banner

শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 1027 বার পঠিত

 

যে কথা বাবাকে বলা হয়ে উঠেনি মেয়ের!


রিজিয়া


হাসপাতালে ইমার্জেন্সীতে নিয়ে ভর্তি করার পর ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত তীব্র শ্বাসকষ্টে ভোগা মানুষটি তার মেয়েকে দেখে রাখার জন্য অনুরোধ করছেন মেয়ের অধঃস্তন সহকর্মীদের কাছে।

” আমার একটা মাত্র মেয়ে! আপনারা তাকে দেখবেন!”

মেয়ে কেবল সামনে তাকিয়ে থাকে ! দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসার কারণে বেশিদূর তাকানোও যায়না। বাবার মাথাটাই গেছে!মাথার দোষ দিয়েও লাভ কি! চোখের সামনে আত্মীয় পরিজন কাউকেতো পাননা মেয়েকে দেখে রাখার কথা বলার জন্য।সামনে আছে কেবলতো তারাই।এমন কষ্টেও হাসি আসে! দেখার মালিকতো একমাত্র আল্লাহ! সহকর্মীরা বিব্রত বুঝতে পেরে কথা বলে উঠে সে।
– বাবা, তুমি শান্ত হও। আল্লাহ আছেন।

অতঃপর মেয়েটার ভাবনার জগতে যে বিষয়গুলো খেলে যায় তার কোন উত্তর নেই এই পৃথিবীর কাছে।

হায় আল্লাহ! জীবনে পড়াশোনা শেষ করার সময় এত স্ট্রাগল করার সময়ে কাউকে কাছে না পেয়েও যখন আল্লাহ টিকিয়ে রেখেছেন,সেখানে অন্তত জীবন চালানোর মতো অবস্থায় এনে আল্লাহ কি ফেলে রাখবেন!তার ভরসা যে কেবল সেই মহান সৃষ্টিকর্তার উপর।চোখ বন্ধ করে তাঁর ভরসায় থাকতে পারে মেয়েটি এই বলে “তোমার কাছেই আমার জীবনের সবকিছু সমর্পিত।ধৈর্য্য দাও, কেবলই ধৈর্য্য দাও! ”

সেই ছোটবেলায় মায়ের কাছ হতে এই বিষয় বুঝে নেয়া মেয়েটি ” পৃথিবীতে মানুষ হয়ে বাঁচতে হলে আত্মনির্ভরশীল হয়ে বাঁচতে হবে”, তাকে আবার দেখে রাখার জন্য মানুষের কাছে অনুনয় করছেন তার পিতা!কেন!! মাথার উপর একটা পুরুষ নেই বলে!

অতঃপর যে কথা মুখ দিয়ে ফোটেনা, কেবল মনে মনেই বলে যায় তার বাবাকে।
পায়ের নিচে নিজের ভীততো আছে, বাবা! সেই ভীত যদি ভেঙ্গেও পড়ে আল্লাহ যে জ্ঞান দিয়েছেন তাতো রইলোই। এরপর তাও যদি না থাকে সেটাতো নিয়তি।নিয়তির কাছে মাথা নত করে পড়ে থাকবো। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগতো নেই!

বাবা!কেমন করে বলি, মাথার উপর পুরুষের ছায়া নয়;একটা ভালবাসার ছায়াই লাগে।যার কাছে গিয়ে মাথায় মমতার পরশ পাওয়া যায়।পৃথিবীর সবকষ্ট, জরাভোগশেষে তার কাছে ফিরে আবার সাহসী হওয়া যায় আগামী দিনের পথ চলতে। আর সেই আশ্রয়টা দেয়ার জন্য কেবল পুরুষ হলেই হয়না, মানুষের হৃদয়ও যে থাকতে হয়!

