস্তুরীর চেয়ে ও উত্তম!রোজাদার দুইবার খুশি হয় একবার ইফতারে দ্বিতীয়বার রবের সাথে সাক্ষাত লাভে!!
!ভাইয়া দুষ্টামি করে বলত তুমি ডুব দিয়ে পানি খেয়েছ গোসলের সময় আর আমি ভাবতাম সত্যি!!আবার আম্মুর কাছে গিয়ে কান্না!
আম্মুর ইফতার বানাতে বানাতে বেশিরভাগ সময় ই আজান দিয়ে দিত আর আম্মু খুব আফসোস করতেন সময় নিয়ে ইফতারের আগে দোয়া ও করতে পারিনা!! মায়েদের সংসারের সব কাজ সেরেই আবার সবার মুখে খাবার দিতে ইফতার তৈরি রান্নাবান্না আরো কতকাজ!
পাশের ঘরে ইফতার নিয়ে যেতে যেতে প্রায় সময় ই আজান দিয়ে দিত আর আমার ইফতার হত তাদের সাথে অবশ্য তারাও রখুব খুশি হতেন আর ঘরে ফিরে সবার কতরকম কথা শুনতাম!!
পবিত্র ক্বদরের রাত্রিতে সাথীরা মিলে গোসল করতাম প্রতি ফোঁটা পানিতে গুনাহ মাফ হবে তাই বেশি করে সাবান মাখা তবে আজো কোথাও এমন দলীল পাইনি একসাথে তারাবী,একসাথে কদর পড়তাম আমরা সাথীদের খুব মিস করি এসবের জন্য এখনো!
ছোট চাচাতো বোনটা একটু মাঝে মাঝে তারাবীতে আলসেমি দেখালে আম্মু শিখিয়ে দিতেন চার রাকাত পর পর মোনাজাত করতে আর প্রতি বার এটা মনে করতে প্রথমবার তারাবী শুরু করছি!সত্যি ই আম্মুর কথামত আমরা তাই করতাম বিশ রাকাত তারাবী কখন শেষ হত এতটুকু বিরক্তি আসত না!তাই ভাবছি রমজান মাস রোজার সাথে তারাবী আমাদের জন্য বিশেষ এক নেয়ামত সুস্থ মানুষদের রাকাত সংখ্যা নিয়ে কিসের এত বিরোধ!তাছাড়া প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবীগন যেহেতু বিশ রাকাত পড়েছেন!
কৈশোরের ইবাদত খুব নির্ভেজাল হয় বার বার ইচ্ছে করে আবার সেই কৈশোরের রমজানে ফিরে যাই আম্মু কে জ্বালানোর মুহূর্ত গুলো ফেরত দিয়ে দেই আম্মু আজ তোমার যতখুশি নামাজ পড় কারণ আব্বুর পরিশ্রম আর আম্মুর দোয়া ই হয়তো আমাদের যতটুকু সফলতা তার পিছনের চাবিকাঠি!!কতদিন আম্মুর সাথে ইফতার হয়না ভোর রাত পেরিয়ে উঠানে হাটতে হাঁটতে সুবহে সাদিক দেখা
হয়না! আবার কবে সব ভাইবোন মিলে আমেজ পূর্ণ সেহরী ইফতার হবে আম্মুর সাথে!!সবাই অনেক বড় হয়ে গেছি এই শহরে যে যারমত বন্ধু বান্ধবের সাথে ইফতার করি আম্মু হয়তো সেই আগের মতোই ইফতার নিয়ে বসেন আর আমাদের জন্য দোয়া করেন!!
হাবিবা মৃধা!!
শিক্ষার্থী ঢাবি!