দম্পতি মানে কী? আভিধানিক অর্থে জায়া আর পতি।
সুখী দম্পতি মানে তাহলে একজোড়া সুখী চড়াই চড়ানি – সমীকরণটা যদি এত সহজ হত, তাহলে চারপাশে শুধু সুখেরই বন্যা বইত।
বিয়ের সাথে সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে চলে আসে শ্বশুরবাড়ি, আত্মীয় স্বজন। বিয়ে হলে একটা ছেলেকে বা একটা মেয়েকে একই সাথে অনেকগুলো বন্ধন তৈরি করতে হয়। এদের একেকটার ডাইমেনশন একেক রকম। যেমন শ্বশুর শাশুড়ির চাহিদার সাথে শ্যালক সম্বন্ধীয় আত্মীয়ের চাহিদার মিল নেই।
একটা নতুন বউ বা নতুন জামাই, বিয়ের অনুষ্ঠানে যেমন হাসি খুশি, লাজুক একটা ভাব নিয়ে সম্পর্কের বাঁধনে জড়ায়, নানা ধরণের আত্মীয়ের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে তা থেকে একটু সরে আসলেই অনেক সমালোচনার শিকার হতে হয়।
আজকের লেখাটা শুধু ছেলেদের উদ্দেশ্য করে লিখব। আমি জানি, বিয়ের আগে ছেলেরা খুবই ভয় পেয়ে যায় তার সবচেয়ে প্রিয় দু’জন মানুষ, মা আর স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্ক কেমন হবে তাই নিয়ে। অনেক ছেলেই এই অশান্তির ভয়ে বিয়ে করতেও চায়না।
তারা বুঝেও উঠতে পারেনা কী এমন হয়ে গেল সকাল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে, যে ঘরে পা দিয়েই মায়ের ছলছল চোখ, স্ত্রীর অগ্নিবর্ষণ (অথবা উল্টোটা) দেখতে হচ্ছে। প্রথম প্রথম হয়ত আপনি আসাতে পরিস্থিতি বদলাবে, কিন্তু মনটাকে বদলাবে কে? মায়ের কাছে বউয়ের নামে অসন্তোষ, বউয়ের কাছে মায়ের নামে গঞ্জনা – এসব শুনে শুনে ছেলেটার ত মানুষের উপর থেকে সম্মানটাই উঠে যাওয়ার কথা। প্রথম প্রথম ছেলেটার মন খারাপ থাকে, নিজেকে ব্যর্থ মনে হয়, একটা সময় বুঝতে পারে, উপেক্ষা করাটাই সহজতম পন্থা। দুইজন কে আলাদা আলাদা তাল দিয়ে মন রক্ষা করলেই সুন্দর শান্তি থাকবে ঘরে। আর সব মেয়েলি ব্যাপার নিয়ে ছেলেদের মাথা ঘামাতে নেই। তাদের সমস্যা তারাই সমাধান করুক, এ সময়টা বরং আমি একটু ঘুমিয়ে নেই।
আমি দাবি করছিনা আমি এই হাজার বছরের সমস্যার কোন ইনস্ট্যান্ট সমাধান নিয়ে এসেছি। আমি চাই আপনি আপনার ভূমিকাটাকে একটু যাচাই করুন। একজন সন্তান হিসেবে, একজন স্বামী হিসেবে, একটা পরিবারের প্রধান হিসেবে (শ্বশুরেরা সাধারণত মৌনী ঋষি হন – সময় মত খাবার, গরম পানি আর সংবাদপত্র পেলেই তাদের চলে তাই ফ্যামিলি ম্যানেজমেন্ট এর হর্তাকর্তা হিসেবে) আপনার কি আরো কিছু করার ছিল? আমি জানি এটা এমন এক সমস্যা যা নিয়ে অফিসের কলিগের সাথে আলাপ করা যায়না। বন্ধুরাও হয়ত ধৈর্য ধরার উপদেশ দিয়েই দায় সারবে। কিন্তু আপনি কি আরো একটু বুদ্ধি খরচ করে আরো একটু বেশি ইফোর্ট দিয়ে পরিবেশটাকে বদলাতে পারতেন? নিদেনপক্ষে আপনার মা ও স্ত্রীর মধ্যে দূরত্বটা একটু ঘুচাতে পারতেন?