জীবনে কত অসহায় সময় পার করেছি!
তোমার কি মনে আছে বাবা? সেবছর তোমার মেয়ের ইন্টার পরীক্ষা চলাকালীন তোমার বউ – বাচ্চার চেয়ে অধিক প্রিয় তোমার ভাইয়েরা তোমাকে যৌথ পরিবার হতে আলাদা করে দিয়েছিল একটা পয়সা, একমুটো চালও না দিয়ে। অথচ তুমি মানুষটি কত বোকা ছিলে! তোমার ভাইয়েরা তোমাকে নাকি কোনদিন পর করবেনা।সবসময় ভাই, ভাইপোদের বেশি মায়া করেছিলে, এমনকি নিজের স্ত্রী সন্তানদেরও বেশি। সেদিন তোমার চেহারায় যে অসহায়ত্ব দেখেছি তখন না বুঝলেও পরে আমি ঠিকই বুঝেছি তোমার মানসিক অবস্থা। তুমি একদম চুপ হয়ে গিয়েছিলে।এক পয়সাও ছিলনা তোমার হাতে।আর তোমার পাশে মা – ই এসেছিল, সন্তানদের আগলে জীবনটা পার করতে। কিন্তু বাবা, সেই ছোটবেলা থেকে মিস করেছি তোমার স্নেহ, তোমার ভালবাসা। তুমি আমাদের কাছে ছিলে, কিন্তু আমরা যেন থাকতাম অনেক দূরে। সময়তো চলেই যায়, আল্লাহ চালিয়ে নেন। নিজেকে তবুও কত অসহায় লাগতো তখন!মনে হতো আমাদের মা ছাড়া আর কেউ নেই পৃথিবীতে !তখনও জীবন চলে গেছে!
এরপর যখন আত্মীয় পরিজন বিহীন উচ্চশিক্ষার জন্য শহরে গেলাম তখনোত কোন আশ্রয় ছিলনা নির্বিঘ্নে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার। আটবছরে কেউতো এসে বলেনি, কেমন করে আমি পড়ালেখা করছি!আমার কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা!আল্লাহতো জীবন থামিয়ে রাখেননি। আমি কেবল যুদ্ধ করেছি একটা সুন্দর কিছু পাওয়ার আশায়!আমার বিশ্বাস সবসময় ছিল, আল্লাহ মানুষের সুন্দর ইচ্ছেকে অপূর্ণতায় রাখেননা। শত বাধা,বিপত্তিতেও আল্লাহ আমায় পথ দেখিয়েছেন, এটা কি কম পাওয়া!সবচেয়ে বড় কথা আমি আল্লাহর উপর আস্থা নিয়ে চলি। আমার ভাগ্যে তিনি যতটা রেখেছেন তাতো আমাকে পেতেই হবে। আমি কেবল চেষ্টা করতে পারি সুন্দর কিছু অর্জন করার!বাকীটা তাঁর হাতে।

আল্লাহ আমাকে কম কিছুতো দেননি! পৃথিবীতে কত মানুষ কত কষ্টেই জীবন পার করে!আমিতো আমার অবস্থানে ভাল আছি।একজন মিথ্যাবাদী,প্রতারক জীবনের কিছু সময় কেড়ে নিয়েছে বলেই আমাকে এত অসহায় ভাবতে হবে বাবা?! তোমারতো খুশি হওয়া উচিত তোমার মেয়ে প্রতারকের অনিরাপদ ছায়াতে নেই। তুমি বুঝি আমার মাথার উপর ভন্ডের ছায়া দেখলেই খুশি হতে? অন্তত মাথার উপর একটা পুরুষের ছায়াতো থাকলো,তেমন?!

না বাবা! এমন পুরুষের ছায়া আমি চাইনা।মা আমাদের সারাজীন মিথ্যার চর্চা থেকে দূরে থাকা শিক্ষা দিয়েছেন।সেটা আমার জীবনের প্রতিটা পর্যায়ে প্রয়োগ করতে চেয়েছি। অন্তত যেটাকে আত্মার সম্পর্ক ধরে এগিয়েছি তাতেতো এতটুকু মিথ্যার ছোঁয়াও রাখিনি।অতঃপর তোমার মেয়ে যেটা জানলো, সেই আস্ত মিথ্যার ছায়ায় থাকার কোন অর্থ যে নেই তা আমার চেয়ে আর কে ভাল অনুভব করতে পারে! যদিও মাঝেমাঝে আমি শংকিত থাকি তোমার শেষ সময়ে আমাকে এমন কোন শর্ত দিয়ে না বসো তোমার মনের শেষ ইচ্ছে বলে! কিন্তু আমার প্রাণ গেলেও তোমার সেই ইচ্ছে আমি পূরণ করতে পারবোনা, বাবা! তুমি তোমার ইচ্ছে প্রকাশ করবে শত বছর ধরে লালন করা সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির কথা ভেবে। কিন্তু আমিতো তা ভাবিনা বাবা! সেই স্ট্রাগল করার সময়গুলোতে সমাজ চেয়েছে আমাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে। আমি নিজের মনোবলে সামনে এগিয়েছি। যখন কিছুটা সফল হলাম তখন এই সমাজই আবার আমার প্রশংসাই পঞ্চমুখ হয়েছে। আত্মীয় পরিজন, যারা কোনদিন খোঁজ নেয়নি পড়ালেখার বিষয়ে প্রমাণের চেষ্টায় থেকেছে ;তারাই যেন আমার জীবনে ত্রাতার ভূমিকায় অধিষ্ঠিত ছিল । আমি কেবল তাদের কাণ্ড শুনি আর হাসি। এদের জন্য করুণার হাসি ছাড়া আর কিইবা করার আছে! তো আমি করবো এমন সমাজকে কেয়ার? আমি আমার মনকেই শুনবো।আমার অন্তত নিজেকে ভাল রাখতে হবে। অসুস্থ সম্পর্কে ফিরে ধুকে ধুকে মরার কোন মানে হয়না।
অযথা ভয় পেয়োনা বাবা! জীবনটা এমনই।এখানে যুদ্ধ করতে হয়, টিকে থাকতে হয় আল্লাহর উপর ভরসা করেই।একশ দিন অশান্তিতে বেঁচে থাকার চেয়ে একঘণ্টা শান্তিতে বাঁচতে চাই আমি।আমার মাথার উপর তোমাদের দোওয়াতো থাকবে, এটাই আমার ছায়া! অন্য কোন ছায়া নাইবা থাকলো মাথার উপর!

লেখক: বান্দরবান থেকে

Facebook Comments