প্রথমেই বলি, ছেলেরা ভুল আশা করে যে তার স্ত্রী তার মাকে ঠিক তার মত করেই ভালবাসবে। যদি না পারে, তাহলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, মেয়েরা এত সংকীর্ণমনা কেন? কিন্তু ব্যাপারটা যে অসম্ভব যে কোন মানুষের জন্যই! মায়ের সাথে সম্পর্কটা গড়ে ওঠে অনেক বছরের আদর ভালবাসার উপর ভিত্তি করে। সন্তানের দোষ মায়ের চোখে ধরা পড়ে না, তেমনি বাবা মায়েরও অনেক অন্যায় ছেলে মেয়েরা দেখেও না দেখার ভান করে।
অন্য মানুষের জন্য ত এটা করা যায়না। একটা ছেলে কি পারবে তার স্ত্রীর মাকে আপন মায়ের সমান ভালবাসতে? হ্যা, সার্ভিস হয়ত আপন মায়ের সমান দেয়া যায়, কিন্তু দোষ ক্ষমা করার বা উদারতার রেঞ্জটা কিন্তু এখানে কমই হবে, আর এটা খুবই ন্যাচারাল। মানতে কষ্ট হলে নিজেকে দিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট করে দেখতে পারেন। শ্বশুরবাড়িতে এক মাসের জন্য থেকে আসুন। জামাই হিসেবে না, ছেলে হিসেবে। বাজার করে দিন, বিল দিন, শ্যালিকাকে পড়ান, সংসারের খরচপাতির ব্যবস্থা করুন, শাশুড়িকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান, তখনই বুঝতে পারবেন অন্য একটা পরিবারে গিয়ে ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে দিনের পর দিন সবাইকে খুশি রাখা কত কঠিন।
দ্বিতীয়ত, একজন ভাল মা মানেই একজন ভাল শাশুড়ি না। একজন চমৎকার মানুষ মানেই একজন ভাল বৌমা না। একজন ভাল লেখক যেমন ভাল প্রশাসক না – তেমনি একেকটা সম্পর্কের ডাইমেনশন একেকরকম, দায়িত্বগুলিও ভিন্ন। সেজন্য আপনার ফেরেশতাসম মা শাশুড়ি হিসেবে ব্যর্থ হলে বুক ভেঙে যাওয়ার কোন কারণ নেই। যে মেয়েটা ফুল দেখত, গান গাইত, চিঠি লিখত, বিয়ের পর ঘরে এসে চরম পলিটিক্স শুরু করলে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয়ার দরকার নেই।
তৃতীয়ত, মা আর স্ত্রী – এদের মধ্যে যে বন্ধন তা আপনাকে কেন্দ্র করেই রচিত। এই সম্পর্ক কোন খাতে বইবে – সেটাও অনেকটা নির্ভর করছে আপনার সাথে তাদের সম্পর্ক কেমন তার উপর। এটা একটা টাগ অব ওয়ারের মত, দুটো নারী তাদের সমস্ত কিছু দিয়ে একটা প্রতিযোগিতায় নেমেছে, পুরস্কার আর কিছু না, আপনার অখন্ড মনোযোগ। বাস্তবিক, আমার মনে হয়, ছেলেটার একটা ক্লোন করে যদি দু’জনের হাতে দুটো ধরিয়ে দেয়া যেত – তাহলে বেশ হত।
চতুর্থ, এরকম সিলি বিষয় নিয়ে এরা এমন করে কেন – এরকম একটা উঁচুদরের চিন্তা করে গা বাঁচিয়ে চলার অবকাশ নেই। সিলি বিষয়গুলি মোটেও সিলি না, কারণ এর কারণে পরিবার নামক দেয়ালটায় বড়সড় ফাটল দেখা দিচ্ছে। আপনি কি শুধু এক কোণে দাঁড়িয়ে দেখবেন, আর মাঝে মধ্যে দুই পক্ষেই হাত লাগাবেন? এর বেশি কি আপনার কিছু করার নেই?
(পরের পর্বের জন্য “অপরাজিতার” সাথেই থাকুন)
নুসরাত রহমান
পিএইচডি(বায়োলজি)